|
|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
আধুনিকতার জটিলতাতেও পুরাণকল্পের চেতনা |
সম্প্রতি চিত্রকূট গ্যালারিতে রামকুমার মান্নার ২০টি ছবির প্রদর্শনী ঘুরে দেখলেন মৃণাল ঘোষ। |
রামকুমার মান্না এখন ভাস্কর হিসেবে খুবই সুপরিচিত এবং খ্যাতিমান। ভাস্কর্যের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি থেকে তাঁর কাজ একেবারেই আলাদা। ১৯৯০-এর দশক পরবর্তী বিশ্বায়ন-উত্তর উত্তর আধুনিকতার আবহমণ্ডলের ভাস্কর্যে এসে মিশেছে নানা উৎসের উত্তরাধিকার। সাম্প্রতিকের জটিল বাস্তবতা ও সামাজিক পরিস্থিতির প্রতিফলন আজকের ভাস্কর্যের আঙ্গিককে করেছে বহুমাত্রিক। দেশীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের সীমাকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতার দিকে তার ঝোঁক প্রবল। মেধার প্রবল পরাক্রমে মননের সাবলীল স্বত:স্ফূর্ততা অনেক সময়েই ব্যাহত হচ্ছে। শুধু বিশ্বায়ন-উত্তর ভাস্কর্যই নয়, ১৯৬০-এর দশক পরবর্তী ভাস্কর্যেও আঙ্গিকের নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে ঝোঁক ছিল প্রবল।
আধুনিকতাবাদী ভাস্কর্যে রূপের ঐকান্তিকতা বা ‘ফর্ম-ইটসেল্ফ’ এর সাধনা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্য আধুনিকতায় রূপের যে বিশ্লেষণ- সেটাকে আত্মস্থ করে ভারতীয় আধুনিকতার এক স্বতন্ত্র স্বরূপ তৈরি করতে চাইছিলেন আমাদের ভাস্কররা।
রামকুমারের ভাস্কর্য এই সব জটিলতা থেকে অনেক দূরবর্তী। তাঁর ভাস্কর্য সরল, সাবলীল দেশীয় লৌকিক উত্তরাধিকারে সমৃদ্ধ এবং লৌকিক পুরাণকল্পের নানা প্রকাশে ঋদ্ধ। এই জন্য তাঁর ভাস্কর্যকে আধুনিকতার জটিলতার পরিসরের মধ্যে আনা যাবে কিনা-এ বিষয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু শুধু লৌকিক ভাস্কর্যের কৌম-চেতনার গণ্ডির মধ্যে তার ভাস্কর্যকে যে আবদ্ধ রাখা যায় না-এ কথাও ঠিক। কেন না তাঁর কাজে তাঁর ব্যাক্তিত্বের প্রকাশ খুব শক্ত। ব্যক্তির স্বকীয়তার বোধ তো আধুনিকতার একটা লক্ষণ। |
|
শিল্পী: রামকুমার মান্না |
সম্প্রতি চিত্রকূট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল তাঁর টেরাকোটা ভাস্কর্যের একক প্রদর্শনী। সেখানে প্রদর্শিত ২০টি রচনায় রূপের যে সারল্য ও লাবণ্য, তা আধুনিক ভাস্কর্যের এক বিকল্প পরিসর হিসেবে মুগ্ধ করে।
রামকুমার মেদিনীপুর জেলার এক কৃষক পরিবারের সন্তান। মাটি নিয়ে খেলতে খেলতেই মূর্তি গড়েছেন। তাঁর নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা দেখে তাঁকে শিখিয়েছেন কোনও গ্রামীণ মূর্তিশিল্পী। শেখার প্রবল আগ্রহ এবং সেই সঙ্গে জীবিকার তাড়না মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৭২ সালে তাঁকে টেনে আনে কলকাতায়। নানা জীবিকার সঙ্গে যুক্ত থেকেও মাটির প্রতি তাঁর ভালবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এবং নিভৃতে সাধনা করে গেছেন। সাধনা সফল হয়েছে এক সময়। তাঁর কাজ দিয়ে আকৃষ্ট করেছেন শিল্পানুরাগী বিদগ্ধ কিছু মানুষকে। তাঁর নিজস্ব রূপভাবনার দেবদেবীর মূর্তি রূপের স্বকীয়তার জন্যই আকর্ষণ করেছে অনেককে। তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৭৮ সালে অ্যাকাডেমিতে।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে তাঁর যে কাজগুলি রয়েছে তা সবই বাংলার লৌকিক দেবদেবীর। কৃষিনির্ভর সজল বাংলার কৌম জনচেতনার সুদূর অতীত থেকে উৎসারিত হয়েছে এই সব দেবদেবী। আজকের প্রযুক্তি অধ্যুষিত জীবনের জটিলতাতেও গভীরে ফল্গুস্রোতের মতো প্রবাহিত হচ্ছে এই পুরাণকল্পের চেতনা। তারই কিছু রূপ উঠে আসে এই শিল্পীর হাতের কারুকাজে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কৃষ্ণের মূর্তির পাশাপাশি তিনি গড়েছেন মা মনসা, পদ্মা, লক্ষ্মী, গঙ্গা ইত্যাদি একেবারে লৌকিক দেবদেবীও। মকরের উপর অর্ধ-শায়িতা দেবীগঙ্গা, সাপের ফণার উপর যুবতীর রূপে মা মনসা, বরাহের মতো একটি পশুর পৃষ্ঠদেশে চণ্ডী বা কুণ্ডলীকৃত সাপের শরীরের উপর, তারই ফণার ছত্রছায়ায় পা ছড়িয়ে বসে থাকা বিষ্ণুর মূর্তির মধ্য দিয়ে শিল্পী বাংলার সুদূর অতীতের জনমানসে সৃষ্ট রূপগুলিকে তুলে এনেছেন আজকের মানুষের সামনে। তাঁর অধিকাংশ মূর্তিই কতগুলি মৌলরূপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। কৃষিজমির মাটির সঙ্গে পাথর ও সুরকির গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি মূর্তিগুলিকে কাঠের আগুনে ৯০০ থেকে ৯৫০ ডিগ্রি তাপে পুড়িয়ে গড়ে ওঠা তাঁর টেরাকোটা ঐতিহ্যের অতীতকে সাম্প্রতিকে প্রসারিত করে। এই উজ্জ্বল উদ্ধারে তাঁর শৈল্পিক অনন্যতা। |
|
|
|
|
|