মোট ২৪ ঘণ্টাও নয়। তার মধ্যেই ছবিটা আমূল পাল্টে গিয়েছে। প্রেসিডেন্টের বাড়ির সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন বিদ্রোহীরা। একই অবস্থা প্রেসিডেন্টের সরকারি দফতরেরও। এমনকী গত কয়েক দিন ধরে অতি সক্রিয় সেই পুলিশ বাহিনীরও সকাল থেকে দেখা মেলা ভার।
ছন্নছাড়া এই ছবিই এখন বাস্তবের কিয়েভ। গত দু’দিনে একশোরও বেশি মানুষের মৃত্যুর সাক্ষী ইউক্রেনের রাজধানী। কয়েক মাসের অচলাবস্থা কাটাতে গত কাল বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে অস্থায়ী শান্তিচুক্তিও সই করেন প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ। |
নিহতদের স্মরণে। কিয়েভের ইনডিপেনডেন্স স্কোয়ারে। ছবি: রয়টার্স। |
আর এই পরিস্থিতিতে আজ সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে। তা হলে কি দেশ ছেড়ে পালালেন তিনি? এমন গুজবই প্রথমে ছড়াতে শুরু করেছিল। বিদ্রোহীরা বলতে শুরু করেছিলেন, ভয়ে পেয়েই দেশত্যাগী হয়েছেন ইয়ানুকোভিচ। তত ক্ষণে প্রেসিডেন্টের সরকারি আবাস বিক্ষোভকারীদের দখলে চলে গিয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেই বাড়ির সিঁড়িতেই তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন বিদ্রোহীরা। প্রেসিডেন্টের দফতরও তখন তাঁদেরই দখলে। সরকারি প্রতিনিধি বা ইয়ানুকোভিচের দলের লোককে দেখলেই চলছে মারধর। পুলিশ তখন নীরব দর্শক। উল্টে গত কয়েক দিনের রক্তপাত আর এত মানুষের মৃত্যুর জন্য শোকপ্রকাশ করতেও আজ দেখা গিয়েছে তাদের। সংবাদমাধ্যম এরই মধ্যে খবর করতে শুরু করে যে, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ইয়ানুকোভিচ। তাঁর পদত্যাগ নিয়েও শুরু হয় নতুন জল্পনা।
এর পরই নড়েচড়ে বসে ইউক্রেন সরকার। সরকারের এক প্রতিনিধিই বিবৃতি দেন, মোটেও দেশত্যাগী হননি তাঁদের প্রেসিডেন্ট। দেশের পূর্বে খারকিভ শহরে গিয়েছেন। ইউক্রেনের পূর্বাংশ বরাবরই রাশিয়া ঘেঁষা। চরম বিপাকে পড়ে প্রেসিডেন্ট কি তবে নিজের ভোটব্যাঙ্ক বাড়াতে গেলেন? সন্ধেয় মুখ খোলেন খোদ ইয়ানুকোভিচ। জানান, তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে। আপাতত কিয়েভ থেকে সরে এসেছেন তিনি। ইস্তফার জল্পনায় জল ঢেলে বলেন, “আমি দেশের আইনত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। পালানোর প্রশ্নই নেই। অদূর ভবিষ্যতে পদত্যাগেরও পরিকল্পনা নেই।” এর মধ্যেই দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী নেত্রী ইউলিয়া টাইমোশেঙ্কোকে মুক্তি দিয়েছে ইউক্রেনের পার্লামেন্ট। ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে জেল খাটছিলেন তিনি।
ইয়ানুকোভিচকে সরাতে এখন তৎপর দেশের মন্ত্রীরাও। পার্লামেন্টের সদস্যরা আজই ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্টকে গদিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সঙ্গেই ২৫ মে নির্বাচনের দিনও ঘোষণা করে দেন তাঁরা। তবে এই সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট মানতে বাধ্য কি না, সে নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের পরই ইয়ানুকোভিচের প্রতিনিধি জানিয়ে দেন, পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অবৈধ। তা মানার প্রশ্নই নেই।
সুতরাং এত সহজে যে রণে ভঙ্গ দেবেন না, তা আজ বারেবারেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন ইয়ানুকোভিচ। উল্টো দিকে, বিক্ষোভকারীরাও দমে যাওয়ার পাত্র নন। ডিসেম্বরে নির্বাচনের যে আশ্বাস প্রেসিডেন্ট দিয়েছেন, তাতে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। “মে মাসেই নির্বাচন করতে হবে। ডিসেম্বর তো বহু দূর। ইয়ানুকোভিচকে এখনই সরতে হবে,” বললেন বিক্ষোভকারীদেরই এক জন। ইনডিপেনডেন্স স্কোয়ার তাই আজও ‘রিজাইন’ ‘রিজাইন’ ধ্বনিতে মুখর। ইয়ানুকোভিচ সরকারেরই এক প্রতিনিধি এর মধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই ডামাডোলে ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যেতে পারে ইউক্রেন। দেশের পূর্বাংশ রাশিয়ার অতি ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। উল্টো দিকে, পশ্চিমের একটা বড় অংশ অনেক দিন ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি নিজেদের আনুগত্য দেখিয়ে আসছে। যে মূল সূত্র ধরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের বিরোধ, সেই সূত্রেই হয়তো ভেঙে খানখান হয়ে যেতে পারে গোটা দেশটাই। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের রাজনীতির স্রোত কোন দিকে বয়, সে দিকেই তাকিয়ে গোটা বিশ্ব। |