১৫ কার্তিক ১৪১৯ বৃহস্পতিবার ১ নভেম্বর ২০১২
পুজো ও পার্বণ...
পরিবর্তনের পুজো ওড়িশায়!
দুর্গা নয়, অসুর নিধন করে শিব
মা এলেন; চলেও গেলেন। আনন্দের চারটি দিনের শেষে বিমর্ষ বাঙালি এখন শস্যপূর্ণা বসুন্ধরার অপেক্ষায়— দেবী নৌকায় চেপে ‘কৈলাস’ ফিরে গেলেন যে! যেখানে বাঙালির বাস, সেখানেই দুগগা-আরাধনা। বিদেশ ও বঙ্গদেশের পাশাপাশি এ দেশেরও সর্বত্র বাঙালিরা অতি নিষ্ঠা ও ধুমধামের সঙ্গে প্রতি বছর শারদোত্সব পালন করে।

এ বছরও ওড়িশাতে জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। শাক্ত মতে ষোলো দিন ও সাধারণ মতে দশ দিন ধরে আচারবিধি মেনে চলা হলেও বাঙালি উত্সবমুখর হয় শেষ চার দিনই। ওড়িশায় দুর্গাপুজোর ইতিহাস কিন্তু বেশ প্রাচীন। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী চেদি সাম্রাজ্যের রাজা সুরথ ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু করেন শারদোত্সব। তবে আধুনিক দুর্গাপুজোর সূচনা গঙ্গ সাম্রাজ্যের চোড়গঙ্গ দেবের হাত ধরে, একাদশ শতকে। মাটির তৈরি মহিষমর্দিনী বা গোসানি আরাধনা করেছিলেন তিনি। এই কারণেই স্থানীয় ভাবে শারদোত্সবকে ‘গোসানি যাত্রা’ও বলা হয়। বস্তুত এই সময় থেকেই দেবী দুর্গার সঙ্গে মহাদেবের ‘মর্ত্যে’ আগমন বাধ্যতামূলক হয়। অন্য আর একটি মত অনুযায়ী ১৫১২ থেকে ১৫১৭ সালের মধ্যে গজপতি প্রতাপরুদ্র দেবের রাজত্ব কালে চৈতন্যদেব কটকে এসে বিনোদবিহারী মন্দিরে দেবীর অকালবোধন করেন। তবে এখনকার প্রাচীনতম দুর্গাপুজোর সূচনা ঘটে ঘোষ পরিবারের হাত ধরে আজ থেকে চারশো বছর আগে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারি জনৈক ঘোষ মহাশয় হাওড়ার কোতরং থেকে ভদ্রকের রামেশ্বরপুরে গিয়ে সেই পুজোর সূচনা করেন।
দোলমুন্ডাইয়ের প্রতিমা

এখানকার পুজোর আর এক বিশেষত্ব—
শিবের প্রাধান্য। শিব-ই বধ করে অসুর।
যস্মিন দেশে যদাচার— প্রবাদটি ওড়িশার পুজোর আচারবিধির সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে যায়। বাংলার পুজোর সঙ্গে সে রীতির ফারাক চোখে পড়ার মতো। ধামসা, মাদল, ঢাক ইত্যাদি চিরাচরিত বাদ্যযন্ত্রের সমবেত ‘আহ্বানে’ ষষ্ঠীর সকালে দেবী বোধন হয়। এর পর ‘বেল বরণ’ বা ‘কল্পারম্ভ’।

সপ্তমীর নবপত্রিকা স্নান কিছুটা রূপ পরিবর্তন করে এখানে পরিচিত ‘মহাস্নান’ নামে।

প্রাচীন কাল থেকেই অষ্টমীর কুমারীপুজোয় পশুবলি প্রথার প্রচলন ছিল। তবে এখন সে প্রথাকে সরিয়ে বইতি-কাখারু (কুমড়ো) বলিই বেশি প্রচলিত এ রাজ্যে। ওই দিন স্থানীয় মহিলারা পালন করেন ‘ভাইজিউতিয়া’। সারা দিন উপবাসের পর দেবী দুর্গার কাছ থেকে ভাইদের দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা করেন তাঁরা।

নবমীর দিন রাজ্য জুড়ে বিশেষ ‘ভোজ’-এর রেওয়াজ আছে। এ দিন স্থানীয়রা বিভিন্ন আমিষ ও নিরামিষ ‘ওড়িয়া পদ’ রান্না করে বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গে পালন করেন ‘নবমী ভোজি’।

দশমীতে দেবীকে দহি-পাখাল (দই ও ভাতের বিশেষ মিশ্রণ), পিঠে, বিভিন্ন মিষ্টি ও মাছ ভাজা নিবেদনের রীতি প্রচলিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভাসান হয় দ্বাদশী বা ত্রয়োদশীর দিন। ভাসানে মাইকের ব্যবহার এখানে বেশ কম। তবে এই তথ্যে পরিবেশবিদদের আনন্দিত হওয়ার বিশেষ কারণ নেই। মাইক না থাকলেও তার ‘অভাব’ পূরণের জন্য আছে তাসা পার্টি ও লাইভ ব্যান্ড। কিছু পুজোর শোভাযাত্রায় মানুষই আলো বহন করে নিয়ে যান। গাড়ির ব্যবহার এখানে ব্রাত্য।
ভুবনেশ্বরের ঘরপোড়া পুজোর গেট ও প্রতিমা
উপকূলবর্তী ওড়িশায় দশহরা উপলক্ষে ‘ষাঁড় দৌড়’-এর প্রচলন আছে। শতাব্দীপ্রাচীন এই দৌড়ে ৫০টি ষাঁড় অংশ নেয়। এই বিশেষ দিনটির জন্য সারা বছর ধরে ষাঁড় লালন-পালন করেন স্থানীয় মানুষ। এ দিন সালংকারা ষাঁড়গুলির সামনে একটি জ্যান্ত মাছ ফেলে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। দৌড়ের শেষে এক মহাভোজের আয়োজন করা হয়।

দক্ষিণ ওড়িশার জেপুরে শারদোত্সবের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বহু বছর আগে দশমীর দিন সংলগ্ন গ্রামগুলোর মোড়লরা বহু উপঢৌকন নিয়ে রাজবাড়িতে উপস্থিত হতেন। সেখান থেকেই রাতে বের হত ‘পাতুয়ারা’— দশেরা উপলক্ষে বিশেষ শোভাযাত্রা। এখন সেই জৌলুস না খাকলেও ‘পাতুয়ারা’ দেখতে হাজির হন বহু পর্যটক। সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত এক ঐতিহাসিক নথি থেকে তত্কালীন জেপুর রাজত্বের শারদোত্সবের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। জাঁকজমকপূর্ণ দশেরা শোভাযাত্রার সামনের দিকে থাকত আটটি হাতি ও কুড়িটি ঘোড়া। এর পিছনে থাকত শুধুমাত্র এই উত্সবের জন্য আনা বিশেষ ‘বাহিনী’। বাহিনীর ‘অস্ত্র’ নাগাড়া, তুরি, বীরাকাহালি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র। ষোলো দিন ধরে চলা এই অনুষ্ঠানের শেষে গ্রামের মোড়লদের সম্মানিত করতেন রাজা। শুধুমাত্র আড়ম্বরের উদ্দেশ্যেই নয়, গ্রামের মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করার এ ছিল এক বিশেষ প্রয়াস।

ওড়িশার সাংস্কৃতিক রাজধানী কটকের প্রথম সর্বজনীন পুজো শুরু হয় কাজি-বাজার এলাকায়, প্রায় ১৮০ বছর আগে। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র কটকেই পুজোর সংখ্যা ১৬২। এখানকার বেশির ভাগ পুজোই বিভিন্ন বাজার সমিতির পরিচালনায় হয়। বাঙালির অতি পরিচিত প্যান্ডেলের ব্যবহার এখানে বেশ কম। বেশির ভাগ পুজোই হয় স্থায়ী মণ্ডপে। পুজো কমিটিগুলোর মধ্যে গেট নিয়ে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা। এক একটা গেট এক একটা পুজোর পরিচয় বহন করে। এখানকার পুজোর আর এক বিশেষত্ব— শিবের প্রাধান্য। প্রায় এক তৃতীয়াংশ পুজোর ক্ষেত্রে ‘অলস’ দুর্গার পাশে ‘কর্মঠ’ শিবের উপস্থিতি লক্ষনীয়। শিব-ই বধ করে অসুর। কটকের মালগোডাউন, বরফকল প্রভৃতি পুজোয় এই ‘পরিবর্তন’ লক্ষনীয়।

ভুবনেশ্বর স্টেশন
বাজারের রুপোর চালি

চৌধুরী-বাজার পুজো
কমিটির সোনার চালি
কটকের পুজোর আর এক আকর্ষণ দেবীর সালংকারা চালি। এ ক্ষেত্রে চৌধুরী-বাজার পুজো কমিটির নাম করতে হয় সবার আগে। একমাত্র এই পুজো কমিটির আছে নিজস্ব সোনার চালি। প্রায় পঁচিশ ফুটের চালিতে আছে চার কিলোগ্রাম সোনা। তবে রুপোর চালির পুজোর সংখ্যাও কম নয়, প্রায় বারো। মঙ্গলাবাগ, দোলমুন্ডাই, কলেজ স্কোয়্যার, চাউলিয়াগঞ্জ, চাঁদনি চকের পুজোও উল্লেখযোগ্য।

কটকে দশমীতে বিসর্জন প্রায় হয় না বললেই চলে। শোভাযাত্রার জৌলুস বজায় রাখতে ত্রয়োদশী পর্যন্ত চলে বিসর্জন। চারিদিকে শুধু থাকে একটাই রব— ঠাকুর আসিব কেবে, ঠাকুর যিবে বিসর্জন।
ছবি: লেখক
পুজোর বিশেষ কিছু লেখনী
প্রবাসে বাঙালির বারো মাসে বাইশ পাবন
‘আমার বিজয়ার প্রণাম নিও মা’
দীপালিকায় জ্বালাও আলো
রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি চিঠি পুরনো সংস্করণ