দেশ জুড়ে একটানা দু’দিনের ধর্মঘটে সাধারণ মানুষকে জেরবার করে ব্যাঙ্কের অফিসার ও কর্মচারীদের সংগঠনগুলি নিজেরাই এ বার দ্বিমুখী চাপে।
প্রথমত, যে-দাবিতে ধর্মঘট, কর্মী ও অফিসারদের সেই বেতনহার সংশোধন সংক্রান্ত বৈঠকই স্থগিত করে দিয়েছে ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষের সংগঠন অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্কস অ্যাসোসিয়েশন (আইবিএ)। কাল, বৃহস্পতিবার ওই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।
দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্ক ধর্মঘটে রাশ টানার আবেদন জানিয়ে উচ্চতর আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন এক নাগরিক। আইনজীবী কার্তিক কাপাস মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থের মামলা দায়ের করে আর্জি জানান, যখন-তখন ব্যাঙ্ক ধর্মঘট ঠেকাতে হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করুক। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে আজ, বুধবার মামলাটির শুনানি হতে পারে।
মঙ্গলবার, ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনেও ব্যাঙ্ক পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায় সমস্যায় পড়তে হয়েছে গ্রাহকদের। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পাশাপাশি বেসরকারি এবং বিদেশি ব্যাঙ্কের শাখাগুলিও বন্ধ ছিল। এ দিন সকালে কিছু বেসরকারি ব্যাঙ্ক তাদের কিছু শাখা এবং এটিএম খুলেছিল। কিন্তু ধর্মঘটীরা জোর করে সেগুলি বন্ধ করে দেন বলে অভিযোগ। তাই সাততাড়াতাড়ি ঝাঁপ বন্ধ করে দেয় ওই সব এটিএম। টাকা তুলতে যে-সব গ্রাহক এটিএমের সামনে জড়ো হয়েছিলেন, তাঁরা হতাশ হয়ে ফিরে যান। অনেকে দিশাহারা হয়ে পড়েন। যেমন হাজরার ৭০ বছরের বৃদ্ধ শ্রীপতি শর্মার দুই ছেলে। সোমবার রাতে বাড়িতে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন শ্রীপতিবাবু। তাঁকে নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়েছে। টাকার জন্য বিভিন্ন এটিএমে ঘুরেছেন তাঁর দুই ছেলে। কিন্তু টাকা মেলেনি। ব্যাঙ্কে নিজেদের অর্থ গচ্ছিত থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে কোনও রকমে পরিস্থিতি সামাল দেন তাঁরা।
শ্রীপতিবাবুর ছেলেদের মতো কোটি কোটি সাধারণ মানুষের স্বার্থ যে এই ধরনের ধর্মঘটের ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে, এ দিন সেই দিকে হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মামলার আবেদনকারী কার্তিকবাবুর কৌঁসুলি সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ব্যাঙ্ককর্মীদের দাবি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলতেই পারে। কিন্তু কোটি কোটি গ্রাহককে বিপর্যস্ত করে এ ভাবে ধর্মঘট করা যায় না। কারণ, ব্যাঙ্ককর্মীদের বেতন বৃদ্ধির দাবির ব্যাপারে গ্রাহকদের কিছু করার নেই।”
দু’দিনের ধর্মঘটে যে-ভাবে এটিএম-ও বন্ধ রাখা হয়েছিল, তার সমালোচনা করে সুব্রতবাবু বলেন, “দু’দিনের ধর্মঘটে মানুষ এটিএম পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। জমানো টাকা জরুরি প্রয়োজনেও তুলতে পারেননি!” সুব্রতবাবুর আর্জি, হাইকোর্ট এর একটা বিহিত করুক।
আজ, বুধবার ফের ব্যাঙ্ক খুললেও ব্যাঙ্ক শিল্পে শ্রমবিরোধ জটিল হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বেতন সংশোধন দ্রুত চূড়ান্ত করার দাবিতে সোম ও মঙ্গলবার দেশ জুড়ে ব্যাঙ্কের ঝাঁপ বন্ধ রেখেছে কর্মী-অফিসারদের ন’টি ইউনিয়ন। আইবিএ ঠিক করেছিল, বেতনকাঠামো সংশোধনের ব্যাপারে ওই সব ইউনিয়নের সঙ্গে তারা বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসবে। তাই তারা ধর্মঘটে না-যাওয়ার জন্য ইউনিয়নগুলির কাছে আবেদন জানিয়েছিল। তা সত্ত্বেও টানা দু’দিন ধর্মঘট হয়েছে। ক্ষুব্ধ আইবিএ তাই প্রস্তাবিত বৈঠক স্থগিত করে দিয়েছে।
ধর্মঘটী ন’টি ইউনিয়নের যৌথ সংগঠন ইউএফবিইউ-এর আহ্বায়ক নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “আইবিএ-র এই পদক্ষেপ চূড়ান্ত ভাবে অগণতান্ত্রিক। এর জেরে ব্যাঙ্ক শিল্পে শ্রমবিরোধ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হলে তার জন্য দায়ী থাকবে আইবিএ। আমরা ন্যায্য দাবি থেকে কোনও ভাবেই সরে আসতে পারি না।”
বৃহত্তর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন ইউএফবিইউ-এর অন্যতম প্রধান শরিক অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাজেন নাগর। তিনি বলেন, “আমরা আলোচনায় মীমাংসা চাই। কিন্তু আইবিএ সেই রাস্তা বন্ধ করে দিলে আমরা বড় মাপের আন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হব। আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে আমরা বৃহস্পতিবারেই বৈঠকে বসব।”
কী ভাবছেন ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষ?
আইবিএ-র চেয়ারম্যান কে আর কামাথের সংযত প্রতিক্রিয়া, “বেতন সংশোধন নিয়ে ইউনিয়নগুলির সঙ্গে আলোচনার জন্য একটি বিশেষ কমিটি আছে। বৈঠক করার ব্যাপারে তারাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।” |