বিচারবিভাগ যখন শাসনবিভাগের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করে, তখন পরিষদীয় গণতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বীরভূম জেলায় পাড়ুই গ্রামে সাগর দত্ত হত্যা মামলার তদন্তের ঘটনাবলিতে তেমন আশঙ্কার কারণ রহিয়াছে। প্রথমে পুলিশ, পরে সিআইডি-র তদন্তকর্মে অসন্তুষ্ট নিহতের পরিবারবর্গ কলিকাতা হাইকোর্টের কাছে সুবিচারপ্রার্থী হইলে বিচারপতি তদন্তকারীদের ভর্ত্সনা করিয়াছেন এবং রাজ্য পুলিশের কোন আধিকারিক নিরপেক্ষতা ও সততার সহিত নূতন করিয়া তদন্ত চালাইবেন, সেই বিষয়েও সক্রিয় ভূমিকা লইয়াছেন। শেষ অবধি পুলিশের কর্তার সহিত তাঁহার আলোচনার পরে রাজ্য পুলিশের ডিজিকে তদন্তের ভার দেওয়া হইয়াছে। প্রশাসনের কর্তা ও কর্মীরা কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হইলে আদালত তিরস্কার করিতেই পারেন, জবাবদিহি চাহিতেই পারেন। বস্তুত বিচারবিভাগের এই সংশোধনী ভূমিকাটি এ দেশে প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিকার হিসাবে জরুরি। কিন্তু কে তদন্ত করিবেন, তাহা স্থির করিবার দায়িত্ব কি সম্পূর্ণত প্রশাসনের নহে? আদালত এবং বিচারপতির প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াই প্রশ্ন তোলা যায়, পাড়ুই মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে বিচারপতি কি বিচারবিভাগ ও শাসনবিভাগের সীমারেখা লঙ্ঘন করেন নাই?
এই অভিযোগের যথেষ্ট কারণ আছে যে, পাড়ুই-হত্যার তদন্তকর্ম যথাযথ ভাবে হইতেছিল না। নিহতের পরিবারবর্গকে দিয়া সাদা কাগজে স্বাক্ষর করানো হইতে শুরু করিয়া ভুল লোককে গ্রেফতার করিয়া জেল খাটানো, এফআইআর-এ উল্লিখিত মূল অভিযুক্তদের গ্রেফতারের কোনও চেষ্টা না করা এবং শাসক দলের অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক কাণ্ডের বহু অভিযোগ ছিল। আদালতের বিশ্লেষণে গোটা বিষয়টিই রহস্যজনক ঠেকে। এ ধরনের অনাচার তদন্তকর্মকে বিভ্রান্ত ও বিকৃত করিতেই পারে। বস্তুত, এই ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত পুলিশ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা সম্পর্কেই সংশয় সৃষ্টি করে এবং প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের উপর সাধারণ বিচারপ্রার্থী মানুষের ভরসা তুলিয়া দেয়। একই ভাবে এই ধরনের প্রশাসনিক বিচ্যুতি এবং বিকৃতি শাসনবিভাগের অকর্মণ্যতা প্রকট করিয়া বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপের পথও প্রশস্ত করে, বীরভূমের বেলায় যাহার লক্ষণ স্পষ্ট। যদি তদন্তকর্ম নিরপেক্ষ হইত, তবে আদালতের তদন্তের দায়িত্ব সমর্পণ করিতে বিশেষ অফিসারের নাম উল্লেখ করিবার প্রশ্নও উঠিত না।
কিন্তু ইহা শিরোধার্য করিয়াও প্রশ্ন তোলা যায়, কাহাকে দিয়া তদন্ত করানো হইবে, কী কী বিষয় তিনি অনুসন্ধান করিবেন, এত খুঁটিনাটি বিষয়ে মাথা ঘামানো বা নির্দেশ জারি করা কি হাইকোর্টের বিচারপতির পক্ষে বিধেয়? শাসনবিভাগের এক্তিয়ারের পরিধি এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই সঙ্কুচিত করা হইতেছে। বিচারবিভাগের অতি-সক্রিয়তা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির সন্তুলনকেও নষ্ট করিতে পারে না কি? পুলিশ কমিশনার কিংবা অন্য আধিকারিকরা রাজ্যের নির্বাচিত শাসক গোষ্ঠীর তৈয়ার করা সরকারের কাছ হইতেই নির্দেশ লইয়া কাজ করিবেন, ইহাই বাঞ্ছনীয়। সেই কাজে ব্যর্থ হইলে নিশ্চয়ই তাঁহাদের শাস্তি হওয়া উচিত, কিন্তু তাহার জন্য শাসনতন্ত্রের ভারসাম্য বিপন্ন করা বিধেয় নয়। গণতন্ত্রের সামর্থ্য তাহার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর বিশেষ ভাবে নির্ভর করে। কাঠামো দুর্বল হইলে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়। |