|
|
|
|
আপত্তি নয় প্রাইভেট প্র্যাক্টিসেও |
|
এলাকার চিকিৎসক
এলাকাতেই, সূত্র মমতার
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
|
|
চিকিৎসকরা যে এলাকার বাসিন্দা, তাঁদের সেই এলাকাতেই নিয়োগ বা বদলি করতে চায় রাজ্য সরকার। লক্ষ্য গ্রামে চিকিৎসকের অভাব মেটানো এবং তাঁদের দায়বদ্ধতা বাড়ানো। নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদের নিয়োগ এবং বদলির ক্ষেত্রেও তিনি যে একই পন্থা অনুসরণ করার পক্ষপাতী, সোমবার তা স্পষ্ট করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার টাউনহলে রাজ্যের বিভিন্ন ব্লক, মহকুমা এবং জেলা থেকে আসা ৭০০ চিকিৎসকের সামনে, এই দাওয়াইয়ের কথা জানিয়ে মমতা বলেন, “রাতারাতি কোনও ম্যাজিকও হবে না। টাকা নেই, জেনে রাখুন। এর মধ্যেই কাজ করতে হবে। সব ঠিক করতে ৬/৮ মাস লাগবে। আপনারা ছ’মাসের পরিকল্পনা তৈরি করুন।” দৈনন্দিন কাজ করতে তাঁদের কী কী অসুবিধা হয়, তা এ দিন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন বিভিন্ন চিকিৎসকও।
বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকদের কাজকর্মের পর্যালোচনার উপরে জোর দেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি বুঝিয়ে দেন, চিকিৎসকেরা প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করছেন বলে যে গেল গেল রব উঠছে, তাতে তাঁর আপত্তি রয়েছে। বলেন, “হাসপাতালের কাজ যথাযথ ভাবে করার পর যদি চিকিৎসকেরা প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করেন, তাতে কোনও আপত্তি নেই সরকারের। আমরা চাই, হাসপাতালের কাজটা চিকিৎসকেরা ঠিক ভাবে করুন।” মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার খোলনলচে বদলাতে তাঁর সরকারের প্রচেষ্টায় কী ফল হল, তা জানতে ছ’মাস পরে ফের তিনি চিকিৎসকদের মুখোমুখি হবেন। বলেন, “৬ মাস পর পর আবার বসুন। এ বার যখন আসবেন হাতে কাগজ নিয়ে আসুন। তাতে লিখে আনবেন, কী কী দরকার। কতটা কাজ হল, সেই পারফরম্যান্স বিচার করাও খুব জরুরি।”
চিকিৎসকেরা যে যে এলাকার লোক, তাঁদের সেখানকারই হাসপাতালে নিয়োগের পক্ষে তাঁর যুক্তি এ দিন স্পষ্ট করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “এতে চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি হয়। তাঁরা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগও ভাল রাখতে পারেন। একই ভাবে নিজেদের এলাকার হাসপাতালে কাজ করতে পারলে নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদেরও দায়বদ্ধতা বাড়বে।”
উপস্থিত চিকিৎসকদের অনেকেই মমতার কাছে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী সঙ্কটের প্রসঙ্গ তোলেন। সেই সঙ্কট মেটাতে রাজ্য সরকার কী ভাবছে, তা-ও জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “চতুর্থ শ্রেণির কর্মী না থাকলে পাড়ার দু’তিন
জনকে নিয়ে আসুন। দু’জন গরিব লোককে রাখুন। রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে তাঁদের টাকা দিন। সব সময় টেন্ডার করার কী আছে? ওঁরা ভাল কাজ করলে পরে স্থায়ী লোক নেওয়ার সময় ওঁদের নাম সুপারিশ করুন। কত লোক, স্বেচ্ছাসেবী বিনা পয়সায় কাজ করতে চান। কখনও খোঁজ নিয়ে দেখেছেন কি?”
গত ৩৫ বছরে ‘দলবাজি’ করে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোই যে বামফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়েছে, এ দিন সেই অভিযোগও তোলেন মমতা। আর কেন এত দিন অন্যায়-অবিচারের কোনও প্রতিবাদ স্বাস্থ্য দফতরের অফিসার বা চিকিৎসকেরা করেননি, তা জানতে চান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর মন্তব্য, “স্বাস্থ্য দফতর নিয়ে প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করেনি। বড় নেতা হলে তাঁকে স্পর্শ করা যাবে না এখানেই প্রশাসনের দুর্বলতা ছিল। ৩৫ বছর ধরে করেছেটা কী? প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ধুঁকছে, জেলা হাসপাতাল ভুগছে, তাই মানুষকে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া থেকে হয় ভেলোরে নয় কলকাতায় ছুটতে হচ্ছে। চিকিৎসক ভাইবোনেরা বা স্বাস্থ্য দফতরের উচ্চ পদস্থ অফিসারেরা কেন প্রতিবাদ করেননি?” |
১০ দাওয়াই |
l বিভিন্ন হাসপাতালে আরও তিন হাজার শয্যা
l ৭ হাসপাতালকে জেলা হাসপাতাল করা
l যে চিকিৎসক যে এলাকার, তাঁকে সেখানে নিয়োগ বা বদলি
l এলাকার ছেলেমেয়েদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে নিয়োগ
l কলকাতায় রাতে রোগী পাঠাতে হলে আগে জানানো
l কেন পাঠানো হচ্ছে, তার লিখিত কারণ দেওয়া
l ৩০০ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ
l জেলা হাসপাতালে এমআরআই, সাবসেন্টারে সিটি স্ক্যান
l রোগী কল্যাণ সমিতিতে এলাকার দুই অরাজনৈতিক ব্যক্তি
l ছোটখাটো যন্ত্র কেনার দায়িত্ব সমিতিকে |
|
রাজ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোথায় কোথায় গলদ রয়েছে, সেগুলো খুঁজে বের করতে যে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন, এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেই তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। মমতা বলেন, “অনেক সময় সরকারি সিদ্ধান্ত ব্লক বা জেলা স্তরে পৌঁছয় না। সমন্বয়ের অভাবে ব্লক বা গ্রাম স্তরের কর্মীরা সেই সিদ্ধান্ত জানতেই পারেন না। এটা একটা অপরাধ। স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের একটা খারাপ ধারণা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েই গিয়েছে।” এত দিন যাঁরা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের জেরে ‘সুবিধা’ ভোগ করে এসেছেন, তাঁদের নিয়ে কী করবে নতুন সরকার? মমতা বলেন, “আমাদের অনেক ভাল অফিসার রয়েছেন। কিন্তু কেউ খারাপ করলে, সবার উপর তা বর্তায়। তা বলে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে চাই না। কাউকে তাড়িয়ে দিতেও পারি না। সবাইকে সহ্য করতে হবে।” রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে অনেকে যে সরকারি হাসপাতালের আবাসন দখল করে রয়েছেন, তারও উল্লেখ করেন তিনি।
উপরতলার অফিসারেরা ঘরে বসে কাজ করেন বলে অনেক দিনের অভিযোগ। মমতা সে বিষয়টির উল্লেখ করে বলেন, “উপরতলার অফিসারদের বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে হবে। ঘুরে ঘুরে নজরদারি চালাতে হবে।” চিকিৎসকদের তাঁদের দায়বদ্ধতার কথা মনে করাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, “বিশ্বাস করুন, আমার জীবন দিয়ে দেখেছি, মৃত্যুর পরে একটা সাদা চাদর আর দু’টো ফুল লাগে। বেশি টাকা-টাকা করে কী হবে? সোনার চচ্চড়ি খাবেন? গ্রামে পুলিশ আর চিকিৎসককে মানুষ ঈশ্বরের মতো দেখেন। এটা টাকার থেকে অনেক বড়। তিনি যদি একটু দেখেন, একটু হেসে, ভাল মুখে কথা বলেন, তা হলে মানুষের মনোবল অনেক বাড়ে।”
হাসপাতালে হামলা বন্ধ কী ভাবে করা যায়, সে বিষয়েও দাওয়াই বাতলেছেন মমতা। তিনি বলেন, “হাসপাতালে যেটুকু ওষুধ থাকে তা-ও অনেক সময় ব্যবহার হয় না। মেয়াদ পার হয়ে যায়। এটুকুও দেখা হবে না? হাসপাতাল তো দেবালয়। তাকে সে ভাবে দেখলে ভাঙচুরও বন্ধ হয়ে যাবে। ভাল কাজ করতে আকাশ থেকে লোক আসবে না। আপনাদেরই করতে হবে। মানুষকে সুপরিষেবা দিতে শুরু করুন। বিশ্বাস করুন, সমস্যার সমাধান হবে।”
রাজ্য সরকারের আর্থিক সঙ্কট রয়েছে। এই অবস্থায় এক দিনে সব সমস্যার সমাধান যে করা যাবে না, তা মমতা মনে করিয়ে দেন চিকিৎসকদের। তাঁর আহ্বান, “আসুন, আমরা সবাই মিলে ভাল করে কাজ করি। আবার বসুন ৬ মাস পর পর। এ বার যখন আসবেন, হাতে কাগজ নিয়ে আসুন। তাতে লিখে আনুন, ‘আমার এই-এই চাই।’ আপনাদের উপর আমার বিশ্বাস আছে। এই পরিকাঠামোতেই আপনারা পারবেন।”
চিকিৎসকদের উদ্দেশে মমতা জানতে চান, “কি?আপনারা করবেন তো?” উপস্থিত চিকিৎসকদের মধ্যে থেকে আওয়াজ ওঠে, “করব, করব।” |
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ |
l আমাদের হাসপাতালে সব কিছুর অভাব। প্রতি দিন হাসপাতাল চালানো কঠিন হয়ে উঠছে। তার উপর বদলির সমস্যা। যিনি এক বার উত্তরবঙ্গে বদলি হন, তিনি শুধু অপেক্ষা করেন, কবে দু’বছর পার হবে।
তাপস ভট্টাচার্য, অধ্যক্ষ, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
l পুরুলিয়ায় কেউ কাজ করতে আসতে চান না। কারণ ডাক্তারেরা ন্যূনতম সুযোগসুবিধা পান না। খুব কষ্টে থাকেন। কোয়ার্টার খারাপ, জল, বিদ্যুতের সমস্যা।
কৃষ্ণপ্রসাদ সর্দার, সহকারি মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা, পুরুলিয়া
l এখানে বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা ফুটপাথে বসে থাকেন। তহবিলে টাকা নেই বলে বেঞ্চ কিনে দিতে পারছি না। ২৪ ঘণ্টা রক্ত ও অন্য পরীক্ষা হওয়া দরকার। যক্ষ্মার চিকিৎসাতেও এখানে টাকা লাগে।
মালা ভট্টাচার্য, অধ্যক্ষ, চিত্তরঞ্জন সেবা সদন |
|
|
|
|
|
|