|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ১... |
ঘুলঘুলিটা হারিয়ে গেল |
মস্ত দালান, খড়খড়িওলা জানলা, ছাদের চিলেকোঠাটাও। মন উদাস করা স্মৃতি উস্কে দিলেন ব্রাত্য বসু। |
নস্টালজিয়া তথা স্মৃতিমেদুরতা নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমার বহুশ্রুত একটি সরস গল্প তথা ‘জোক’ মনে পড়ে। গল্পটি নীচে বলা গেল
অযোধ্যা সিংহ নামক জনৈক সাধাসিধে অবাঙালি তরুণ বঙ্গদেশে এসে তার কিছু দুষ্টু বাজে বন্ধুদের প্ররোচনায় পা দিয়ে এক সন্ধ্যায় বোতলকয়েক ‘রাম’ খেলেন ও অচিরেই বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে মারা গেলেন। তখন সেই মতিচ্ছন্ন বন্ধুরা এই ঘটনাকে বর্ণনা করতে গিয়ে কী বলল? তারা বলল, “হায় সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই।”
বস্তুতপক্ষে তাইই। কারণ আমরা প্রধানত অতীতবিলাসী। অতীতের কথা ভাবলেই আমাদের চোখে জল আসে। আমরা তূরীয় অতীত রসাবেশে ভাববিহ্বল হয়ে যাই, সেই সব গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণালি পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যাওয়ামাত্র বর্তমানের কালিমাচ্ছন্ন বামনাকৃতি ধূলিধূসরিত অবক্ষয়িত চালচিত্রটির রুগ্ণ মানচিত্র আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। আমাদের তখন বামচক্ষুর কণীনিকাতে আসে জল, ডানচক্ষু ভরে ওঠে ব্যঙ্গাত্মক তীব্র হুলসম ক্রোধে। আমরা কাঁদি এবং কর্কশ হই। আর্তনাদ করি এবং নাশকতামূলক হই। আবেগাপ্লুত হয়ে উঠি এবং আঁশটে কষাটে রং করি জিভের।
মনে হয় মা কী ছিলেন আর মা কী হইয়াছেন? এই ধোঁয়াধুলোনক্ষত্র হরিত্ক্ষেত্র বিরচিত ধরিত্রীতে ভুল সময়ে জন্মে এ কী আজীবনের ভাগ্যবিড়ম্বিত নির্বাসন দিলে নেমেসিস, ভাগ্যদেবী? এমন দিনও চোখ মেলে দেখতে হল খোদা! হায় কী হারাইলাম জন্ম জন্মান্তরেও আর ফিরিয়া পাইব না।
কিন্তু কেন? আমাদের মতে তার কারণ দ্বিবিধ।
প্রথমত, আমরা অধিকাংশ সময়েই বর্তমান বুঝি না। অজ্ঞতার থেকে উদ্ধার পাওয়ার সব চাইতে সুবিধাজনক নিষ্পত্তি হল প্রত্যাখ্যান। একদম মানুষের প্রতি মানুষীর, বা মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহারের সঙ্গেই তা তুলনাযোগ্য।
দ্বিতীয়ত, অতীতকে ব্যাখ্যা করা যায়, বর্তমান বা ভবিষ্যত্কে আগাম অনুমান করতে হয়। একটি আপাত মূর্ত, অন্যটি সর্বতোভাবেই বিমূর্ত। একটিতে কল্পনাশক্তি ততটা লাগে না, অন্যটিতে কল্পনাই একমাত্র কল্পলতা। এহ বাহ্য।
তবে এ দু’য়ের বাইরেও আরও একটি সম্ভাবনা থাকে। তা হল অতীতের কথা মনে পড়ে যেহেতু নিজের অভিজ্ঞতার সূত্রেই, ফলত নিজের সামনে ভেসে ওঠে নানান বয়সের ‘আমি’, নানান বয়সের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তমালা, নানান রকমের মানুষ, তাদের সঙ্গে সংযোগে ও সংযোগহীনতায় ওই ‘আমি’র নানান অবস্থান। এবং যেহেতু প্রধানত আমরা আত্মরতিক্রান্ত ফলে নিজেকে আরও অল্প একটু ভালবেসে মনে পড়ে নিজের নানান সেই সব অবোধ সরল মুখমণ্ডল সমুদয়কে নিজের প্রতি করুণাকে।
আমরা নিজের প্রতি ‘ট্যাবুলা রাসা’ সদৃশ আত্মপ্রক্ষেপকে গুলিয়ে ফেলি তাই অতীত দিনের সঙ্গে, নিজেকে নিয়েই কাঁদতে কাঁদতে ভ্রমবশত বলে বসি তখন, আহা কী সুন্দর আর অপূর্বই ছিল সেই সব মুছে যাওয়া, উধাও হয়ে যাওয়া দিনগুলি রাতগুলি। এ সবই তবে শেষ পর্যন্ত জলের মতো ঘুরে ঘুরে নিজের সঙ্গেই সংলাপ রচনা।
তবু নরম রোম্যান্টিক সেই সব অতীত আর তার বদল হয়ে যাওয়া আজকের রুখোসুখো বাস্তব নিয়ে দু’কথা বলি। বলি তার কিছু সংকেত কিছু স্মারক নিয়ে। কোন কোন চিহ্নের মধ্যে ধরা পড়ছে আজকের দিন, আর হাওয়ার মধ্যে মিলিয়ে গিয়ে প্রস্তরীভূত হয়ে যাওয়া সেই সব অনতি অতীতপুঞ্জের ইশারাকে।
ফাটা ডিমে তা দিয়ে কোনও লাভ না পেলেও, মনস্তাপে তার জুড়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকলেও তা নিয়ে দু’কলি গাইতে ক্ষতি নেই কোনও, তাই বলছি। অযোধ্যা সিংহ-র করুণ পরিণতির কথা মনে রেখেও বলছি। |
|
আমাদের বিষয় আজ বাড়ি। পুরোনো বাড়ি। চকমিলান, দীর্ঘ দালান, বড় শার্সি, খড়খড়ি, পাথুরে স্থাপত্য বাইরে থেকে যাকে দেখলে সহসা দুর্গ বলে ভ্রম হতে পারে সেই রকম বাড়ি। সাহিত্য, সিনেমায়, থিয়েটারে যে যে বাড়ির কিছু চকিত বর্ণনা তথা উপস্থিতি আমরা পাই, কিন্তু আকাশচুম্বী হাইরাইজের ঝাঁক অধুনা যাকে একটা প্রায় যেন তাঁবু দিয়ে ঢেকে ফেলেছে আমাদের চোখের আড়ালে।
যে বাড়ি আমরা দেখেছি সত্যজিত্ রায়ের ‘জলসাঘরে’ বা পড়েছি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’-এ বা শুনেছি মহীনের ঘোড়াগুলির দিব্য মুখোপাধ্যায়ের গান ‘আকাশে ছড়ানো মেঘেদের কাছাকাছি দেখা যায় তোমাদের বাড়ি’ যাদের বর্ণনা পড়লে বা দেখলে বা শুনলে মনে হয় অধিবাস্তববাদের তাত্ত্বিক জন্ম মোটেও ফরাসি দেশে নয়, বরং আমাদের এই মোঘলশাসিত বা উপনিবেশপরিচ্ছিন্ন শস্যশ্যামলা বঙ্গদেশেই।
এই রকম এক অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ কিছু দিন আগেই দেখতে পেলাম কাশীপুর গঙ্গার ঘাটে। আমরা গেছিলাম সঞ্জয় নাগের ‘পারাপার’-এর শ্যুটিং উপলক্ষে। দশমীর পরের দিন, বিসর্জনের শু্যট, তবু ওই প্রায়ান্ধকার রাস্তায় অবস্থিত বাড়িটিকে বাইরে থেকে দেখে কেমন গা ছমছম করছিল। খোঁজ নিলাম। কিছু ভুজাওয়ালা ও ছাতুওয়ালা জানালেন তাঁরা বাড়িটি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানেন না। তবে ‘বহোত্ পুরানা হাভেলি’, এইটুকুই তারা বলতে পারেন।
কৌতূহল হওয়াতে ফিরে এসে খোঁজখবর করলাম। জানতে পারলাম বাড়িটি আসলে হাইকোর্টের প্রখ্যাত বিচারপতি স্যর ইলাইজা ইম্পের পরের বিচারপতি স্যর রবার্ট চেম্বার্স-এর। এই বাড়িতে বসেই প্রখ্যাত প্রাচ্যবিশারদ স্যর উইলিয়াম জোনস গাবদা গাবদা পুঁথি পড়তেন। এই সব পুঁথি পরে কিনে নিয়েছিলেন প্রুসিয়ার রাজা। বাড়িটি তখন এতটাই নির্জন আর ফাঁকা ছিল যে মানুষ যেত না। কেন? কারণ কাশীপুরে ওই জায়গায় নাকি প্রবল বাঘের উত্পাত।
ভাবছিলাম এখন যদি ওই সারিবদ্ধ প্রতিমার ট্রাক, ধোঁয়াধুনো, নৃত্যরত তাসাপার্টি, গাঁজার গন্ধ আর কাছেই আধা আলো-অন্ধকার মেশানো নদীজল থেকে একটি আস্ত শার্দূল উঠে আসত, কী হুলস্থূলই না হত। হায় সেই বাড়ি নেই, সেই মেজদা নেই, সেই ‘উয়হ ব্যয়ঠা’ বলে লম্ফমান অবাঙালি দ্বাররক্ষকও নেই। “চূড়ামণি দত্ত ধনসম্পদে মহারাজা নবকিষেনের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কিন্তু মহারাজের ন্যায় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি তাহার না থাকায় তিনি অস্থির হইয়া উঠিয়াছিলেন। অতঃপর তদানীন্তন ধনী শিখ ব্যবসায়ী হুজুরিমলের পরামর্শে তিনি তাঁহার বিখ্যাত ভবন নির্মাণ করিলেন। তাঁহার উক্ত ভবনের একটি ক্ষুদ্র কক্ষ ও প্রকোষ্ঠ এখনও স্বস্থানে সগৌরবে দণ্ডায়মান।” (উত্তর কলকাতার বসতবাটি: ঠাকুরদাস কুশারী) |
|
কিন্তু মধ্যবিত্তের বাড়ি? যাকে কেন্দ্র করে পাই স্বপ্ন ও স্বপ্নপূরণ, আকাঙ্ক্ষা আর প্রাপ্তির এক যোজন যোজনব্যাপী ইতিবৃত্ত। তার শুধু সোজা ইতিহাস নয়, উল্টো ইতিহাসও ছিল কিছু।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বাঙালি শুধু কলকাতায় তার ঠাঁই খোঁজেনি, শহরেও খালি গড়ে ওঠেনি সেটেলমেন্টের কাহিনি, কেউ কেউ সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেও চেয়েছেন। ফিরে যেতে চেয়েছেন শিকড়ে, তার নিজস্ব উত্সে।
শহরের সঙ্গে সহবাসে ক্লান্ত এমনই এক বেখাপ্পা মানুষের কথা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে গেছেন তাঁর ‘ভণ্ডুলমামার বাড়ি’ গল্পতে। লালমণির হাটে রেলে চাকরি করা ভণ্ডুলমামা কলকাতাতেই ভাড়াবাড়িতে পরিবারসুদ্ধ থাকতেন। তিনি শুরু করলেন হুগলির এক অজগ্রামে তাঁর কোঠাবাড়ি।
সেই বাড়ি তিনি বানালেন অবশ্য সারা জীবন ধরে। শেষ করতে পারেননি। চল্লিশ বছর পরে মারা যখন যাচ্ছেন ভণ্ডুলমামা, ওই বাড়ি শেষ করতে রিটায়ারমেন্টের পর সেই গ্রামে এসেই থাকছিলেন তিনি। ছেলেরা যথারীতি কেউ আসতে রাজি হয়নি। তাদের শিকড় যে শক্ত করে গাঁথা নগরের ভূমিতেই।
একটি বালকের চোখ দিয়ে ভণ্ডুলমামার বাড়িটি আমাদের দেখিয়েছেন বিভূতিভূষণ। যে অর্ধনির্মিত বাড়িটি দেখলে ওই বালকের মতো আমাদেরও মনে হবে, “শীতের সন্ধ্যায় গোয়ালে সাঁজালের ধোঁয়ায় আমাদের যে পুকুরপাড়টা ভরে যেত, বনের গাছপালাগুলো, যেন অস্পষ্ট, যেন মনে হত সন্ধ্যায় কুয়াশা হয়েছে বুঝি আজ, সেই দিকে চাইলেই মনে হত আমার অমনি মনে পড়ত ভণ্ডুলমামার সেই আধতৈরি কোঠাবাড়িটার কথা এমনি শেওড়া বনে ঘেরা পুকুরপাড়ে....”।
পাশাপাশি ‘বেনীগীর ফুলবাড়ি’ নামক এক আশ্চর্য গল্পে ওই রকম আলোআঁধারি রহস্যে মেশা বৃহত্ বাংলোর বর্ণনাও দিয়েছেন বিভূতিভূষণ।
যে বাড়িতে আছে, “কালো পাথরের হাতির মুখ, মকরমুখের পয়ঃনালী, হাতভাঙা লোহার বেঞ্চি, চটাওঠা ঠেসগাঁথা চাতাল, জঙ্গলের নীচে লতায় পাতায় কাঠবেড়ালির লঘুপদে ত্রস্ত যাওয়া আসা...একটা পাথরে গাঁথা শুকনো ফোয়ারা ধারে ঘন চামেলির ঝোঁপ, চামেলি ফুলের মিষ্টি সুবাস।” যে বাড়িতে ঘুম ভেঙে সদ্য ওঠা রাজকুমারীর মতোই, বাণভট্টের কাদম্বরীর মহাশ্বেতার মতোই সন্তর্পণে ঘুরে বেড়ায় দেহাতি সুন্দরী মণিয়া। ‘কালো দরজা খুলে তুমি এলে। তোমার এলো চুল ওই বাতাসে ওড়ে’।
সে বাড়ির সত্যিই আর ঠিকানা নেই, তা অজানা এক রাস্তার মতোই সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের স্বপ্নে, বিরামে, অবসরে, অজস্র দৌড়, অবিরাম হনর্ আর হরেক রকম সিগন্যালের মাঝখানে মাঝরাস্তায় একদম সটান চোখ বুজে দাঁড়ালে শুধু সেই বাড়ি আর মণিয়ারা ফিরে ফিরে আসে।
বাড়ির ইতিহাস সত্যিই রহস্যময়। একটি মানুষের জীবনবৃত্তান্তের মধ্যে যেমন সময় তার নানান পদচিহ্ন রেখে যায় বাড়িও সে রকম। একেবারে নদীর মতোই। আর তার বদলে যাওয়া বাসিন্দারাও যেন সেই চিহ্নসমুদয় বহন করে এমনকি নিজের অজ্ঞাতেও।
সেই যে রমাপদ চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘বাড়ি বদলে যায়’ আর তার সঙ্গে বদলে যায় অধিবাসীদের সুলুক। রাজা রামমোহন রায়ের বাড়িটি যে পুলিশচৌকি হয়েছে উত্তরে এ তো প্রায় সকলেই জানে। কিন্তু ক’জন জানত (আমি তো অন্তত জানতাম না) পার্ক স্ট্রিটের পাশে বেঙ্গল ক্লাবের বাড়িতে থাকতেন এক সময় লর্ড মেকলে বা এখন যেখানে পুলিশ কমিশনারের বাড়ি, সেটি আসলে ব্রিটিশ আমলের শ্রেষ্ঠ রফতানিকারক জন পামারের বাড়ি ছিল।
এই রকম বদলের ইতিহাস অজস্র। সর্বোত্তম যদিও আমাদের মতে যেটি তা হল ওল্ড কোর্ট হাউসের সামনে একটি বড়োসড়ো থিয়েটার অডিটোরিয়াম ছিল। সিপাহি বিদ্রোহের সময় কিছু বিদ্রোহী সেপাই সেটাকে দখল করে তোপখানায় পরিণত করলেন। মানে একমাত্র থিয়েটারের মঞ্চ থেকেই যে কামানের গোলা ছোড়া সম্ভব, এ কথা ওই বিদ্রোহীরাও বুঝেছিলেন।
সত্যজিতের চারুলতা অবশ্য উত্তর কলকাতার এই রকমই একটা বড় বাড়ির খড়খড়ি দিয়ে রাস্তাঘাট ফিরিওয়ালা বা ঈষত্ ভ্রাম্যমাণ মানুষজন দেখতেন। একেক জন বিচিত্র মানুষ আবিষ্কারই ছিল তাঁর অলস মধ্যাহ্নের নিশ্চিন্ত কৌতুক।
এ যেন সেই জীবনানন্দের কবিতার মতো,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো
তবে আমি হেঁটে চলে যাবো মানে মানে।
আমরাও কি জীবনানন্দের সেই ‘ভিখিরী’র মতো নই, যারা এই শহর থেকে প্রত্যাশা করি কোনও না কোনও বিস্ময়ের কৌতুক এ শহর আমাদের চোখে ঢেলে যাবে অনবরত?
সবার ক্ষেত্রে যদিও হয় না তা। তারিণীর কথাই ধরা যাক। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী তারিণীর কথা আমাদের বলেছিলেন, ‘তারিণীর বাড়ি বদল’ গল্পে। ভাড়াটে উচ্ছেদ ও নিম্নবিত্ত মানুষের কম ভাড়ায় বাড়িসন্ধানের এই গল্পের মধ্যেও কি রয়ে যাচ্ছে না, চারুর সেই বৃহত্ বাড়ির উপর থেকে দূরবিন যন্ত্রে দেখা এমন সব মানুষের কাহিনি, যা আমাদের চেনাশোনার মধ্যেই ঘটে অথচ যাকে আমরা সত্যিই চিনতে শিখিনি। কয়েকটিমাত্র নির্মোহ আঁচড়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী নিয়ে আসেন সেই সব মানুষ তথা বদলে যাওয়া বাড়ির ইতিবৃত্ত, তারিণীর বুকের উপর দিয়ে চলে যাওয়া ঠেলা, প্রতিবেশীদের বারো ঘর এক উঠোনসদৃশ বিভিন্ন গাছাগল্প আর তার মধ্যেই “অদূরে লম্বা টর্চ হাতে তারিণীর পরিত্যক্ত ঘরের দরজার তালা খুলতে খুলতে বাড়িওলা নতুন কোনও একটি ভাড়াটেকে বাড়ির জলকল, পায়খানা ও রসুইঘরের চমত্কার ব্যবস্থার কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনাচ্ছে।”
তবে এই সব বাড়ি তো এখনও আছে, আছে এই সব বাড়ি থেকেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ট্যাংকি সাফ’-এর কাদাকালি পরিষ্কারের কাহিনি বা মতি নন্দীর ‘ছাদ’-এ ধরা পড়বে এই সব বাড়ির আনাচকানাচ। তুচ্ছ সব হৃত্পিণ্ডের অনন্ত জীবনকাহিনি।
চারুর মতো আমরাও দূরবীন দিয়ে প্রাকারশীর্ষ থেকে এই সব বাড়ির ভেতরপানে তাকাই, ক্যামেরাও চলে, সন্তর্পণে ট্রলির উপর থেকে ক্যামেরা ঢুকে পড়ে এই সব মহল্লার একেবারে ভেতরপানে যার নিদর্শন সব থেকে বেশি ধরে রেখেছে অবশ্য বাংলা সিনেমা।
অবশ্যই বাংলা সিনেমা। পুঁজির স্বল্পতার কারণেই হোক বা মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের গাথাকাহিনি বলার জন্যই হোক, দশকের পর দশক ধরে বাংলা সিনেমার বাঘা বাঘা পরিচালকেরা মায় তাদের ইউনিটসুদ্ধ এই ধরনের একটি (কখনও বা একাধিক) বাড়ি বেছে তার ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। মাসের পর মাস থেকেছেন। কখনও বোলপুর, কখনও শিমুলতলা, আবার কখনও বা মহিষাদলে। ওখানেই বাজারহাট, দুপুরে ও রাতে পঙ্ক্তিভোজনসহ খাওয়াদাওয়া, গল্পগসিপ, হাসিতামাশা, তার পর ঘুমিয়ে পড়া।
‘জলসাঘর’-এর সেই আশ্চর্য বাড়ি মনে তো পড়বেই, কিংবা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘ফেরা’র সেই বাড়িটি? প্রায়ান্ধকার ঘর, সামনে গাছের ছায়া পড়া দীর্ঘ বারান্দা, দুপুরবেলা দূরে পাখির ডাক নায়িকা গুনগুন করে গাইছেন, ‘পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়’। বা ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘বাড়িউলি’? কিংবা অজয় করের একাধিক ছবি। সেই ‘হারানো সুর’ থেকে ‘দত্তা’?
কত সিনেমায় আমরা দেখেছি মিসেস সেন গটগট করে বেরিয়ে আসছেন, তাঁর ঈষত্ গর্বোদ্ধত শীতল মুখমণ্ডল আর হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে সাদা চকখড়ি রঙের লম্বাটে বালিগঞ্জ বাড়ির ভিতর থেকে। বাড়ির পোর্টিকোর ভেতরে দাঁড়ানো রয়েছে আরও লম্বাটে চুকচুকে গাড়ি। মিসেস সেন উঠবেন আর সাদা স্যুট পরা সোফার সালাম জানিয়ে স্টার্ট দেবে। বাগান পেরিয়ে দেউড়ি আর ফটক থেকে বেরিয়ে ওই বালিগঞ্জি বাড়িটাকেই যেন পুরো দীন দিওয়ানা করে বাঁ দিকে বেঁকে যাবে মিসেস সেন সমেত ওই নাম না জানা বড়লোকি চালমারা দেমাকি গাড়ি।
তবে এই সব বাড়ির পাশাপাশি সেই বাড়িও কি আর আছে? একান্নবর্তী পরিবারের দেওয়ালচটা টানা ঘর আর বারান্দা সমেত একতলা সেই সব বাড়ি যার ভেতর থেকে উপরে উঠে গেছে ছাদে যাওয়ার কালচে সিঁড়ি, বারান্দার সামনেই পিচ্ছিল উঠোন, যে বারান্দা বেরিয়ে বাড়ির বাসিন্দারা যান রান্নাঘর বা বাথরুমে।
এই রকম এক বাড়িই প্রায় বাংলা ছোটগল্পের মতোই আনুপূর্বিক ডিটেইলে দেখিয়েছিলেন তপন সিংহ তাঁর ‘গল্প হলেও সত্যি’-তে। যে বাড়িতে শরিকি ভাইয়েরা থাকে, কাজিয়া করে নিজেদের মধ্যে, বাড়ির বৌরা দুপুরে প্রসাদ, নবকল্লোল পড়ে আবার সন্ধেয় ঝগড়া করে। যে বাড়িতে অবশেষে সমস্ত সমস্যার মুশকিল আসান হয়ে আসবে এক দেবোপম খর্বকায় সেবক তথা ভৃত্য যার নাম রবি ঘোষ, যিনি এসে সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন অনায়াসে।
সেই একান্নও নেই, বাহান্নও নেই। যাহা তিপ্পান্নও বলাই বাহুল্য নেই। এই দু’রকম বাড়িই আমাদের অবচেতনে লীন হয়ে আছে খানিকটা কুয়াশা আর খানিকটা ব্রাশস্ট্রোকমারা আলো নিয়ে, মাঝেমাঝে গতজন্মের স্মৃতির মতো যা ভাসমান অবস্থায় হাজির হয় আমাদের তলতলে ঘিলুতে।
তবে অনেক দিন পর ওই রকমই একটি বাড়ি দেখলাম অঞ্জন দত্তের ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’-তে। সেই শরিকি বিবাদ, আশ্চর্য ছাদ আর রাস্তা দেখতে না পাওয়া গুমোট ঘর, স্যাঁত্সেঁতে যৌনগন্ধ বেরোচ্ছে যে বাড়ির প্রতিটি কানাচ থেকে। কমল মিত্রের মতোই ড্রেসিং গাউন আর চশমা পড়ে সে বাড়িতে ঘুরছে উকিল বড়দত্ত, ছেলে ছোটদত্তের সঙ্গে যার বিপুল ঝামেলা।
এই বাড়ি দেখলে মনে হয় কেউ যেন আজও তার ছাদে ডালবড়ি শুকায়, এলোচুলে কারা যেন ঝুঁকে তলার রাস্তা দেখে, সন্ধেবেলায় একটা একটা করে আলো জ্বলে ওঠে সিংহদুয়ার বরাবর। আর গভীর দুপুরে এই সব বাড়ির নিশ্চয়ই মনে পড়ে তার ভেতর থেকে কত দিন শু্যটিং করে চলে যাওয়া এক নায়ক তথা কবিকে, যিনি এই সব স্মৃতি মনে করেই হয়তো বা তাঁর কবিতায় বলেছিলেন, “দুপুরের কলকাতা আমরা এখানেই নামব। কাশী মিত্তির ঘাটের গলিতে দুপুরে একজন উদাস কাক... শুধু সময়টা দুপুর ২:৩০ হওয়া চাই” (অপারেশন থিয়েটার: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)।
র্যামসে ব্রাদার্সের কথা মনে পড়ে? সেই সাতভাই পালোয়ান যাদের নাম ছিল কুমার র্যামসে, কেশু র্যামসে, তুলসী র্যামসে, করণ র্যামসে, শ্যাম র্যামসে, গংগু র্যামসে আর অর্জুন র্যামসে।
এফ ইউ র্যামসের এই সাত ব্যাটা মিলে জমজমাট সব ভূতের সিনেমা বানাত। বড়ভাই লিখতেন, মেজোভাই প্রযোজনা করতেন, সেজোভাই সহ পরিচালনা করতেন, রাঙাভাই প্রযোজনা ডিজাইন করতেন, ন-ভাই পরিচালনা করতেন, সোনাভাই ক্যামেরা করতেন, ছোটভাই অভিনয় করতেন। এ অনেকটা যেন, ‘আমি আছি, গিন্নি আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে/ সবাই মিলে কামড়ে দেবো মিথ্যে অমন ভয় পেলে’।
এঁদের বানানো কিছু সিনেমা হল পুরানা হাভেলি, বন্ধ দরওয়াজা, সান্নাটা, অউর কৌন, অন্ধেরা, পুরানা মন্দির ইত্যাদি ইত্যাদি। ভূত আর যৌনতা সাত ভাইয়ের সিনেমায় একেবারে মাস্ট। কিন্তু সে সব প্রসঙ্গ সরিয়ে রাখলে এই র্যামসে ব্রাদার্স তাঁদের সিনেমায় ‘মোটিফ’ হিসাবে প্রত্যেকবার একটি বাড়িকে নিয়ে এসেছেন। শ্যাম র্যামসে (জন্ম ১৯৫২) বলেওছিলেন এক সাক্ষাত্কারে, বাড়ি শুধুমাত্র তাঁদের কাছে ভৌতিক অনুষঙ্গ নয়, এক অর্থে অতীতও।
আমাদের দেখা, পড়া জানা আর শোনা এই সব বাড়িও কি অনেকটা সেই গা ছমছম অতীতের মতো নয়, যার ভেতরে ঢুকতে গায়ে কাঁটা দেয় এখনও? অবিকল সত্যজিত্ রায়ের ‘অনাথবাবুর ভয়’-এর মতো? বাইরে এক অনাথবাবু হাসতে হাসতে নিমডাল দিয়ে দাঁতন করছেন, অথচ সেই পুরোনো বাড়ির ভেতরেই ধূপধুনো গন্ধমেশানো ঘরের ফরাশের উপর টানাপাখার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছেন আরেক ঘাড়মটকানো ভেংচিকাটা অনাথবাবু, যাঁর সঙ্গে আমরাও যেন কান পেতে রয়েছি, উর্বশী বুটালিয়ার সেই বিখ্যাত গ্রন্থের শিরোনাম ‘দ্য আদার সাইড অফ সাইলেন্স’ এর মর্মরধ্বনি শোনার জন্য।
যদি একবার অনুভব করা যায়, যদি সর্বাঙ্গে মেখে নেওয়া যায় তার পুরোটা। কারা যেন সব ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই সব বাড়িতে। একবার চোখ কচলে তাকানো যেতে পারে।
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
সৌজন্যে: সূর্যশঙ্কর রায়। |
|
|
|
|
|