অপরিচ্ছন্ন, স্যাঁতসেঁতে ঘর। দিনের পর দিন সেই সব ঘর, সিঁড়ি কিছুই পরিষ্কার হয় না। সিঁড়ির কোণে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকে মদের বোতল, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ, গাঁজার কল্কে। বেশির ভাগ ঘরেই সূর্যের আলো ঢোকে না। জল থাকে না প্রায়শই। তাই আবাসিকদের অনেকের ভাল করে স্নানও হয় না বহু দিন। সিঁড়ির আলো নেই বেশির ভাগ জায়গাতেই। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে প্রায়শই চলে নানা অসামাজিক কাজকর্ম। আলাদা ভাবে হস্টেলের জন্য নিরাপত্তারক্ষীর ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা, তাঁদেরই মাঝেমধ্যে হস্টেলের দিকে নজর রাখতে বলা হয়।
শনিবার এসএসকেএম হাসপাতালে হস্টেলে এক ইন্টার্নের মৃত্যুর পরে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হস্টেলগুলিতে ঘুরে মিলল এমনই ছবি। কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফে বছরে এক বারও হস্টেল পরিদর্শন হয় কি না সন্দেহ। ফলে হস্টেলের ভিতরে ঠিক কী চলছে, তার খবর পৌঁছয় না কারও কাছেই। সব মিলিয়ে হস্টেলের হাল ভয়াবহ সর্বত্রই। শনিবার এসএসকেএমের ঘটনার পরে বিষয়টি সামনে এলেও এমন ঘটনা যে কোনও দিন যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকদের।
এসএসকেএমের এক শিক্ষক-চিকিৎসক জানিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতা। তাঁর কথায়, “সন্ধ্যার পর থেকে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হস্টেল দুই-ই একেবারে অন্য জগৎ। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গেলেই মদের ঝাঁঝালো গন্ধ। বেশির ভাগ ঘরই অন্ধকার। কখনও কখনও দরজা খোলা থাকলে ভিতরে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া নজরে আসে। রাত একটু বাড়লে হস্টেলের ঘরগুলোতে নরক-গুলজার!”
মেডিক্যাল কলেজগুলির হস্টেলের হাল যে তলানিতে এসে ঠেকেছে তা দীর্ঘদিন ধরেই উপলব্ধি করছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। হাসপাতালের উন্নয়নের পাশাপাশি হস্টেলগুলির হাল ফেরানোর ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আর্জিও জানিয়েছিলেন তাঁরা। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, হস্টেলের হাল ফেরানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝেই মুখ্যমন্ত্রীও এই খাতে অর্থ বরাদ্দ করছেন। বৃহস্পতিবার কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে মমতা জানিয়েছিলেন, ধাপে ধাপে ধাপে মেডিক্যাল কলেজগুলির হস্টেলের মান ফেরানো হবে। ওই দিন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের নতুন হস্টেলের শিলান্যাসও করেছিলেন তিনি। এ-ও জানিয়েছিলেন, ভাল চিকিৎসক তৈরি করতে হলে ভাল পরিবেশ দেওয়াটাও দরকার। দরকার বিনোদনের ব্যবস্থা করা। কারণ মেডিক্যাল পড়ুয়াদের বসবাসের মান উন্নত করাটা খুই জরুরি। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, এই মানের বিষয়টিই তলানিতে এসে ঠেকেছে বেশিরভাগ হস্টেলে। এসএসকেএমের ঘটনা তারই পরিণতি।
আর জি কর, কলকাতা মেডিক্যাল, এন আর এস, ন্যাশনাল সর্বত্রই মেডিক্যাল পড়ুয়াদের হস্টেল মানে নোংরা, দুর্গন্ধে ভরা পরিবেশ। এমন পরিবেশে থাকলে মানসিক অবসাদ আসাও স্বাভাবিক বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। ঘরে ঘরে নেশার আখড়া। মদ, গাঁজা, চরসকোনও কিছুই বাদ থাকে না সেখানে। কর্তৃপক্ষের কোনও নজরদারিই থাকে না। এমন কী সিঁড়ির বাল্ব কেটে গেলেও তা লাগানো হয় না মাসের পর মাস। কোনও ঘরের পাখা খারাপ হলে তীব্র গরমেও সেই পাখা বদলানো হয় না। আর জি কর মেডিক্যালের এক শিক্ষক-চিকিৎসক বলেন, “হাসপাতালে কোনও কিছু প্রয়োজন হলে রোগীকল্যাণ সমিতির টাকা থেকে তা তড়িঘড়ি কেনা যায়। হস্টেলগুলির অবস্থা না ঘরকা, না ঘাটকা। ফলে সেখানে কিছু প্রয়োজন হলে কী ভাবে তা কেনা হবে, তার নিষ্পত্তি হতেই বছর ঘুরে যায়।”
স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, হস্টেলের হাল ফেরাতে গেলে আগে হস্টেলের ফি কিছুটা বাড়ানো দরকার। মান্ধাতার আমলের মাসিক ১২ টাকার ফি এখনও চলছে। এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, “পড়ুয়াদের অভিভাবকেরা হস্টেলে এলে আঁতকে ওঠেন। তাঁরা আমাদের কাছে এসে বারবার বলেন, ‘টাকা লাগলে নিন, কিন্তু জায়গাটাকে বাসযোগ্য করুন।’ কিন্তু আমরা কী করতে পারি?”
এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র জানিয়েছেন, হস্টেলের হাল ফেরাতে সরকারকে তাঁরা নির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দেবেন। তার মধ্যে অন্যতম হল সার্ভিস চার্জ চালু করা। তিনি বলেন, “ওই টাকায় হস্টেল পরিষ্কার, আলো ইত্যাদির ব্যবস্থা হবে। নিয়মিত পরিষ্কারের ব্যবস্থা থাকলে সেটাও একটা পরোক্ষ চাপ হিসেবে কাজ করে। কারণ বাইরের লোক ঢুকলে মদের বোতল, সিরিঞ্জ তো তাঁরও নজরে পড়বে। বিষয়টা পাঁচকান হওয়ার ভয় থাকবে।” হস্টেলে নিয়মিত নজরদারি না রাখলে পরিস্থিতি শুধরোবে না বলেই তাঁর অভিমত।
বস্তুত, হস্টেলের হাল ফেরাতে গেলে, হস্টেলগুলিকে বসবাসের উপযুক্ত করতে হলে নিয়মিত নজরদারিটাই সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, বেশির ভাগ হস্টেলেই পরিকাঠামো বলতে কিছু নেই। হস্টেলের আলাদা অফিস নেই। হস্টেল সুপার হতে রাজি হন না কেউই। কোনও মতে জোর-জবরদস্তি হস্টেল সুপার করে দেওয়া হয় কাউকে। তিনি হস্টেলের কোনও খোঁজই রাখেন না। এমন কী বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, আবাসিকরা নিজেরাই জানেন না তাঁদের হস্টেলের সুপার কে। সমস্তটাই চলে অ্যাড-হক ভিত্তিতে। এমনকী, হস্টেল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখারও কোনও ব্যবস্থা নেই।
কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষের কথায়, “সমস্ত প্রচারের আলো হাসপাতালের উপরে থাকে। তাই হাসপাতালে পান থেকে চুন খসলেই গেল-গেল রব ওঠে। কিন্তু কলেজগুলো নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। যে কোনও মেডিক্যাল কলেজেই এসএসকেএমের ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে যে কোনও দিন।” |