সংক্রান্তিতে রাতে অন্নভোগ মাধবকে
জাঁকজমক কমেছে, তবে আড়াইশো বছরের প্রাচীন সাগর মাধব মেলার গৌরব ফিকে হয়নি আজও।
সুতাহাটা থানার গুয়াবেড়িয়া গ্রামে অধিকারী পরিবারের কূলদেবতা সাগর মাধব, মাধব ও নীলমাধবের মন্দিরকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই মেলা ‘সাগর মাধব মেলা’ নামেই পরিচিত। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির সময় মন্দির সংলগ্ন প্রাঙ্গণে এই মেলার আয়োজন করা হয়। জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষকদের মতে, গত দু’তিন দশক আগেও সাগর মেলার সঙ্গে সমান প্রাসঙ্গিক ছিল এই মেলা। আগে গঙ্গাসাগরে স্নান সেরে হাজার হাজার পুণ্যার্থী এই মেলায় আসতেন। সাগর মাধব মন্দির সংলগ্ন দিঘিতে স্নান করতেন তাঁরা। ইতিহাসের অধ্যাপক তথা আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক প্রণব বর্মন বলেন, “সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সুতাহাটা এলাকায় জনবসতির বিস্তার হয়। মূলত তীর্থযাত্রীরাই এখানে বসতি স্থাপন করেন। এখান থেকে প্রতি বছর মকরসংক্রান্তি উপলক্ষে তাঁরা কপিলমুনির আশ্রমে যেতেন। জানা যায়, সাগর মাধব মেলা দোরো পরগনার প্রথম প্রসিদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।” তিনি জানান, অনেক নাগা সন্ন্যাসীও ক্রমে এখানে বসবাস করতে শুরু করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, যাঁরা সাগরে স্নান করতে যেতে পারতেন না, তাঁরা এই মন্দির সংলগ্ন দিঘিতে স্নান করতে আসতেন। ভক্তদের বিশ্বাস ছিল, এখানে স্নান করলেও সাগর স্নানের সমান পুণ্যফল পাওয়া যায়।
প্রাচীন সেই তিন মূর্তি।—নিজস্ব চিত্র।
কথিত আছে, গুয়াবেড়িয়া গ্রামের ভক্ত ব্রাক্ষণ গোবিন্দরাম সঙ্গীদের নিয়ে হুগলি নদী পথে গঙ্গাসাগরে যাওয়ার পথে সাগরের জলে আহ্নিক করার সময় সাগর মাধবের মূর্তিটি পান। সাগর থেকে ফেরার পথে স্বপ্নাদেশ পেয়ে নদী থেকে আরও দু’টি মূর্তি পান তিনি। স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশ অনুযায়ী, ওই তিনটি মূর্তি তিনি প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে সাগরে নিয়ে যেতেন। পরে গ্রামে মন্দির তৈরি করে তিনি ওই মূর্তিগুলি প্রতিষ্ঠা করেন। কাঁথির মাজনামুঠার জমিদার যাদবরাম রায়চৌধুরী সাগর মাধবের সেবার জন্য ৩৬৫ বিঘা জমি দান করেন। তারপর থেকেই গোবিন্দরামদের পদবি ‘অধিকারী’ হয়। বংশ পরম্পরায় তাঁরাই মাধবের নিত্যসেবার পাশাপাশি এই মেলাও পরিচালনা করে আসছেন। ঐতিহাসিক যোগেশচন্দ্র বসুর ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, মূর্তিগুলি অতি প্রাচীন। নীল প্রস্তরে নির্মিত বৌদ্ধযুগের ওই মূর্তিগুলির নির্মাণ প্রণালী দেখলে আশ্চর্য হতে হয়।
জানা যায়, আগে মন্দির সংলগ্ন ওই দিঘি তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি জলপথের মাধ্যমে হোড়খালিতে হুগলি নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। ওই জলপথেই সাগর মাধবকে গঙ্গাসাগরে নিয়ে যাওয়া হতো। সেই জলপথ বর্তমানে মজে গিয়েছে। অধিকারী পরিবারের প্রবীণ সদস্য নিরঞ্জন অধিকারী বলেন, “একসময় কিছু নাগা সন্ন্যাসী ওই মূর্তিগুলি পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেজন্য তাঁরা মন্দিরের কিছু দূরে আস্তানাও গড়েন। সেই স্থানটি আজও নাগার মঠ নামে পরিচিত। সাগর মাধবের নামে এলাকায় মাধবচক ও মাধবগঞ্জ নামে দু’টি গ্রামও রয়েছে। বর্তমানে মন্দিরের তিনটি মূর্তি সংলগ্ন দিঘিতেই স্নান করানো হয়। আগে সাগর যাত্রীরা স্নান সেরে ফেরার পথে ওই দিঘিতে স্নান করে সাগর মাধব মন্দিরে পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরতেন।” ওই পরিবারের অপর এক সদস্য চিন্ময় অধিকারী বলেন, “প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন এই মেলায় আগে একমাস ধরে দূর-দূরান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা আসেন। তাঁদের বিশ্বাস, সাগরতীর্থে ভ্রমণের পর মাধব মন্দিরে না এলে পুণ্যলাভ অপূর্ণ থেকে যায়।”
প্রণববাবু জানান, আগে মেলায় দূর থেকে আসা দর্শনার্থীদের অনেকে এখানে থেকে যেতেন। এক মাস ধরে মেলা চলত। মেলায় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যাত্রা, থিয়েটার, পালাকীর্তন, তরজা গানের আসর বসানো হত। ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতারও আয়োজন থাকত। মন্দিরের তিন মাধব সারা বছর দিনে অন্নভোগ গ্রহণ করেন। পৌষ সংক্রান্তির দিনই একমাত্র মাধবকে রাতে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে মেলায় ‘পদরি মিঠাই’ ও ‘গুড় খইয়ের মোয়া’ বিক্রি হয়। তবে এখন মেলার ব্যাপ্তি কমে পনেরো দিনে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, “গত দু’তিন দশক আগেও নাগা সন্ন্যাসীরা এখানে আসতেন। তবে মেলার সেই জৌলুস এখন আর নেই। দর্শনার্থীরা মূলত সরোবরে স্নান ও মাধব মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্যই আসেন। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বন্দর ও কলকারখানার জন্য মন্দিরের দেবোত্তর জমির অনেকটাই অধিগ্রহণ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আর্থিক সমস্যার কারণেও মেলার জাঁকজমক কমেছে অনেকটাই। তবে জৌলুস কমলেও প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এই মেলার ঐতিহ্য আজও অটুট।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.