|
|
|
|
|
সংসদীয় রাজনীতিতে নতুন ব্র্যান্ড কেজরীবাল
যে সাফল্য তিনি অর্জন করেছেন, তাকে ছোট করে দেখার কোনও উপায় নেই। লিখছেন
জয়ন্ত ঘোষাল |
|
মানুষটির নাম অরবিন্দ কেজরীবাল।
কিছু দিন আগেও এ দেশে এই নামটি কোনও পরিচিত নাম ছিল না। তিনি যে কোনও এক জন সাধারণ সরকারি অফিসারের মতো বিপুল চলমান ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের এক প্রতিনিধি ছিলেন। আজ সেই অরবিন্দ কেজরীবাল ভারতীয় রাজনীতির এক নতুন নাম, নতুন ট্রেন্ড, নতুন ব্র্যান্ড। বাজার-বিপণনের ভাষায়: কেজরীবাল ইস ইন।
হতে পারে, তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। ধুমকেতুর মতো আগমন, তার পর আকস্মিক মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি থেকে বিদায়। কিন্তু এই আসা-যাওয়ার পথের মাঝে কেজরীবাল নামক ব্যক্তিটির ‘আম আদমি’ রাজনীতির অবসান কিন্তু হয়নি। লোকসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি মোট ক’টি আসনে জিতবে তা বিচার করাও আমার কাজ নয়।
কিন্তু এ কথা বলাই যায়, কেজরীবাল ব্র্যান্ড রাজনীতি ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। রাহুল গাঁধী এবং নরেন্দ্র মোদীকেও কংগ্রেস ও বিজেপি রাজনীতিতে বার বার আম আদমি-র কথাই বলতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরা এ বার অধিকাংশই হবেন আম আদমি। নানা পেশা থেকে নানা সাধারণ মানুষ প্রবেশের ছাড়পত্র পাবেন প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়ায়। মোদী চা-ওয়ালার তকমা নিয়ে প্রচার ধারালো করছেন, রাহুল প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে আমজনতার বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছেন। |
|
ইস্তফা দেওয়ার পর নয়াদিল্লিতে। ছবি: এএফপি। |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা জীবন মা মাটি মানুষের রাজনীতি করেও আজ প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান মানেই আধিপত্য এবং প্রাধান্য। তিনি অণ্ণা হজারের সঙ্গে বৈঠক করে আম আদমির কথা বলতে চাইছেন গোটা দেশ জুড়ে।
কেজরীবাল এমন এক জন মুখ্যমন্ত্রী যাকে উত্তর ভারতের সংস্কৃতিতে এর আগে কেউ দেখেননি, তিনি প্রবল শীতে রাত্রিবাস করেছেন রাজপথে। প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁর কাজকর্মে নৈরাজ্যের গন্ধ পেলেও মানুষ কিন্তু চলতি বড় দলগুলির সংসদীয় শৃঙ্খলাতেও ক্লান্ত। অত্যাচারিত। জর্জ বার্নার্ড শ’য়ের একটি বিখ্যাত উক্তি স্মর্তব্য। হোয়্যার অর্ডার ইস ইনজাস্টিস, ডিসঅর্ডার ইস দ্য বিগিনিং অফ জাস্টিস। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান কেজরীবাল শুরু করেছিলেন অণ্ণা হজারের সঙ্গে। আজ তিনি নিজেই মুকেশ অম্বানীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করে শহিদের মর্যাদা চাইছেন।
একটা সময় মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে টি এন সেশন এ রকম দুর্নীতি ও সমাজ বদলানোর ডাক দিয়েছিলেন। ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজে খুব জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু অবসরের পর তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন, দু-চারটি বই লিখলেন। কিন্তু ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় সফল হতে পারলেন না। নির্বাচন কমিশনে সিস্টেমের মধ্যে থেকেও সেশন যখন সিস্টেম বিরোধী বিদ্রোহ করতেন তখন সংবাদমাধ্যমের ভিড় ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু অবসরগ্রহণের পর পান্ডারা পার্কের বাড়িতে যখন তিনি নতুন দল গঠনের কথা ঘোষণা করে নিজের হাতে ধোসা রান্না করে সাংবাদিকদের খাওয়াচ্ছিলেন, তখন কিন্তু সেই গণ-উন্মাদনা ছিলনা।
তাই বলব, কেজরীবাল যে সাফল্য অর্জন করেছেন, তাঁকে কিন্তু ছোট করে দেখার কোনও উপায় নেই। যাঁরা কেজরীবালকে পাগল, শহুরে মাওবাদী বলে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। কারণ, এই পচা-গলা রাজনৈতিক মূলস্রোতের বিরুদ্ধে অসহায় সাধারণ মানুষ খড়কুটোর মতো বার বার নানা নেতাকে ধরার চেষ্টা করেছে, করছে এবং করবে। আশির দশকে এন টি রাম রাওয়ের তেলুগু দেশম, অসমে অগপ অথবা পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিভিন্ন সময়ে এই প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদী মানুষের অন্ধের যষ্ঠী হয়ে উঠেছিলেন।
ভারতীয় অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের মডেল মূলত মিশ্র অর্থনীতির কেইনসীয় মডেল। এই মডেল গত ৬৭ বছর ধরে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের গলা শোনাচ্ছে আমাদের। বিপুল এই জনসমাজের কাছে রাষ্ট্রনেতারা কখনও সমাজতন্ত্র, কখনও ধর্মনিরপেক্ষতার ঘুমের বড়ি দিয়েছেন। সংবিধান ও গণতন্ত্রর কাহিনি শুনতে শুনতেও ক্লান্ত। উদার অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্রের রাজনীতির সংঘাতও বেড়েছে গোটা দুনিয়া জুড়ে। তাই উত্তর-আধুনিককতা পর্বে মতাদর্শর প্রতিই বিপুল জনসমাজে এসেছে এক ধরনের ঘেন্না। বিপ্লবের কথা নয়, তত্ত্ব-মতাদর্শ নয়, এখন আম আদমি চাইছে ‘রোটি-কপড়া-মকান’-‘বিজলি-পানি-সড়ক’। সমসাময়িক নয়া উদারবাদের বিকাশের পাশাপাশি বাড়ছে সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের ন্যূনতম মৌলিক দাবি। |
|
আপ-এর সদর দফতরের সামনে কেজরীবাল ও তাঁর সমর্থকেরা। ছবি: রয়টার্স। |
কেজরীবালের রাজনীতিকেও এই প্রেক্ষিতে দেখতে হবে আমাদের। কেজরীবালের আবেদন বুর্জোয়া মধ্যবিত্তের কাছে তাই সবচেয়ে বেশি আবেদন সৃষ্টি করেছে। প্রকাশ কারাটের মতো নেতাও স্বীকার করছেন যে, ভারতীয় কমিউনিস্টরা এই মধ্যবিত্ত পরিসরকে দখল করতে হিন্দি বলয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। যদিও এই পরিসর তো তাদেরই পরিসর ছিল। বেকারি-দারিদ্র প্রতিযোগিতায় কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নামে দুর্নীতির ডাকাতি এ সবের প্রতিবাদের ভাষা তো ছিল মাকর্সবাদ। আর্থিক উদারবাদের অগ্রগতির ফলে ’৯১ সালের পর ভারতে মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণ হয়েছে। ভারতে আজ মধ্যবিত্ত প্রায় ৩০ কোটি।
কেজরীবাল এই মধ্যবিত্তের কাছে স্বপ্নের নতুন ফেরিওয়ালা। শুধু মধ্যবিত্ত নয়, যাঁরা মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত হচ্ছেন, শহুরে বস্তির বাসিন্দা থেকে গ্রামীণ শিক্ষিত সমাজ সবাইকে কাছে টানতে চাইছেন কেজরীবাল।
দেং জিয়াও পিংয়ের কথা, বিড়ালটা কালো না সাদা সেটা বড় কথা নয়। বেড়ালটা ইঁদুর ধরতে পারছে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। মতাদর্শ থেকে এ ভাবেই দেং চিনে বাস্তববাদ-প্রয়োগবাদ এনেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে একদা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখেও এ ধরনের কথা আমরা শুনেছিলাম। এখন কেজরীবাল কী বলছেন? তিনি বলছেন, আমাদের লক্ষ্য সমাধান নির্ভর। যদি বামপন্থী পথে সমাধান হয়, আমরা সে পথ নেব। যদি ডানপন্থী পথে সমাধান হয়, তবে সে পথ গ্রহণ করব। মতাদর্শ হচ্ছে পন্ডিত আর সংবাদমাধ্যমের আলোচনার জন্য।
গোটা পৃথিবী জুড়ে মতাদর্শের মৃত্যুর কথা নানা ভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে। ফ্রান্সে অ্যান্টি ফিলোজফির তত্ত্ব এসেছে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুকোয়ামা বললেন, ইতিহাসের সমাপ্তি। প্রেক্ষাপটে বেসরকারি নানা সংস্থা এনজিও, কেজরীবালের আন্দোলনের সমর্থনের এগিয়ে এসেছে। আপ বলছে, তারা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নয়, পুঁজিবাদের নামে স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে। যাকে বলে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম।
কোনও সন্দেহ নেই, কেজরীবাল ভি ভি আই পি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে অন্তত প্রতীকী অর্থেও আমজনতার কাছে এক নয়া সংস্কৃতির মানদণ্ড তুলে ধরতে চাইছেন। এক আমআদমি-র আচরণের প্রয়োজনীয়তা শাসক কুলের কাছেও অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কী ভাবে এই চলতি ক্ষমতার ব্যবস্থাকে ভাঙা হবে তার কোনও সুনির্দিষ্ট সমাধানের রাস্তা কেজরীবালের কাছে নেই। ধনী-দরিদ্র বিভাজনের সমাপ্তি কী ভাবে হবে? নতুন পৃথিবীতে নয়া-সাম্রাজ্যবাদী শোষণের প্রতিবাদ কী ভাবে হবে? বিপ্লবের কথাও কেজরীবাল বলেন না, ভোটের মাধ্যমে তিনি সংসদে আসন বাড়িয়ে এই ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে পুরো সুযোগ-সুবিধা প্রদানে আন্তরিক চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু আজ বড় দলগুলি ক্ষমতাসীন হয়ে যে ভর্তুকি দেয়, যে সব সামাজিক প্রকল্প রূপায়ণ করছে, তা-ও মূলত যে মধ্যবিত্ত সমাজের জন্য হচ্ছে তাতে প্রান্তিক অন্ত্যজ মানুষদের কার্যত কোনও ঠাঁই নেই। অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদ এ কথাটাই বার বার বলতে চাইছেন যে মূল তর্কটা উন্নয়ন বনাম বৃদ্ধির নয়, আসলে উন্নয়নের সুযোগ-সুবিধা আম আদমি-র সর্বনিম্ন স্তরে দারিদ্র সীমারেখার নীচে থাকা মানুষগুলোর কাছে না পৌঁছলে সমাজের সার্বিক বৃদ্ধিও হবে না। এ ব্যাপারেও কেজরীবাল দিশাহীন। |
|
দলীয় দফতরে কেজরীবাল। ছবি: পিটিআই। |
গ্রামশ্চি সমাজের নানা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রাধান্য ও আধিপত্যের ক্ষমতা-রাজনীতির কথা বলেন, মিশেল ফুকো ক্ষমতা-রাজনীতি সংস্কৃতি ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বিদ্যমান বলে জানান। রুশো এবং ল কের নাগরিক সমাজের সাধারণ ইচ্ছা যে আসলে এত সহজ সমসত্ত্ব বিষয় নয়, বরং বহুমুখী ও জটিল তা আমরা পদে পদে টের পাচ্ছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই নাগরিক সমাজ জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে, নিজেদের মধ্যেই আজ এ সমাজের কত সংঘাত! অনেকে তাই নাম দিয়েছেন, এটি পোস্ট সিভিল সোসাইটি বা উত্তর নাগরিক সমাজ।
এই বিপুল ভারতীয় সমাজের নানা স্তরের কাছে পচা-গলা রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেজরীবাল এক মহানায়ক। তাঁর সাফল্য কোনও ভাবেই ক্ষুদ্র করে দেখার চেষ্টা না করেও বলছি, ঘুণ ধরা দেখালে চুনকাম করে যে তিনি কিছু করতে পারবেন না সেটাও সম্ভবত ধীরে ধীরে অসহায় মানুষ বুঝতে পারছেন, বুঝতে পারবেন।
সমাধানের চাবিকাঠি কেজরীবালের কাছেও নেই। হয় তো আছে আন্তরিক স্বপ্ন ও চেষ্টা। |
পুরনো সমাচার: ভুল স্বীকার করে বিদ্ধ বুদ্ধদেব,
সিপিএম কি বদলাবে না |
|
|
|
|
|