|
|
|
|
|
|
এই শহরেই হারাই যদি... ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়
আবৃত্তিকার |
|
|
“আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। শহরে ছ্যাকরা গাড়ি ছুটছে তখন ছড় ছড় করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড় বের করা ঘোড়ার গাড়ির পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না। রয়ে বসে দিন চলত।”—
রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় কলকাতা এই রকমই ছিল। এখন মানুষের সময় নেই— রয়ে বসার দিন চলে গিয়েছে কবে কে জানে!
আমার জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা কলকাতায়। আমার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতা— সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে এই শহর; এই শহরের মানুষজন। আমার শৈশব যৌবনের দিনগুলো কেটেছে বেলেঘাটার ভাড়া বাড়ি থেকে বিধাননগর হাউজিং-এর ফ্ল্যাটবাড়িতে। বেথুন স্কুল ও কলেজে আমার লেখাপড়া। আর উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের নেতাজির মূর্তি থেকে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস অবধি বিচরণ।
স্কুল থেকে সহপাঠিনীরা মিলে মানিকতলা অবধি হেঁটে বিধাননগরের বাস ধরতাম। এই পথ হাঁটার আনন্দটাই ছিল অন্য রকম। রোজ একই পথ ধরে হাঁটতাম কিন্তু রোজই মনে হত এই পথটুকুতেই কত বৈচিত্র্য। কত মানুষজন, কত রকম পোশাক-আশাক। কত দোকানির পসরা। কত বিচিত্র শব্দ। মাঝে মাঝে আবার নতুন পথও খুঁজে নিতাম। মানিকতলার কোনও একটা দোকানে ঢাকাই পরোটা পাওয়া যেত, মুচমুচে। ছোলার ডাল দিয়ে খেতে কী যে ভাল লাগত! আর অন্য একটা দোকানে লস্যি খেতাম মাঝে মাঝে দল বেঁধে। স্কুলের পাশেই বসন্ত কেবিন। হেদুয়ার গায়ে। কলেজে ঢোকার আগে ওই কেবিনে গিয়ে বসার অনুমতি ছিল না। |
|
বন্ধুদের জন্মদিনে মাঝে মধ্যে হেঁটে চলে যেতাম শ্যামবাজারের মোড়ে গোলবাড়ির মাংস-পরোটা খেতে। একটু বড় হয়ে বই পাড়া— কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের কাছে শরবতের দোকানটিও বড় প্রিয় ছিল আমার।
আসলে কলকাতা তো বৈচিত্র্যময় শহর। এত পরস্পরবিরোধিতার সমন্বয় সাধারণত দেখা যায় না। অপরিমিত ঐশ্বর্য, সীমাহীন দারিদ্র, আকাশফোঁড়া অট্টালিকা, ধুলোমাখা ঝুপড়ি, পাতাল রেল থেকে মানুষ টানা রিকশা— এই সব নিয়েই কলকাতার চরিত্র, আমার শৈশব থেকে প্রায় একই রকম আছে।
কলেজ জীবনে দেখা কিছু সিরিয়াস ছবি তথা আর্ট ফিল্মে কলকাতাকে পেয়েছি বেশ উজ্জ্বল ভাবেই। ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’, নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ‘কলকাতা-৭১’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘পদাতিক’, ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবিগুলোতে পেয়েছি কলকাতাকে। আর কয়েকদিন আগে ‘কহানি’তেও দেখলাম সেই একই কলকাতাকে। বিশ্বায়নের হাওয়ায় অনেক ঝকঝকে স্মার্ট কিন্তু একই রকম আন্তরিক।
‘মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
না, না, পাহাড় অরণ্য নয়,
নয়কো মরু তেপান্তরে,
হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে,
এই শহরে’...
কলেজ জীবনে প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই কবিতাটি খুব প্রিয় ছিল আমার। মাঝে মধ্যেই বন্ধুদের শোনাতাম। আর শোনাতাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্মৃতির শহর’ থেকে অনবদ্য কিছু লাইন। কখনও শঙ্খ ঘোষের ‘বাবুমশাই’। আজও এই সব লেখার মধ্যে আমার শৈশব, প্রথম যৌবনের গন্ধ পাই। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে এই শহর ঘিরেই আমার পেশার জীবন। স্বীকৃতি দিল এই শহরই, আমার প্রিয় কলকাতা। তারই হাত ধরে পৃথিবীর মানুষের কাছে বাংলার সংস্কৃতি পৌঁছে দেওয়া— এটাই আজ চরম বাস্তব। কিন্তু কেন জানি না, একটু পিছনের দিকে তাকালে সবই স্বপ্ন মনে হয়। সেই সব স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরি নিজের অজান্তেই।
এখন থাকি কলকাতার দক্ষিণে, গল্ফগ্রিনে। ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের আড়ালে এক টুকরো সবুজ শান্তি। এখানেই কবিতার সঙ্গে আমার নিভৃত জীবনযাপন। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই, ফিরে আসতে ইচ্ছে করে এখানেই। ‘এই শহরে হারাই যদি-
সে কি মিছে হারিয়ে যাওয়া
সে হারানোর মানে বুঝি নিত্য-নতুন
আপনাকে ঠিক খুঁজে পাওয়া”... |
|
|
|
|
|