|
|
|
|
আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস |
শর্করার বিষ এড়াতে গোড়াতেই চাই সতর্কতার দাওয়াই |
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
যদি ওঁরা একটু আগে হুঁশিয়ার হতেন!
তা হলে হয়তো ওঁদের অনেকের জীবন ওষুধ, ইনসুলিন ও খাওয়া-দাওয়ার এমন কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ত না। এবং হয়তো একটা জটিল রোগের হাত ধরে আরও পাঁচটা জটিল রোগের শিকার হয়ে পড়তেন না ওঁরা অনেকেই!
সমীক্ষা বলছে, এ দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের প্রায় ৮০% আদৌ জানেনই না যে, তাঁদের রোগটা রয়েছে! আরও বড় অশনিসঙ্কেত যে তথ্যে, তা হল: দেশে এখন প্রতি ১০০ জনে ১৪ জনই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঠিক আগের ধাপে (প্রি-ডায়াবেটিক), সাবধানতার অভাবে যাঁরা যে কোনও সময়ে ‘ডায়াবেটিক’ তালিকায় নাম লেখাবেন। উল্লেখ্য, এদের একটা বড় অংশই শিশু!
কিন্তু সাবধান হওয়ার প্রয়োজনীয়তা মানুষকে বোঝাবে কে? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এ দেশে ডায়াবিটিস সম্পর্কে গবেষণা হয় নামমাত্র। সচেতনতা? আরও কম।
পরিস্থিতি মোকাবিলার তাগিদে গবেষক-চিকিৎসকদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠেছে একটি সংগঠন। সেই ‘ইন্টিগ্রেটেড ডায়াবেটিস অ্যান্ড এন্ডোক্রিন অ্যাকাডেমি’ মনে করে, লাগাতার প্রচারই ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একমাত্র হাতিয়ার। চিকিৎসক মহল তা মেনেও নিচ্ছে। ডায়াবেটিসের কবলে পড়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি কাদের?
চিকিৎসক-গবেষকদের ব্যাখ্যা: কেউই বিপদসীমার বাইরে নয়। মা-বাবার ডায়াবিটিস রয়েছে, এমন সন্তানের যেমন ঝুঁকি রয়েছে, তেমন যে শিশুর পরিবারে কারও কস্মিনকালে ডায়াবেটিস ছিল না, সে-ও রেহাই পাচ্ছে না। এ ছাড়া স্থূলত্ব, কোলেস্টরল-ট্রাইগ্লিসারাইডের সমস্যাসম্পন্ন, এবং হার্ট বা কিডনির রোগে আক্রান্ত যে কোনও বয়সের মানুষের ডায়াবেটিক হয়ে পড়ার ঝুঁকি যথেষ্ট।
আরও চিন্তার বিষয় হল, কচিকাঁচাদের উপরে রোগটির ‘আগ্রাসন।’
চিকিৎসক-গবেষকমহলের অভিজ্ঞতা বলছে, ইদানীং স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে ডায়াবেটিস বাড়ছে। কলকাতার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ডায়াবেটিস ক্লিনিকগুলোর প্রতিটায় মাসে গড়ে ২০-২৫ জন শিশু বা কিশোর রোগী আসছে। তাদের অধিকাংশ ভুগছে অতিরিক্ত ওজনজনিত (ওবোসিটি) সমস্যায়। এরা ‘টাইপ টু’ ডায়াবেটিসের শিকার। সেটা কী?
ডাক্তারেরা জানাচ্ছেন, আগে যা ‘জুভেনাইল ডায়াবেটিস’ হিসেবে পরিচিত ছিল, সেই ‘টাইপ ওয়ান’ ডায়াবেটিসের মূল কারণ, শরীরে ইনসুলিনের ঘাটতি।
কিন্তু দেহের অতিরিক্ত ওজন ডেকে আনে এই ‘টাইপ টু’ ডায়াবেটিস-কে, অল্পবয়সীদের মধ্যে যার প্রকোপ উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। আর যার প্রেক্ষিতে অভিভাবকদের প্রতি চিকিৎসক-গবেষকদের বার্তা: এক বার এই ধরনের ডায়াবেটিস হলে সাধারণত তার নিরাময় হয় না। নিয়ম মেনে চললে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সে জন্য খাদ্যাভ্যাসে শৃঙ্খলা ও ওজন নিয়ন্ত্রণই একমাত্র পথ।
কী রকম?
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সুজয় মজুমদার বলেন, “রোজকার জীবনযাত্রায় সামান্য সতর্কতা এই রোগকে অনেকটা দূরে রাখতে পারে। অনেকে বুঝেও বোঝেন না। অথচ ডায়াবেটিস এক বার হয়ে গেলে চিকিৎসার খরচের নাগাল অনেকেই পান না।” এন্ডোক্রিনোলজিস্ট অনির্বাণ মজুমদারের মন্তব্য, “মা-বাবারা বাচ্চাকে ঠেসে খাওয়াচ্ছেন। পিৎজা, বার্গার, কোল্ড ড্রিঙ্কস, চিপ্স চাইলেই এসে যাচ্ছে! এ দিকে তার শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে না। খেলার জায়গা, বা সুযোগ কোনওটাই নেই! ফল হচ্ছে মারাত্মক।’’
|
|
সুতরাং গোড়াতেই সাবধান হতে হবে। যেমন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শ, “বাচ্চার ওজন অত্যধিক হলে এবং বাবা কিংবা মায়ের ডায়াবেটিস থেকে থাকলে দু’বছর অন্তর শিশুটির ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা উচিত। যদি তার ঘাড়ের পিছনে, বগলে বা কুঁচকিতে কালো দাগ থাকে, অল্পে হাঁফিয়ে পড়ে, কাজে উৎসাহ কম থাকে, তা হলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো দরকার। কারণ, এগুলো ডায়াবেটিসের উপসর্গ।”
শুধু শিশু-কিশোর নয়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে বহু তরুণ ও যুবক এই রোগের গ্রাসে পড়ছেন। চিকিৎসক মহলের মতে, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যে ধরনের কাজে অভ্যস্ত, তাতে কায়িক পরিশ্রমের সুযোগ কম, পাশাপাশি ফাস্ট ফুড খাওয়ার সুযোগ ও প্রবণতা বেশি। যা ডায়াবেটিস ‘আগ্রাসনের’ পক্ষে আদর্শ। ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতাবৃদ্ধির প্রয়াসে নিয়োজিত এক সংগঠনের পক্ষে ইন্দ্রজিৎ মজুমদার বলেন, “রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি আমরা কাউন্সেলিংয়ে খূব জোর দিই। ন্যাশনাল আরবান ডায়াবেটিস সার্ভেতে কলকাতা-সহ দেশের ছ’টি বড় শহরে ১১২১৬ জনের উপরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, ১২.৪% রোগে আক্রান্ত। প্রি-ডায়াবেটিক পর্যায়ে ১৪%। সচেতনতার অভাবেই এঁরা ওই বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছেন।”
মহিলাদের ক্ষেত্রে কাদের ঝুঁকি বেশি?
চিকিৎসকদের বক্তব্য: ওজন বেশি হওয়া বিপজ্জনক তো বটেই। পাশাপাশি ‘পলিসিস্টিক ওভারি’র সমস্যা থাকলেও ডায়াবেটিসের আশঙ্কা থাকে। এন্ডোক্রিনোলজিস্ট আশিস বসুর কথায়, “বহু মহিলা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। কিন্তু প্রসবের পরে সমস্যাটা চলে যায় বলে ওঁরা অনেকে খাওয়া-দাওয়ায় সাবধান থাকেন না। বছরে এক বার রক্ত পরীক্ষাও করান না। হুঁশিয়ার না-থাকার খেসারত পরে অনেককেই দিতে হয়।” |
|
|
|
|
|