...খলনায়ক ও একটি গল্প
লকাতা ছড়িয়ে রয়েছে টেমস নদীর দু’কূল জুড়ে, এখানে ওখানে। আজ যেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া রোড, সেখানেই শুরু হয়েছিল একটি রাজকাহিনির। এখানে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা ছাউনি ছিল— ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ভাইসরয়রা ট্রেনিং নিতে আসতেন, মাঠে ক্রিকেট খেলতেন, দোকান-বাজার করতেন। শহরটার আনাচে-কানাচে কলকাতা ছেয়ে রয়েছে একেবারে। ক্যানিং, ক্লাইভ, এলগিন, আউট্রাম... নামগুলো যে কত্ত জন্মের চেনা! কিন্তু আজকের গল্প শহরের অলিগলি বা রাজপথ নিয়ে নয়, এক ‘খলনায়ক’কে নিয়ে। রানির শহরের এই মানুষটি সারা জীবন কলকাতাকে বয়ে চলেছেন। ইতিহাস তাঁকে খলনায়ক বলে চিহ্নিত করেছে। আমরা তাকে ঘৃণা করেছি। তাঁর নিজের দেশের মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাঁর সাফল্যকে নিজের ভেবে ভোগ করতে তাদের দ্বিধা হয়নি!

শ্রপশায়ার মিউজিয়ামে ইতিহাসের সঙ্গে দু’দণ্ড কথোপকথন নিয়ে গেল সিরাজের আমলের মুর্শিদাবাদে, কলকাতায়, রবার্ট ক্লাইভের দুরন্ত ঘরকন্নার একান্ত অন্দরমহলে।

শ্রিউসবেরি মিউজিয়ামে রাখা আছে একটি সোনা-রুপোর কাজ করা পানপাত্র। ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৭৬০ সালে এই পানপাত্রটি রবার্ট ক্লাইভ শ্রিউসবেরি কাউন্সিলকে উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন। অতীত কথা বলে যায় মৃদু স্বরে— কখনও শোনা যায় কামানের গর্জন বা পিস্তলের আওয়াজ, কখনও বা নবাবের হারেম থেকে ভেসে আসা নাচঘরের রুমঝুম তালের সঙ্গে মিশে থাকে সুন্দরীদের সুর্মা টানা কাজল চোখের মায়াবী দৃষ্টি। কে জানে কোন আয়েশা বেগম, নাজমা বেগম বা তবস্সুম বেগমদের হাতের ছোঁয়া, ঠোঁটের স্পর্শ আজও লেগে আছে ওই সোনা-রুপোর কাজ করা সুরাপাত্রে।

ধরে নেওয়া যাক আমরা এখন আছি ১৭৫৫ সালের কলকাতায়। পলাশির আমবাগান অবধি যাওয়ার আগে ক্লাইভের ঘর-গেরস্থালির একটা ‘স্ন্যাপশট’ নিতে হবে বৈকি! আলাপ করতে হবে ফুলপরীর মতো দুধসাদা দেবশিশু রেবেকার সঙ্গে, রিটার সঙ্গে, পারুর সঙ্গে। এই নামগুলো অবশ্য আমার দেওয়া। এদের কথা তো ইতিহাসে লেখা হয়নি। ইতিহাস বইয়ের পাতা জুড়ে যে সব নাম চলাফেরা করে— অ্যাডমিরাল ওয়াটসন, মেজর কিলপ্যাট্রিক কিম্বা জাফর আলি খান— তাদের আড়ালে যে অন্ধকার রয়েছে তাকে ছুঁয়ে নিতেই আজও কলকাতা জেগে আছে তিন শতাব্দী পরে।

শ্রপশায়ারে ক্লাইভ-ঘরের এক কোণায় রয়েছে বিশাল একটি তৈলচিত্র— সপরিবারে ক্লাইভের এক উত্তরসূরি এবং সঙ্গে একটি বাঙালি মেয়ে। ছবির লেবেল বলছে ‘ইন্ডিয়ান মেড’ আর মন বলল, আমিই সেই মেয়ে। সুরাপাত্র, খাঁটি সোনার দরবার সেট, ওয়াটসনকে উপহার দেওয়া মীর জাফরের সেই শিরস্ত্রাণ ব্রোচ... সব কেমন মনে করিয়ে দিল গত জন্মের কথা! রবার্ট ক্লাইভকে কথা দিয়েছিলাম, “আসছে শতাব্দীতে আসব ফিরে তোমার খবর নিতে।” ছবির মানুষটি যেন ক্লাইভের বংশধর নন স্বয়ং রবার্ট ক্লাইভ, তাঁর স্ত্রী মার্গারেট ওরফে রিটা আর সঙ্গে শিশুকন্যা রেবেকা। আমি সময় মানি না, কাল মানি না, সাল তারিখ ইতিহাস, তাও মনে নেই। শুধু মনে আছে, আমি-ই সেই মেয়ে। সেই মুহূর্তটা দেজাভ্যুঁ হয়ে জীবন্ত হয়ে উঠল ভিন্ দেশে ভিন্ শহরে শত শত বছর পরে— জশুয়া রেনল্ডসের ছবিতে যাকে ‘ভারতীয় পরিচারিকা’ বলা হয়েছে— ক্লাইভ জায়ার একমাত্র সখী— দূর বিদেশে আত্মীয়-বন্ধুহীন অকূলপাথারে আমিই ছিলাম তার একমাত্র ‘লাইফলাইন’।

কোনও ইতিহাস বইতে এই বাঙালি মেয়েটির নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ অনায়াসে সে দিনের সেই টালমাটাল ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারতাম আমি! ধরা যাক আমার নাম ছিল পারুল, ডাক নাম পারু।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্লাইভ সারা দিন ব্যস্ত। মাদ্রাজ থেকে বদলি হয়ে এসেছেন কলকাতায়। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন আর তিনি প্রাণের বন্ধু। দু’জনের এক লক্ষ্য— কিছু করে দেখাতে হবে। যে অবহেলায় তাঁরা দেশ ছেড়েছেন সেই প্রতিশোধ নিতে হবেই। এমন কিছু করতে হবে যাতে পৃথিবীর লোক তাঁদের চির দিন মনে রাখে। ক্লাইভ সারা রাত ঘুমোতে পারেন না। জানালার ধারে বসে বাবাকে চিঠি লেখেন, ভোর হলে সেগুলোকেই হাওয়ায় উড়িয়ে দেন। মার্গারেট খুব মিষ্টি মেয়ে, আর পাঁচটা সাদামাটা মেয়ের মতো রবার্টকে বোঝায়, “চলো এ বারে দেশে ফিরে যাই।” বব সোহাগ করে বলে, “একটু ধৈর্য ধরো মার্গারেট।” ক্লাইভের চোখ ভরে ওঠে। তাঁর মায়ের কথা মনে পড়ে। এমন সময় ঘোড়ার খটখট আওয়াজ হয়, আসে কোম্পানির অ্যাডমিরাল। বব রিটাকে আলতো চুমু দিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায়!
সে দিনও তেমন জানালার দিকে আনমনা চেয়ে বসেছিলেন মার্গারেট। গঙ্গার সামনের ঘাটে কে শুয়ে আছে যেন! দেখে তো মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। কাঁধে ও গালের এক ধারে বীভৎস ক্ষত। পোড়া দাগ। পরনের বসন আলুথালু, মেয়েটি প্রায় অজ্ঞান হয়ে আছে কিন্তু বেঁচে যে আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে গঙ্গা থেকে এক আঁজলা জল ছিটিয়ে দেন ঘুমন্ত মেয়েটির মুখে। দুর্বল গলায়, দুর্বোধ্য ভাষায় বিড়বিড় করে কী সব বলে মেয়েটি। ধীরে ধীরে রিটার হাতে ভর দিয়ে চৌকাঠে এসে বসে সে। জাতপাত-দেশকালের সব ব্যবধান এক নিমেষে দূর করে আমরা দু’জন সখী হয়ে যাই। রিটা আমাকে সাজিয়ে তোলে ধবধবে সাদা গাউনে, একরাশ ঘন কালো চুল বেঁধে দেয় চুড়ো করে, চন্দ্রমল্লিকা ফুল এনে গুঁজে দেয় খোঁপায়। গালের এক পাশের ক্ষতটা আর তেমন দেখা যায় না।

ধীরে ধীরে পরিবারেরই এক জন হয়ে উঠি আমি। সময়ে অসময়ে মার্গারেটকে গপ্পো শোনাতাম। আমাকে তো তোমরা সবাই চিনবে। ‘বাপের ঘরে খুব আদরে ছিলাম বছর দশ! কুলীন পিতা কূলের গোলে, ফেলে দিলেন বুড়ার গলে, হলাম পরের বশ!’ তার পর আর কী? বুড়ার মরণ, অন্তর্জলি, চিতা ভেঙে জলে ঝাঁপ! নাটক-নভেলে যেমন হয়! কিন্তু এ ছাড়া আর কী উপায় ছিল আমার, কিংবা মার্গারেটের অথবা জশুয়া রেনল্ডসের, যিনি ছবিটি এঁকেছিলেন। তখনকার গেরস্ত ঘরের বৌ-ঝিয়েরা কি এমনিতে সাগরপারের ম্লেচ্ছ রমণীকে এ ভাবে আপন করে নিতে পারত?

এমনি করেই দিন কাটছিল সুখে-দুঃখে। এক দিন ভোরে দমদমার বাগানবাড়িতে হইহই করে হাজির হল মেজর কিলপ্যাট্রিক। ডিসেম্বরের কুয়াশা ঢাকা সকাল। কলকাতা নয়, এ যেন ইংল্যান্ড। এই হোম ওয়েদারে রবার্ট ক্লাইভের খুব মা কে মনে পড়ে। কলকাতা তাকে অনেক দিয়েছে। কত অপমান সয়ে সে চলে এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানি হয়ে। বহু লড়াই করে আজ সে কর্নেল। এখনও অনেক পথ বাকি। অনেকটা! অপেক্ষা করছিল কিলপ্যাট্রিকেরই। তারা সৈন্যদল নিয়ে আসছে। কিন্তু বড় দেরি করছে তারা! কেন?— জাহাজ খারাপ হয়েছিল মাঝপথে। থামতে হয়েছিল সেশেলসে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, ধীরে ধীরে দু’ একটা তারা ফুটে উঠছে, মেজর কিলপ্যাট্রিক হন্তদন্ত হয়ে পায়চারি করছেন সমুদ্রের তীরে, দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে কপালের ভাঁজে, এমন সময় পায়ের কাছে ঠান্ডা স্পর্শে চমকে ওঠেন! কী যেন একটা নড়াচড়া করছে! একটু ঝুঁকে নিচু হয়ে দেখেন চার চারটে কাছিমের ছানা! দলছুট হয়ে পড়েছে। অসীম মমতায় কিলপ্যাট্রিক আঙুল ছুঁইয়ে দেন কাছিমছানাটির গলায় পিঠে পায়ে, লঘু স্বরে জিজ্ঞেস করেন, “উইল ইউ কাম উইথ মি ডার্লিং?” অশান্ত সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে কাছিমছানা ঘাড় নাড়ে!

কিলপ্যাট্রিক রবার্ট ক্লাইভের দিকে তাকান সরাসরি। অসীম আত্মবিশ্বাস! ক্লাইভ বুকে জড়িয়ে নেন সেনানীকে। “রবার্ট দেখ তোমার জন্যে কী এনেছি!”—ঝুলিটা খুলে দিতে ধীর গতিতে বেরিয়ে আসেন কূর্মাবতার। ঘরের ভিতর থেকে দৌড়ে এলাম আমি, রিটা আর শিশু রেবেকাও! ক্লাইভের সংসারে নতুন অতিথি!

রবার্ট আমাকে বললেন, “পারুল তোমার অতিথিকে কী বলে ডাকি?” আমাকে ভাবতে হয় না একটুও, তুলসীতলার মাটি ছুঁইয়ে দেই ওর পিঠে, গলায় আঁচলটা জড়িয়ে দু’হাতে প্রণাম করি। দৈববাণী হয় মনের মধ্যে, “জয় অদ্বৈত মহাপ্রভু!” আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় দমদমার এই ছোট্ট বাড়িটায়!

গল্প শেষ! তবু শুনেছিলাম রবার্ট মারা যাবার আগে খুব একটা বাড়ি থেকে বেরোতেন না। মাঝেমাঝে রিটা দেখত বব আপনমনে বিড়বিড় করছে। তার মনে তখন সুর তুলেছে গরম ভাপ ওঠা ভাত, কুয়াশায় ঢাকা ফোর্ট উইলিয়াম, ডিহি সুতানুটি, দমদমার বাগানবাড়ি, কৃষ্ণচন্দ্রের সরপুরিয়া, কূর্মাবতার অদ্বৈত! সে আজীবন কলকাতার মানুষ! কিন্তু কেউ তাকে বুঝল না!

আত্মহত্যায় মৃত্যু! মৃতদেহের জায়গা জোটেনি তখনকার ইংল্যান্ডে। রাতারাতি কবর দেওয়া হয়েছিল তাই একফালি মাটিতে, তার নাম লেখা নেই! কিন্তু সেই নামখানি জড়িয়ে রেখেছে কলকাতা ও লন্ডনের ইতিহাসকে।

পারুর মনে শুধু একটিই প্রশ্ন— পলাশির যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভ জয়ী না হয়ে যদি নবাব জয়ী হতেন তবে ভারতবর্ষের ইতিহাসটা ঠিক কেমন হত?

লন্ডনের একটি ক্যাথলিক বয়েজ হাইস্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষিকা। হাওড়ার মেয়ে, যাদবপুরের প্রাক্তনী— এই পরিচয়টুকুই খুব প্রিয়। সংসার সামলে বাকি সময়টুকু ভাগ হয়ে যায় বাগান সাজানো থেকে যত্নআত্তিতে, রান্নাবান্নায় আর অতিথি আপ্যায়নে।
ছবি: লেখক

এই সংখ্যায় পাঠকের কলমের অন্য দুটি লেখা
কাল, আজ ও কাল দোদুল দোলে ঝুলনে
 
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.