রাত ১১টা ১৫। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্গানগর সেতুর কাছে দাঁড়িয়ে একটি ইন্ডিকা। সামনে-পিছনে ইন্ডিকেটর জ্বলছে শুধু। রাস্তায় অবশ্য আর কোনও আলো নেই। চার দিক অন্ধকার।
পনেরো মিনিট পার। কেন গাড়িটি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার খোঁজ করতে কোনও টহলদার পুলিশের দেখা নেই। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে এক যুবক এসে গাড়িটি চালিয়ে চলে গেলেন।
রাত ১২টা ১৫। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের বরাহনগর স্টেশন সংলগ্ন আন্ডারপাসের কাছে তখনও ছোট একটি ধাবা খোলা। টিমটিম করছে আলো। দ্রুত গতিতে মোটরবাইক, গাড়ি এসে থামছে সেখানে। সেই যাতায়াত চলল বেশ রাত পর্যন্ত। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গভীর রাত পর্যন্ত এলাকায় এমন কয়েকটি দোকানে চা-টোস্ট-ওমলেট থেকে শুরু করে নেশার সামগ্রীও মেলে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে বিভিন্ন ধরনের মানুষের আনাগোনা।
রাত পৌনে ১টা। |
অন্ধকার রাস্তায় সামনের আলো জ্বালিয়ে এই ফাঁকা
গাড়িটিকে রেখে গেলেন, তা জিজ্ঞেস করার কেউ নেই। |
বিমানবন্দরের আড়াই নম্বর গেটের কাছে এক্সপ্রেসওয়ের মুখেই পুলিশের কিয়স্ক। ভিতরে অন্ধকার। বাইরেও কোনও পুলিশ নেই। কিয়স্কের জানলা দিয়ে টর্চের আলো ফেলে দেখা গেল, ভিতরে রয়েছে দুটো চেয়ার ও কিছু ‘নো এন্ট্রি’ লেখা বোডর্র্। দরজার বাইরে থেকে ছিটকিনি তোলা। যে রাস্তায় একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে, সেই বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গভীর রাত পর্যন্ত ঘোরার পরে একটাই প্রশ্ন জাগে, পুলিশ কোথায়? গত কয়েক মাসে এই এক্সপ্রেসওয়েতেই উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু দেহ। পুজোর ঠিক আগেই গাড়ির মধ্যে মেলে বেসরকারি কলেজ-কর্তা সুপ্তেন্দু দত্ত ও তাঁর চালকের গুলিবিদ্ধ দেহ। সেই জোড়া খুনের পরে রাতের এক্সপ্রেসওয়েতে নজরদারি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবু পুলিশের যে টনক নড়েনি, তা পরিষ্কার।
বিমানবন্দরের আড়াই নম্বর গেট থেকে বালি ব্রিজ পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের সাড়ে আট কিলোমিটারের মধ্যে পড়ে পাঁচটি থানা বিমানবন্দর, দমদম, নিমতা, বেলঘরিয়া ও বরাহনগর। পাঁচটি থানার অফিসারদেরই দাবি, রাতে তাঁদের একটি করে টহলদার ভ্যান থাকে। অর্থাৎ, হিসেব মতো রাতে মোট পাঁচটি ভ্যান রাস্তায় থাকার কথা। কিন্তু, একটিমাত্র টহলদার ভ্যান চোখে পড়ল বেলঘরিয়া স্টেশনের আন্ডারপাসের কাছে। গাড়িটি থেকে নেমে কয়েক জন পুলিশকর্মী নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। আর কোথাও পুলিশের দেখা মেলেনি। |
‘আতঙ্কের জায়গা’ বলে পরিচিত সব ক’টি জায়গাই অন্ধকারে ঢাকা। একটিও আলো জ্বলে না বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে। যে জায়গায় সুপ্তেন্দু ও তাঁর চালকের দেহ মিলেছিল, সেই উত্তর বাদরা বাসস্টপটিও অন্ধকার। কাছেই ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে একটি গাড়ি। কেন? প্রশ্ন করার সাহস নেই কারও। মাঠকলের কাছে যাত্রীদের নামিয়ে গাড়ি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা হামেশাই ঘটছে।
রাতে এই পথে ট্রাক ছাড়া অন্যান্য যানবাহনও চলে। যশোহর রোড ধরে সরাসরি বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে গঙ্গার ওপারে বালি, উত্তরপাড়ায় যাওয়া যায় বলে অনেক অফিসযাত্রীই এই রাস্তা ব্যবহার করেন। অনেক শাট্ল ট্যাক্সিও চলে। আবদুল রহমান নামে এক ট্যাক্সিচালক বলেন, ‘‘এতটাই নির্জন রাস্তা যে, সাহায্যের জন্য কেউ হাত দেখালেও দাঁড়াই না। রাত দশটার পরে এই রাস্তায় গাড়ি চালানোর সাহস পাই না।’’
এক্সপ্রেসওয়ের ধার ঘেঁষে রয়েছে জনবসতি। উত্তর বাদরার এক বাসিন্দা বললেন, “আগে জোরে আওয়াজ শুনলে আমরা রাস্তায় উঠে দেখতাম দুর্ঘটনা হল কি না। এখন সাহস করি না।’’ স্থানীয় চায়ের দোকানের এক কর্মীর কথায়, ‘‘চোখ-কান বুজে পেটের দায়ে দোকান চালাই। রাতে নাকের ডগায় গাড়ি ছিনতাই হলেও যাই না। যখন-তখন গুলি চালিয়ে চলে যাবে দুষ্কৃতীরা। কেউ তো ধরার নেই!’’
ওই এক্সপ্রেসওয়ের ধারে বেশ কয়েকটি আবাসনও তৈরি হয়েছে। তারই একটির বাসিন্দা সমীরবরণ সাহা বললেন, ‘‘আমাদের আবাসনের প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতে হলে এই রাস্তা পেরিয়েই আসতে হয়। তা করতে গিয়েই মাস কয়েক আগে এক মহিলার হার ছিনতাই হয়েছে। তা ছাড়া, ট্রাকগুলো এমন ভাবে আবাসনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে যে, দুর্ঘটনাও ঘটে।’’
উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্যের অবশ্য দাবি, “আগের তুলনায় বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন অনেকটাই ভাল। প্রতিটি থানার একটি করে গাড়ি ওই রাস্তায় ঘোরে।” তা হলে রাত ১টা পর্যন্ত মাত্র একটি টহলদার ভ্যান চোখে পড়ল কেন? চম্পকবাবুর দাবি, “সন্ধ্যা ছ’টা থেকে ভোর ছ’টা পর্যন্ত রোজই টহলদার ভ্যান থাকে।” তিনি আরও বলেন, “শুধু টহলদার ভ্যানই নয়, থানার মোটরসাইকেল নিয়েও ওই রাস্তা দিয়ে টহলদারি এবং গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে সিসিটিভি বসানোর পরিকল্পনা আছে। বরাহনগরের কাছে তিনটে সিসিটিভি লাগানো হয়েছিল। সেগুলো খারাপ হয়ে গিয়েছে। সেগুলো দ্রুত সারিয়ে ফেলা হবে।’’ |