বিড়লা অ্যাকাডেমির চুয়াল্লিশতম বার্ষিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি অ্যাকাডেমির পাঁচটি গ্যালারি জুড়ে। মোট ৩৯৪টি কাজ ছিল। এর মধ্যে ১৬০টি তরুণ শিল্পীদের নির্বাচিত কাজ। বাকি ২৩৪টি আমন্ত্রিত প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের। বিড়লার বার্ষিক প্রদর্শনীতে একটি সর্বভারতীয় চরিত্র রাখার চেষ্টা করা হয়। এ বারেও বাইরের শিল্পী আছেন। সব মিলিয়ে প্রদর্শনীতে বাংলার এখনকার চিত্রভাস্কর্যের চালচিত্রই বেশি পরিস্ফূট। বিকল্প মাধ্যম নিয়ে যে প্রভূত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে এখন, বিশেষত তরুণ শিল্পীদের হাতে, তার প্রতিফলন এই প্রদর্শনীতে খুবই কম। প্রথাগত ধারারই প্রাধান্য। সেই প্রথাগত ধারারও সব উজ্জ্বল দিক এখানে প্রতিফলিত হয়নি। ১১০০ শিল্পকাজের ভিতর থেকে মাত্র ১৬০টি নির্বাচিত হয়েছে। তাতেও অতি সাধারণ মানের কাজ ঢুকে পড়েছে অনেক। অনির্বাচিত কাজের মধ্যেও ভাল কাজ কিছু ছিল কিনা সেটা জানার কোনও উপায় নেই।
এই প্রদর্শনীতে যেটা সমস্যা হয়েছে, আমন্ত্রিত অনেক শিল্পীর কাজই খুবই মাঝারি মানের। প্রদর্শনীকে সেটা ভারাক্রান্ত করেছে। |
মোট ৯ জন শিল্পী পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁদের সকলেরই বয়স ৩৫-এর নীচে। ভাস্কর্যে দু’জন। সৈকত হালদার ও দেবেশ উপাধ্যায়। পাথর ও ধাতুতে করা সৈকতের ‘ইনসিকিওর্ড উম্ব’ ডিমভরা মাছের অংশ। ভাবনার অভিনবত্বে এটি আকর্ষক। দেবেশের টেরাকোটায় মোটর সাইকেল আরোহীর প্রতিমাকল্প অভিব্যক্তির দীপ্রতায় ও মাধ্যম ব্যবহারের সৌকর্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ড্রয়িং-এর জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন অরুণাংশু রায়। সাদাকালোর রৈখিক বুনোটে ও পরিসর বিন্যাসের স্বকীয় পদ্ধতিতে তিনি আধুনিকতার জটিলতার ভিতর ঐতিহ্যের সূক্ষ্ম আলোছায়াকে খেলিয়েছেন। ছাপচিত্রে পুরস্কার পেয়েছেন মানিককুমার ঘোষ। সেরিগ্রাম ও এচিং-এ করা তাঁর রচনাটির শিরোনাম ‘উই ক্যান বাট আই কান্ট।’ এক নগ্নিকা গর্ভিনী নারী ও তার ছায়া মুখোমুখি সংস্থাপিত। গর্ভের কিনারা ঘেঁসে হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে। অ্যাক্রিলিক-ভিত্তিক মিশ্রমাধ্যমের ছবিতে পুরস্কৃত হয়েছেন তিন জন। মিঠুন দাশগুপ্ত, সুদীপ সাহা ও তুষারকান্তি প্রধান। আজকের বাস্তব সমস্যার নানা দিক তাঁরা কল্পনাদীপ্তভাবে শিল্পিত করে তুলতে পেরেছেন। পুরস্কৃত আলোকচিত্রীদের মধ্যে বিভাস ভট্টাচার্যের রচনাটি চিত্রীয় বৈভবে উজ্জ্বল। সৌম্যজিৎ রায় মানব-অধ্যুষিত নিসর্গের পরিসর বিন্যাসকে শিল্পিত করেছেন।
নির্বাচিত শিল্পীদের মধ্যে অনেকের কাজেই সম্ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে। নির্মাণ পদ্ধতির দিক থেকে উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মল্লিকা দাস-সুতার, বরুণ প্রামাণিক, নান্টুবিহারী দাস, স্বপনকুমার মল্লিক, তারকনাথ মজুমদার, রুদ্রনীল দাস, পাপ্পু বর্ধন, অর্ণব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
আমন্ত্রিত শিল্পীদের মধ্যে বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রখ্যাত চিত্রী সুনীল দাসের ‘স্ট্যাচু অব হোপ’ কাঠের অলঙ্কৃত স্তম্ভের উপরে স্থাপিত ব্রোঞ্জের এক মানবপ্রতিমা। পিছনে বৃত্তাকারে বিশ্বের আভাস। রূপবিন্যাসে স্বকীয়তার মধ্য দিয়ে এই ভাঙা বিশ্বে তিনি এক আশার প্রতীক নির্মাণ করতে চেয়েছেন। বিমূর্ততার মধ্যে স্মরণীয় রচনা ভূপালের বিশিষ্ট শিল্পী ইউসুফের। পলা সেনগুপ্তের সুতোর কারুকাজে সমৃদ্ধ ‘রিভার্স অব ব্লাড-দ্য টোবাকো ট্রেইল’ মানবীচেতনার বৈশিষ্টে উজ্জ্বল। ভাস্কর্যে সতীশ চন্দ্রের সিরামিক, চামড়া ও কাঠের ‘মুখোশ’, সলিল সাহনির ব্রোঞ্জে ‘আ ট্রিবিউট টু রবীন্দ্রনাথ’, জনক ঝংকার নার্জারির ইনস্টেলশনধর্মী রচনা ‘ডেথ অব ওয়ার-পেস্টওয়ার মিউজিয়াম শো’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করে অমলনাথ চাকলাদারের ‘ফাইটিং বার্ডস’, সৌমিত্র করের টেম্পোরায় ‘নবান্ন’ ও ব্রতীন খানের তেলরঙে ‘ডন’। আলোকচিত্রে অতনু পালের ‘মাই সিটি’ বিদ্যুতের তারের জালিকার প্রেক্ষাপটে ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মানুষের স্যালুট, বেণু সেনের ‘সাইনেস’ ও সুনীলকুমার দত্তের সমুদ্রের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা একলা নারী কাব্যময়তায় সমৃদ্ধ। |