|
|
|
|
|
মনীষী
আজ বয়স হওয়ার কথা ছিল ঊনষাট। না থেকেও অবশ্য পৃথিবীতে
রয়েছে তাঁর পাঁচ অমর সৃষ্টি। স্টিভ জোবস-য়ের জন্মদিনে
লিখছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ কর।
|
|
সেই আদম আর ইভের সময় থেকেই আপেল আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই ফলে কামড় না দিলে আজ কোথায় আমি, কোথায় আপনি আর কোথায় আনন্দ প্লাস!
আবার দেখুন চিকিত্সাশাস্ত্রে বলে ‘অ্যান অ্যাপল আ ডে, কিপস্ দ্য ডক্টর অ্যাওয়ে’। অর্থাত্ দিনে একটা আপেল খেলে আপনাকে আর ডাক্তারবাবুর মুখ দেখতে হবে না! আবার সেই আপেল আর তার মাহাত্ম্য। কিন্তু কেউ কি আপনারা কখনও ভেবেছিলেন বা কোনও বিজ্ঞজন কি কোনও দিন আপনাকে বলেছিল, যে পুরো আপেল খাওয়ার দরকার নেই। এক কামড় বসালেই আপনার জীবন পাল্টে যাবে?
না, কেউ বলেনি... কেউ ভাবেনি... কিন্তু একজন এই জাদু করে দেখিয়েছেন। জাদুকর স্টিভ জোবস। অ্যাপল সংস্থার জনক। তাঁর আধখাওয়া অ্যাপল যে আমাদের জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে! আসুন, আজ তাঁর জন্মদিনে আমাদের জীবন পাল্টে দেওয়া জাদুকরের পাঁচটা জীবন পাল্টে দেওয়া আবিষ্কার নিয়ে একটু আলোচনা করি। জাদুকর প্রয়াত স্টিভ জোবস, আর তাঁর জীবনমুখী আবিষ্কার! শুধু জাদুকর বললে কম বলা হয়, উনি মনীষী।
একটি বহুজাতিক ঠান্ডা পানীয় সংস্থার প্রেসিডেন্ট এবং আমেরিকার টপ এক্সিকিউটিভ জন স্কালে-কে ১৯৮৩ সালে অ্যাপল সংস্থায় আনার জন্য স্টিভের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে “জন, তুমি কি বাকি জীবন মিষ্টি জল বিক্রি করে কাটাবে, নাকি আমার সঙ্গে দুনিয়া পাল্টানোর চেষ্টা করবে?”
পাল্টানোর সেই শুরু। যা প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনকেই পাল্টে চলেছে। |
|
পার্সোনাল কম্পিউটার |
শুরু থেকেই কম্পিউটার ব্যাপারটা একটা খুব কঠিন, খুব বৃহত্, খুব বিজ্ঞ ব্যাপার ছিল। তার মধ্যে আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষের কোনও প্রবেশাধিকার ছিল না। আমরা জানতাম প্রযুক্তি এমন এক জিনিস আবিষ্কার করেছে, যা দিয়ে অনেক বড় এবং শক্ত কাজকর্ম খুব সহজে করা যায়। এই যেমন পরমাণু এবং বিজ্ঞানচর্চা, অন্য গ্রহে অভিযান, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, দেশের সরকারি ব্যবস্থা ইত্যাদি সব বড় বড় ব্যাপার।
কিন্তু সেই সময় কি আমরা ভাবতে পেরেছিলাম যে, আমাদের ঘরে ঘরে একদিন একটা চৌকো বাক্স থাকবে আর আমাদের জীবনটাই পাল্টে যাবে? না, আমরা ভাবিনি। কিন্তু স্টিভ জোবস ভেবেছিলেন। এবং তাঁর পার্টনার স্টিভ উজনিয়াকের সঙ্গে ১৯৭৬ সালে একটা মেশিন বাজারে ছাড়েন যা পার্সোনাল কম্পিউটার হিসেবে জন্ম নেয়। আজকের তুলনায় অতি বদখত চেহারার সেই মেশিন কিন্তু সারা বিশ্বে এক নতুন বিপ্লবের জন্ম দেয়। পরবর্তী কালে অ্যাপল ম্যাকিনটস নামে তা আত্মপ্রকাশ করে ১৯৮৪ সালে। কোয়ালিটি, স্টাইল, ইউটিলিটি, এসথেটিক্সে যা এখনও পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। পার্সোনাল কম্পিউটার আজ আমাদের জীবন কী রকম পাল্টে দিয়েছে তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আপনার গিন্নির মাসকাবারির খরচা, আপনার ১০ দশ বছরের ছেলের স্কুলের হোমওয়ার্ক, আপনার অফিসের কাজ যে কত সহজ করে দিয়েছে, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? ডেস্কটপ পাবলিশিং এর একটি উত্কৃষ্ট উদাহরণ, যাকে পাবলিশিংয়ের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব বলে গণ্য করা হয়, যার পুরো কৃতিত্বই পাবে আমাদের জাদুকরের ম্যাজিক!
আমাদের কাজ করার ধরনটাই পাল্টে দিল স্টিভদা।
|
আই পড |
ছোটবেলায় রানিগঞ্জে থাকতাম। জানালা দিয়ে দেখতাম কিছু লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কাঁধের ওপর একটা ট্রানজিস্টর রেখে তারস্বরে গান শুনতে শুনতে চলেছে। নিজেও শুনছে এবং আশপাশের লোককে (সে তারা শুনতে চাক বা না-ই চাক) শুনিয়ে চলেছে। স্টিভ বোধহয় কোনও দিন রানিগঞ্জে এসেছিলেন, এবং তাই বোধহয় ‘পার্সোনাল গান শোনার’ কষ্ট বুঝতে পেরে একটা ভদ্রস্থ আবিষ্কার উনি করেন, যার নাম আই পড (উচ্চারণটা কিন্তু ইংরেজিতে করবেন, বাংলায় নয়। তার কিন্তু অন্য, কিঞ্চিত্ অভদ্র মানে হয়। একটা ছোট্ট যন্ত্র, তার সঙ্গে হেডফোনস, যার মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার গান ব্যস্, আপনি গান শুনুন, সারা দিন শুনুন, হাঁটতে হাঁটতে শুনুন, কাজ করতে করতে শুনুন, কথা বলতে বলতে (অন্যের কথা না শুনে) গান শুনুন, ঝগড়া করতে করতে শুনুন, রাস্তা পেরোতে পেরোতে গাড়ির ধাক্কা খেয়ে শুনুন (কিন্তু ড্রাইভারের গালাগালটা শুনতে পাবেন না এটা উপরি পাওনা), পটিতে শুনুন, ধাবায় শুনুন, ফুলশয্যার রাতে শুনুন, মৃত্যুশয্যায় শুনুন। জীবনটাই গানময় হয়ে
উঠুক। চোখ বুজে গান শোনার দিন শেষ। বরং গান শুনতে শুনতে চোখ বোজার দিন আসন্ন। ২০১১ সালে আত্মপ্রকাশ...আপাতত সারা বিশ্বে প্রায় চল্লিশ কোটি বিক্রি হয়েছে। মন্দ নয়, কী বলেন?
আমাদের গান শোনার ধরনটাই পাল্টে দিল স্টিভদা!
|
আই টিউন |
গান তো শুনবেন। কিন্তু গান পাবেন কোথায়? গুলি ছাড়া যদি বন্দুক অচল হয়, তা হলে গান ছাড়া তো আই পড (উচ্চারণ তেমনই রাখবেন প্লিজ) অচল! তা, ২০০৩-য়ে স্টিভ শুরু করলেন আই টিউন। ২ লক্ষ গান দিয়ে একটি অনলাইন ‘মিউজিক স্টোর’। গান শোনার জন্য আপনাকে লং-প্লেয়িং রেকর্ড কিনতে হবে না। ক্যাসেট কিনতে হবে না, এমনকী সিডি-ও কিনতে হবে না। ইন্টারনেট কানেক্ট করে আই টিউন মিউজিক স্টোরে চলে যান আর মনের সুখে ইচ্ছে মতো গান খুঁজে নিয়ে ডাউনলোড করুন। ব্যস্। বন্দুকে গুলি ভরা হয়ে গেল এ বার ফায়ার! ভাবছেন কী এর সাফল্য? তা হলে একটা পরিসংখ্যান দিচ্ছি। লঞ্চ করার প্রথম সপ্তাহে ১০ লক্ষ গান বিক্রি হয়! ২০১০ সাল পর্যন্ত কত গান ডাউনলোড হয়েছে জানেন? এক হাজার কোটি! এই বিপুল গানের ভাণ্ডারে দেশ-ভাষা-সুর-বাজনা-গায়ক-গায়কিসব মিলেমিশে একাকার। এক অফুরন্ত আনন্দ উপস্থিত!
গানের ভাণ্ডারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গানের ভাণ্ডারটা যে পাল্টে দিল স্টিভদা!
|
আই ফোন |
আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল কি কোনও দিন ভেবেছিলেন যে ওঁর একটি ‘হ্যালো’ বলার যন্ত্র একদিন দুনিয়া হেলিয়ে দেবে? টেলিফোন বহু দিন ‘টেলিফোন’ হয়েই ছিল, ‘জীবন’ হয়ে ওঠেনি। স্টিভ জোবস বুঝতে পারেন যে, টেলিফোন জিনিসটা খুব তাড়াতাড়ি ‘মাল্টি ইউসেজ’ হয়ে উঠেছে। এবং ২০০৭ সালে অ্যাপল কোম্পানি লঞ্চ করে আই ফোন। সৌন্দর্যে, ব্যবহারে, ফিচারে, এবং সর্বোপরি প্রযুক্তিতে সবাইকে টেক্কা দেয় এই স্মার্ট ফোন। এমনই এর আকর্ষণ যে, সানফ্রান্সিস্কোর স্যান্ডি থেকে হাবড়ার হাবুল, এমনকী গড়িয়ার গুড়িয়া পর্যন্ত এর জন্য আকুল ও চিত্পটাং। স্টিভের এই অসাধারণ সুন্দর যন্ত্র ‘টেলিফোন’য়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘জীবন’য়ের লক্ষ্য পেরিয়ে এখন জীবনসাথি।
কত তথ্য, কত খবর, কত জ্ঞান, কত বন্ধু, কত রহস্য লুকিয়ে আছে এই পাঁচ ইঞ্চির জীবনসাথির হৃদয়ে। চান করার সময় এবং গায়ে সাবান মাখার সময় বাদ দিলে এই বন্ধু আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী। এক দিন দূরে থাকলেও আমাদের প্রাণ কেঁদে ওঠে। বিশ্বব্যাপী এর পঁচিশ কোটি ভক্ত এখনো অবধিমাত্র দেড় কোটি অ্যাপলিকেশন ডাউনলোড করেছেন অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকে মাত্র এক বছরে। ভাবা যায়। শোনা যায়, আজকাল পারিবারিক ঝগড়ার সিংহভাগ আমাদের সর্বক্ষণের এই স্মার্টফোন।
আমাদের জীবনসাথির ধরনটাই পাল্টে দিল স্টিভদা।
|
আই প্যাড |
স্টিভের চলে যাওয়ার আগে শেষ জাদু। আই প্যাড। ট্যাবলেট জগতে অ্যাপলের প্রবেশ একটু দেরিতে বাজার বুঝে, আরও ভাল করে বললে, বাজারের খামতি আর চাহিদা ভাল করে বুঝে। কারণ স্টিভ জানতেন, অ্যাপল যা করে, সেরা জিনিস করে। স্টিভের সব ম্যাজিকের গ্র্যান্ড ফিনালে হল আই প্যাড। পার্সোনাল কম্পিউটারের কাজ করার ক্ষমতা? এতে আছে। আই পডের গান শোনার ক্ষমতা? এতে আছে। আই টিউনসের গানের ভাণ্ডার ব্যবহার করার ক্ষমতা? এতে আছে। আরও আছে। ছবি তোলা, ভিডিও তোলা, ইন্টারনেট সার্ফ করা, ইমেল করা কী নেই এতে? বাজার চলতি ট্যাবলেটদের ধরাশায়ী করে দেওয়ার ক্ষমতা আলবাত আছে। দুনিয়াব্যপী চুড়ান্ত প্রতিযোগীতার মধ্যেও, আই প্যাড তার নিজের উচ্চাসনটাকে ধরে রেখেছে। ২০১০-এ আত্মপ্রকাশ করে, ২০১৩ অবধি বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৭ কোটি! বিশ্বব্যাপী অ্যাপলপ্রেমীরা, কথায় বলে, “দে সোয়ের বাই অ্যাপল প্রোডাক্ট” আমাদের সময়ে ‘মা কালী বলছি’ এখন হয়ে উঠেছে ‘আই প্যাডের দিব্যি’! এমনই তার ভক্তকূল... এমনই তাদের ভরসা... তারা অ্যাপলপ্রেমী... থুড়ি থুড়ি এমনই তারা স্টিভের ম্যাজিকপ্রেমী!
ফরসা ফ্যানি, কালো কালু, বাদামী ববিতা এবং হলদে হুয়াং... গত দশ বছরে সবার জীবন পাল্টে দিয়েছে স্টিভদা!
আমাদের পুরো জীবনটাই পাল্টে দিল স্টিভদা!
শেষ পাতে একটু দুঃখ রয়ে গেল। আর কিছু দিন বেঁচে থাকলে একবারটি দেখা করে, দরকার পড়লে গড়ের মাঠে ধর্না দিয়ে বলতাম, “স্টিভদা, আমাদের আই লিগটাকেও একটু পাল্টে দিন না!” বড্ড দেরি হয়ে গেল... মাফ চাইছি আপনাদের কাছে!
ইস্, আরও যে অনেক কিছু পাল্টাতে পারতেন আমাদের স্টিভদা।
|
আপেলের কামড়ে জীবন বদল |
|
আই ম্যাক (১৯৯৮)
কম্পিউটারও যে পার্সোনাল হতে পারে কে জানত!
স্টিভ জোবস নিশ্চয় জানতেন।
নইলে আর এমন পিসি কেন বানাবেন।
অর্ধস্বচ্ছ ব্যাক কভার, তা-ও আবার বিভিন্ন রঙে |
আই ফোন (২০০৭)
অ্যাপেল কনভেনশনে আই ফোন রিলিজের সময়
স্টিভ জোবসের কথাই আবার বলি।
আই ফোন= আই পড+ ইন্টারনেট কমিউনিকেটর+ ফোন।
পুনশ্চ: যাত্রা শুরু থেকে আজকের ৫এস প্রস্থে কিন্তু
একটুও
বাড়েনি আই ফোন। কেন? স্টিভ চাইতেন ফোন
যেন এক হাতেই ব্যবহার করা যায় |
|
|
আই টিউনস (২০০১)
বাস্তবেই সব পেয়েছির আসর। গান, ভিডিয়ো, পড কাস্ট,
বই... কী নেই এখানে। তবে সব কিছুই ডিজিটাল।
ফিজিক্যাল ফরম্যাটের দিন শেষের ঘণ্টা।
না হলে সেই সময়ের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কর্তারা
স্টিভ জোবসের কাছে গিয়ে ধর্না দেন! |
আই পড (২০০১)
পকেটেই হাজার গান। আই পড-কে এমন ভাবেই
ব্যাখ্যা করেছিলেন স্টিভ। ক্ল্যাসিকের পর একে একে
যোগ হয়েছে শ্যাফল, ন্যানো, টাচ। প্লে-লিস্ট শব্দটা
২০০১-এর আগে ডিকশনারিতে ছিল কি! |
|
|
আই প্যাড (২০১০)
ট্যাবলেট কম্পিউটার। কম্পিউটারের প্রায় সব কাজ
করতে পারলেও, আসল কেরামতি তো অ্যাপসের।
তাই অন হতে বেশি সময় ব্যয় হবে না। সঙ্গে আছে
‘সিরি’র মতো পার্সোনাল ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট |
|
|
|
|
|
|
|