|
|
|
|
বাড়ির চার জনকে খুন, গ্রেফতার দেওর-বৌদি
নিজস্ব সংবাদদাতা • মহিষাদল |
বাড়ির বড় ছেলের রাতে ডিউটি। সেই সুযোগে বউয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত দেওরের ‘ঘনিষ্ঠতা’র কথা জানাজানি হয়েছিল আগেই। গ্রামে সালিশি সভা ডেকে সতর্কও করা হয়েছিল দু’জনকে। সম্পর্কে তবু ছেদ পড়েনি। বিবাহ বহির্ভূত ওই সম্পর্কের জেরেই শ্বশুরবাড়ির চার জনকে তরোয়াল দিয়ে কুপিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠল বৌদি-দেওরের বিরুদ্ধে। গোটা ঘটনাটা নিজের চোখের সামনে দেখে থম মেরে গিয়েছে ওই বধূর সাত বছরের ছেলে।
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল থানার কালিকাকুণ্ডু গ্রামে শনিবার রাতের ওই ঘটনায় প্রথমে পুলিশ গ্রেফতার করে ঝর্না কুইল্যা নামে ওই বধূকে। রবিবার দুপুরে মেচেদা থেকে ধরা পড়েন ঝর্নার সম্পর্কিত খুড়তুতো দেওর জগন্নাথ ওরফে কৃষ্ণপ্রসাদ কুইল্যা। দু’জনের বিরুদ্ধেই খুনের মামলা রুজু হয়েছে। যে চার জনকে তাঁরা খুন করেছেন বলে অভিযোগ, তাঁরা হলেন, ঝর্নার শ্বশুর শ্বশুর রামপ্রসাদ কুইল্যা (৭৩), শাশুড়ি নিহারীবালা কুইল্যা (৬৩), দেওর অরুণ কুইল্যা (৩৮) এবং এক আত্মীয়া কল্পনা কুইল্যা (৫৫)। প্রত্যেকের শরীরেই ছিল একাধিক ক্ষতচিহ্ন। তিন জন ঘটনাস্থলে মারা গেলেও প্রায় কুড়ি মিনিট বেঁচে ছিলেন ঝর্নার শাশুড়ি। মহিষাদল গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি পুলিশ ও গ্রামবাসীকে সব জানান।
ঝর্নাকে রবিবার হলদিয়া এসিজেএম আদালতে হাজির করানো হলে তাঁর তিন দিন পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ হয়। জগন্নাথকে আজ, সোমবার আদালতে তোলা হবে। জেলার পুলিশ সুপার সুকেশ জৈন বলেন, “জেরায় ধৃতেরা অপরাধের কথা কবুল করেছে।” পুলিশের দাবি, জেরার মুখে ধৃতেরা জানিয়েছেন, ঘটনার পরে জগন্নাথকে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন ঝর্না। তার পর পড়শিদের ডেকে ডাকাতির গল্প ফাঁদেন। এসপি বলেন, “ঝর্না প্রথমে বলছিলেন, মুখোশ পড়া তিন ডাকাত এসে ওই চার জনকে খুন করে চম্পট দিয়েছে। কিন্তু, তাঁর কথায় অসঙ্গতি ছিল। জেরার মুখে তিনি ভেঙে পড়ে জানান, তাঁর মদতে জগন্নাথই চার জনকে খুন করেছেন।”
শনিবারের ঘটনার পরে ঝর্নার ছেলে অর্জুনের সঙ্গে অবশ্য কথা বলতে পারেনি পুলিশ। অর্জুন এখন বাবার সঙ্গে গ্রামেই এক কাকার বাড়িতে রয়েছে। প্রতিবেশীদের কাছে পুলিশ জেনেছে, ঘটনার সময় ঘুমিয়ে ছিল সে। চিৎকার-চেঁচামেচিতে চোখ মেলে দেখে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। তরোয়ালের কোপে হাত কাটা গিয়েছে ঠাকুমার, সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে কাকার, ঠাকুরদা সংজ্ঞাহীন। এই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারায় ছোট্ট অর্জুন। রবিবার বিকেলেও তার আতঙ্ক কাটেনি। সে অসংলগ্ন কথা বলছে। পুলিশ জানিয়েছে, অর্জুন কিছুটা সুস্থ হলে ওর সঙ্গে কথা বলা হবে। কারণ, সেই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। |
সেই বাড়ি। সামনে স্থানীয়দের জটলা।—নিজস্ব চিত্র। |
গত ১৬ জানুয়ারি কাটোয়ার সর্ষেখেতে উদ্ধার হয়েছিল মুর্শিদাবাদের লালবাগের সবিনা বিবির দেহ। পাশে বসে কাঁদছিল তাঁর পাঁচ বছরের শিশুপুত্র। পুলিশকে সে জানিয়েছিল, এক অচেনা কাকুই তাদের সঙ্গে ছিল। শুধু তাই নয়, কাটোয়া উপ-সংশোধনাগারে এসে চিনিয়ে দিয়েছিল সেই কাকুকে। বলেছিল, ‘এই তো আমার মাকে মেরেছে!’ তার পরই মা-মা বলে কেঁদে উঠেছিল। বুঝতে পেরেছিল, মা আর ফিরবে না। হয়তো বুঝতে পেরেছিল, নিহত মায়ের পাশেই সে ঘুমিয়েছিল সারা রাত। এই ধরনের ঘটনা শিশুমনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে বলে জানাচ্ছেন শিশুমনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত রণদীপ। মহিষাদলের ঘটনার কথা জেনে তাঁর অভিমত, “এই অবস্থায় সবচেয়ে জরুরি হল, কাছের লোকদের অর্জুনের পাশে থাকা। যথেষ্ট সময় দিয়ে ওকে বোঝার চেষ্টা করা।” প্রয়োজনে কাউন্সেলিংয়ের পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কালিকাকুণ্ডু গ্রামে মাটির দোতলা বাড়ির উপরতলায় ছেলেকে নিয়ে থাকেন ঝর্না। শ্বশুর-শাশুড়ি থাকতেন নীচে। ঝর্নার স্বামী শুকদেব কুইল্যা মেচেদায় এক বেসরকারি সংস্থায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। হামেশাই রাতে বাড়ি ফেরেন না তিনি। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, সেই সুযোগে ঝর্নার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে শুকদেবের খুড়তুতো ভাই জগন্নাথের। তাঁর বাড়ি পাশেই। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, সম্পর্কের কথা জানাজানি হওয়ায় কিছুদিন ধরে ওই পরিবারে অশান্তি চলছিল। সমস্যা সমাধানে গ্রামে সালিশি সভা ডেকে দু’জন কে সাবধান করে দেওয়া হয়। তার পরেও ওঁরা দু’জন বেপরোয়া ভাবে মেলামেশা করতেন বলে প্রতিবেশীরা পুলিশকে জানিয়েছেন।
পুলিশের দাবি, জেরায় ধৃতেরা জানিয়েছে, শনিবার রাতেও গোপনে ঝর্নার ঘরে এসেছিলেন জগন্নাথ। গভীর রাতে দোতলায় শব্দ পেয়ে উপরে উঠে এসে ঝর্নাকে দরজা খুলতে বলেন শ্বশুর রামপ্রসাদবাবু। তখনই জগন্নাথ খোলা তরোয়াল হাতে দরজা খুলে জ্যাঠার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রামপ্রসাদবাবুর শরীরের বিভিন্ন অংশে কোপ মারা হয়। তাঁর চিৎকারে একে একে ওপরে উঠে আসেন নিহারীবালাদেবী, অরুণ এবং কল্পনাদেবী। প্রত্যেককেই জগন্নাথ তরোয়াল দিয়ে কোপান। রবিবার ভোরে পড়শিরা ফোন করে ঝর্নার স্বামীকে সব জানান। স্ত্রী ও খুড়তুতো ভাইয়ের এই কাণ্ডে বিহ্বল শুকদেব ছেলেকে আগলে রেখেছেন।
গ্রামের গেরস্থ বাড়িতে তিন ফুটের তরোয়াল এল কোত্থেকে? পুলিশ সুপার বলেন, “জেরায় জগন্নাথ জানিয়েছে, তরোয়াল অনেক দিন ধরেই ঝর্নার ঘরে ছিল। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে ওই তরোয়াল দিয়ে বেপরোয়া ভাবে একে একে চার জনকে খুন করেছে।” আর শুকদেব বলেন, “আমাদের বাড়িতে যে তরোয়াল রাখা আছে, আমিই তা জানতাম না!” |
|
|
|
|
|