দু’দফায় সাড়ে তিন ঘণ্টার শুনানি। সারদার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে রাজ্য পুলিশের তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে পাল্টা অভিযোগ, লোকসভা ভোটের আগে সিবিআই-তদন্তের দাবির পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছাড়া আর কিছু নেই। সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে আজ দিনভর আইনজীবীদের প্রবল বাগ্যুদ্ধের সাক্ষী থাকল সুপ্রিম কোর্ট।
এবং দিনের শেষে সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলল, পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ মানুষের থেকে সারদা গোষ্ঠী যে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলেছিল, তা কোথায় গেল? এক সপ্তাহের মধ্যে এ ব্যাপারে রাজ্যের রিপোর্ট তলব করে সর্বোচ্চ আদালতের হুঁশিয়ারি, এ বিষয়ে কোনও খোঁজখবর না-হয়ে থাকলে সেটাকে তদন্তের গাফিলতি হিসেবেই ধরা হবে। রাজ্য সরকারকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি টিএস ঠাকুর এবং বিচারপতি সি নাগাপ্পনের স্পষ্ট নির্দেশ: লগ্নিকারীদের থেকে যত টাকা তোলা হয়েছিল, তার হিসেব কষা হোক। এর মধ্যে সারদা গোষ্ঠীর বাজেয়াপ্ত করা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কিনতে কত খরচ হয়েছে, তা যাচাই হোক। বাকি অর্থ কোথায় গেল, সে সম্পর্কে তদন্তে পাওয়া তথ্যও রাজ্য পেশ করুক। “যদি সে তদন্ত না-হয়ে থাকে, তা হলে আমরা বলতে পারব যে, খামতি রয়েছে” মন্তব্য করেন বিচারপতি ঠাকুর।
অন্য দিকে রাজ্য আজ সুপ্রিম কোর্টে দাবি করেছে, সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্ত মসৃণ ভাবে এগোচ্ছে। মূল অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেন-সহ আড়াইশোরও বেশি অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। রাজ্যের দাবি: কলকাতা হাইকোর্ট এই তদন্তে কোনও খামতি খুঁজে পায়নি। কোনও লগ্নিকারীও আপত্তি তোলেননি। এখন সিবিআইকে তদন্তভার দিলে তদন্ত বিলম্বিত হয়ে অপরাধীদেরই সুবিধা হয়ে যাবে বলে মনে করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
যদিও রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) নিরপেক্ষ তদন্ত করছে কি না, তা বুঝতে চার্জশিটের নমুনা দেখতে চেয়েছে শীর্ষ আদালত। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এবং কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের জালিয়াতি তদন্তকারী সংস্থা (এসএফআইও)-র তদন্তে এ যাবৎ কী মিলেছে, তা-ও জানতে চেয়েছে। সিবিআই অন্যান্য রাজ্যে অর্থলগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারিতে কী তদন্ত করছে, তা-ও জানাতে বলা হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার মামলার পরবর্তী শুনানি।
সারদা-তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন প্রতিম সিংহরায়, আবু আব্বাসউদ্দিন ও সুব্রত চট্টরাজ। আজ সকাল পৌনে ১১টায় শুনানি শুরু হয়, চলে দুপুর একটায় মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি ইস্তক। আবেদনকারীদের তরফে কৌঁসুলি বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, সারদা গোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোয় ‘পন্জি স্কিম’ থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা তুলেছে। অত টাকা কোথায় গেল, তার হদিস নেই। শ্যামল সেন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছেন প্রায় ১৮ লক্ষ লগ্নিকারী। এঁদের টাকা ফেরত দিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোষাগার থেকে পাঁচশো কোটি টাকা ব্যয় করছে। অথচ সারদার তোলা টাকার সন্ধান করা হচ্ছে না। রাজ্য পুলিশের তদন্তে আমজনতার কোনও আস্থা নেই বলে অভিযোগ তুলে বিকাশবাবুর দাবি: মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত কুণাল ঘোষকে গ্রেফতার করা হলেও তাঁকে জবানবন্দি দিতে দেওয়া হচ্ছে না। “কুণালবাবু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রাজ্যের মন্ত্রী, তৃণমূলের নেতা, সাংসদ-সহ ১১ জনের নাম তুলেছেন। তারও কোনও তদন্ত হচ্ছে না। সে কারণেই সিবিআই-তদন্ত প্রয়োজন” সওয়ালে বলেন তিনি। বিকাশবাবুর অভিযোগ: সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই কুণালকে রাজ্যসভায় সাংসদ করা হয়েছিল। এবং চিট ফান্ডের সঙ্গে যুক্ত বলেই তৃণমূল সম্প্রতি কেডি সিংহ ও আসিফ খানকে রাজ্যসভায় মনোনীত করেছে বলে তিনি দাবি করেন।
বিচারপতি ঠাকুর জানতে চান, পন্জি স্কিম কী? বিকাশবাবুর ব্যাখ্যা: ইতালির যে ব্যক্তি এই ব্যবসার জনক, তাঁর নামেই এর নাম। শীর্ষ আদালতের কাছে বিকাশবাবুর বক্তব্য: সারদা গোষ্ঠীর প্রধান সুদীপ্ত সেন এই স্কিম থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছিলেন। পরে লগ্নিকারীরা টাকা ফেরত চাইতে শুরু করলে তিনি হরিদ্বার-দেহরাদূন-হলদোয়ানি হয়ে জম্মু-কাশ্মীরে পালিয়ে যান। সোনমার্গে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারপতি ঠাকুর মজা করে বলেন, “কেন ধরে নিচ্ছেন যে, উনি পালিয়ে গিয়েছিলেন? হয়তো উনি হরিদ্বার থেকে সোনমার্গে আধ্যাত্মিক শান্তির খোঁজে গিয়েছিলেন!” হাসতে হাসতে বিকাশবাবুর জবাব, “আমজনতার ক্ষোভের উত্তাপ টের পেয়ে শান্তি খুঁজতে গিয়েছিলেন।” বিধাননগর পুলিশের কমিশনার ও গোয়েন্দা-প্রধানও এ দিন সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।
রাজ্য সরকারের তরফে সিবিআই-তদন্তের দাবি খারিজ করতে আইনজীবী সিএস বৈদ্যনাথন যুক্তি দেন, সারদা-কাণ্ডে মোট ৩৮৩টি মামলা হয়েছে। ২৭৮টিতে চার্জশিট পেশ হয়ে গিয়েছে। মাত্র ১০৫টি মামলায় চার্জশিট বাকি। আগামী দু’মাসের মধ্যে তা-ও হয়ে যাবে। হাইকোর্টে প্রতি মাসে রিপোর্ট জমা দেওয়া হচ্ছে। সারদার ৯০% ব্যবসাই ছিল পশ্চিমবঙ্গে। রাজ্যের কৌঁসুলির দাবি, আইপিএস অফিসারদের নেতৃত্বে তদন্তকারী দল গঠন হয়েছে। তাঁরা অনেক দূর এগিয়েছেন। সিবিআই-কে এখন দায়িত্ব দিলে তদন্তকারীদের মনোবল ধাক্কা খাবে। এই মামলাটি পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “কংগ্রেস ও মার্ক্সবাদীরা একজোট হয়ে মামলাটি করেছে। কারণ, নির্বাচন সামনে। সিবিআই-তদন্ত করিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সারদা-গোষ্ঠীর কাজকর্ম আগের সরকারের জমানাতেই শুরু হয়েছিল।” বিকাশবাবুর রাজনৈতিক সংস্রব নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। অ্যালকেমিস্ট সংস্থার তরফে জানানো হয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর নেই। অকারণে মামলায় তাদের জড়ানো হচ্ছে।
বিচারপতি ঠাকুর জানতে চান, সিবিআই-তদন্তে রাজ্যের আপত্তি কোথায়? তাঁর বক্তব্য: রাজনীতি দেখে সুপ্রিম কোর্ট বিচার করবে না। জনতার টাকা কোথায় গেল, সেই তদন্ত সিবিআইকে দিলেও তার অর্থ এই নয় যে, রাজ্য পুলিশের তদন্তের সমালোচনা করা হচ্ছে, কিংবা রাজ্যের তদন্তকে পক্ষপাতদুষ্ট বলা হচ্ছে। “জনমানসে কিন্তু তেমনই বার্তা যাবে,’’ প্রতিক্রিয়া রাজ্যের কৌঁসুলির।
শুনে বিচারপতি বলেন, জনতা কী ভাববে তা দেখে নয়, ১৮ লক্ষ মানুষের কথা ভেবেই বিচার হবে। আদালতের একমাত্র লক্ষ্য, নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত নিশ্চিত করা। রাজ্যের কৌঁসুলি অভিযোগ তোলেন, ভোটের সময় একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার পেতেই সিবিআই চাওয়া হচ্ছে। বিচারপতি ঠাকুরের পাল্টা মন্তব্য, “যদি রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে, তা হলে সেটা তো এই কেলেঙ্কারিতেই হয়ে গিয়েছে!” বৈদ্যনাথনের যুক্তি, যে সব লগ্নিকারী টাকা হারিয়েছেন, তাঁরা কেউই আদালতের দ্বারস্থ হননি। আদালতের বক্তব্য: চাইলেই আবেদনকারীদের কৌঁসুলি এমন দশ জনের ওকালতনামা পেশ করতে পারেন। সিবিআই দায়িত্ব পেলে কী ভাবে তদন্ত করবে, কেন্দ্রের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল সিদ্ধার্থ লুথরার কাছে তা-ও জানতে চায় কোর্ট। লুথরা জানান, সিবিআইয়ের পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। রাজ্যের সাহায্য নিয়েই এমন তদন্ত করা হয়।
বিচারপতিরা প্রথমেই জানান, তাঁরা মামলার চূড়ান্ত রায় দিয়ে দিতে চান। তাই মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পরে বেলা তিনটেয় ফের শুনানি শুরু হয়। আবেদনকারীদের আর এক কৌঁসুলি অশোক ভান কড়া ভাষায় রাজ্যের সমালোচনা করেন। সুদীপ্ত সেনের চিঠির উল্লেখ করে তিনি জানান, তাতে কুণাল ঘোষ-মুকুল রায়-মদন মিত্র-সৃঞ্জয় বসুর মতো তৃণমূলের মন্ত্রী-সাংসদের নাম রয়েছে। ভানের দাবি, পুলিশ কুণালের উপরে চাপ তৈরি করায় তিনি স্বীকারোক্তি রেকর্ড করতে পারছেন না। সারদার মিডিয়া গোষ্ঠীর কর্মীদের বেতন-পিএফ না-মেটানোর অভিযোগ তুলে যিনি প্রথম এফআইআর করেছিলেন, তিনিও পিছু হঠছেন। ভানের বক্তব্য, সিবিআই কুণালকে হেফাজতে নিলেই তিনি তোতাপাখির মতো সব বলতে শুরু করবেন। দ্বিতীয় দফার শুনানিতে রাজ্যের তরফে নামেন দুঁদে আইনজীবী মুকুল রোহতাগি। সিবিআই-তদন্ত চাওয়া আবেদনকারীদের পরিচিতি নিয়েই প্রশ্ন তুলে তাঁর দাবি: পুরো আবেদনে কোনও তথ্য নেই, সবটাই সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টের ভিত্তিতে।
বিচারপতিরা অবশ্য জানিয়ে দেন, ভুক্তভোগীরা সুবিচার পাবেন এই আস্থা তৈরি করাটাই এখানে প্রধান বিচার্য। বিচারপতিরা চাইছিলেন, কাল ফের শুনানি হোক। কিন্তু রাজ্যের তরফে আবেদন করা হয়, সমস্ত তথ্য জোগাড় করতে এক সপ্তাহ লাগবে।
সেবি-কেও এই সব অর্থলগ্নি সংস্থার কাজকর্ম সম্পর্কে বক্তব্য জানাতে বলেছে শীর্ষ আদালত।
|
কোর্টের সওয়াল |
পশ্চিমবঙ্গে সারদা গোষ্ঠী যে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলেছিল, তা কোথায়? এক সপ্তাহের মধ্যে এই নিয়ে তথ্য দিতে হবে রাজ্যকে। সিবিআই তদন্তেই বা রাজ্যের আপত্তি কোথায়?
|
রাজ্যের জবাব |
সারদা কাণ্ডে ৩৮৩টি মামলার ২৭৮টিতে চার্জশিট হয়েছে। বাকিগুলিতেও শীঘ্রই হয়ে যাবে। তদন্তকারীরা অনেক দূর এগিয়েছেন। এখন সিবিআইকে দায়িত্ব দিলে তাঁদের মনোবল ধাক্কা খাবে। |
|