প্রবন্ধ ১...
শহরের জনপরিবহণ: মৃত্যু না হত্যা?
রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে গেছে প্রায় তিন বছর। কিন্তু সরকারের কোনও কোনও দফতরের কাজকর্ম দেখলে মনে হয় যেন কোনও পরিবর্তনই হয়নি, বামফ্রন্ট জমানাই সমানে চলছে! সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় পরিবহণ দফতর। মদন মিত্র মহাশয় বামফ্রন্ট সরকারের প্রয়াত পরিবহণমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী মহাশয়কে মডেল করে রাজনীতি শুরু করেছিলেন কি না জানা নেই, কিন্তু দু’জনের মধ্যে যারপরনাই মিল। দু’জনেই একাধারে পরিবহণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী, দু’জনেই নিজ নিজ দলে ডাকসাইটে গোটানো নেতা হিসেবে খ্যাত, দু’জনেই মন্ত্রিত্বের পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে, দু’জনেরই ক্ষেত্রবিশেষে ভাষার ওপর লাগাম কম, গিমিকে আগ্রহ প্রবল এবং সর্বোপরি গণপরিবহণকে গোল্লায় তোলার জন্য দু’জনেই সমকৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। পরিবহণমন্ত্রী হিসেবে দু’জনের কাজের ধরনের এত মিল যে, মনে হয়, মদনবাবু শুধুমাত্র সুভাষবাবুর ফাঁকা চেয়ারেই বসেননি, তাঁর ছেড়ে যাওয়া ব্যাটনটাও হাতে তুলে নিয়েছেন। উদাহরণ অজস্র ও যেন একে অন্যের অ্যাকশন রিপ্লে।
যেমন পাবলিক বাস। এক সময় কলকাতা শহর সারা দেশের মধ্যে পাবলিক বাসের ক্ষেত্রে একেবারে প্রথম সারিতে ছিল। ১৯৪৫ সালের ১ এপ্রিল, কোচবিহারের মহারাজা শুরু করেন নর্থ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন, যা দেশের মধ্যে প্রথম। সেই থেকে শুরু করে সত্তরের দশক, এমনকী আশির দশকের একটা বড় সময় ধরে বাসের রমরমা ছিল। তার পর থেকেই জনসাধারণের এপ্রিল ফুল হওয়ার পালা শুরু। এর প্রথম ধাপ ছিল গণপরিবহণ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বেসরকারি হাতে চলে যাওয়া। যোগ হল দিশাহীন রাজনীতি। ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’ আর ‘কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও’-এর কল্যাণে আর পাশাপাশি নানান দুর্নীতির দুর্বিপাকে পড়ে বাসসমেত সরকারি পরিবহণ ক্রমেই অলাভজনক হয়ে উঠল (বা অনেকে বলেন, হিসেব কষে অলাভজনক করে দেওয়া হল)। সেই ফাঁকা জায়গা অনেকাংশে দখল করল বেসরকারি বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সি এবং কালক্রমে অটো রিকশা। এদের অনেকেই সরকারে থাকা দলকে নিয়মিত নজরানা আর মিটিং-মিছিলে লোক ভরাতে বাস পাঠিয়ে যাবতীয় নিয়ম ভাঙার লাইসেন্স পেয়ে গেল। বেসরকারি বাসের মালিক, ইউনিয়ন আর সরকারের মধ্যে এক অদ্ভুত যোগসাজশের ফলে যাত্রীদের ভাগ্যে জুটল ভাঙা কাঠের সিট, প্রায় লাফ মেরে উঠতে হয় এমন উঁচু ও সরু গেট আর ছোট ছোট জানলার আলো-বাতাসহীন এক অন্ধকূপ যান। যত দিন না প্রধানত পরিবেশ দূষণের কারণে আদালতের নির্দেশে এই সব বাসের বড় অংশের পরিবর্তন ঘটেছে, এমনটাই ছিল দস্তুর।
সুভাষবাবুরা যদি সরকারি বাসকে সৎকারে তুলতে ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন, তবে মদনবাবু বাধ্য ছাত্রের মতো পরের চ্যাপ্টারে হাত দিয়েছেন। প্রাইভেট বা বেসরকারি বাসদের ইতিহাস করার কাজ। আলু থেকে অটো রিকশার দাম বাড়লে সমস্যা নেই, কিন্তু প্রাইভেট বাসে নৈব নৈব চ। তাতেই নাকি জনগণের ভয়ানক অসুবিধা হবে! ভাবখানা পঞ্চাশের দশকে ট্রামের এক পয়সা ভাড়া বাড়ার বিরুদ্ধে বামপন্থী আন্দোলন থেকে আলাদা নয়। কিন্তু এর ফলে যদি প্রাইভেট বাস উঠে যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছয়, তবে যে সাধারণ মানুষের তাতে আরও অসুবিধা হবে, সে দিকে মন্ত্রী-মহাশয় তথা পরিবহণ দফতরের বিশেষ ভাবনাচিন্তা নেই। ফলে সরকারি বা বেসরকারি ভাবে ধর্মঘট চলছে, পাশাপাশি চলছে মন্ত্রী-মহাশয়ের ‘এমন দেব না’ গোছের বাইট। কিন্তু সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রাইভেট বাস ও মিনিবাস মালিকদের ইউনিয়ন জানাচ্ছে যে, ইতিমধ্যেই প্রায় এক-চতুর্থাংশ বাস বসে গেছে, কোনও কোনও রুটে প্রায় সব বাসই। সরকারি বাসের অবস্থা তো আগে থেকেই তথৈবচ।
দৈনন্দিন যানবাহনের ভাড়া মাত্রাতিরিক্ত না-বাড়াটা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পক্ষে জরুরি, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মজাটা হল, সরকারি নীতির কারণে বাস উঠে যাওয়ার ফলে আসলে অনেক বেশি টাকা খরচ করে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। পাশাপাশি কয়েকটি তথ্য অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সারা দেশের বড় শহরগুলির মধ্যে কলকাতায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যাত্রী গণপরিবহণে (প্রধানত বাসে) ওঠেন (৫৪ শতাংশ), যদিও যাত্রী-সংখ্যা অনুযায়ী বাসের সংখ্যায় কলকাতা সবচেয়ে পিছিয়ে। কলকাতায় প্রতি ১ লক্ষ যাত্রীর জন্য ৮টি বাস আছে, দিল্লিতে ৭৮। এটা বছর পাঁচেকের পুরনো তথ্য। সাম্প্রতিক অতীতে যে পরিসংখ্যানের ফারাকটা আরও বিস্তৃত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
তবে শুধু বাসের ক্ষেত্রে নয়, ট্রাম থেকে অটো রিকশা, সব ধরনের গণপরিবহণের ক্ষেত্রে দিশাহীনতাই যেন দিশা। প্রসঙ্গত, অটো রিকশা বিধিমতে ব্যক্তিগত পরিবহণ হলেও, কাজ করে গণপরিবহণ হিসাবেই। যদিও গণপরিবহণের সুবিধা না পান যাত্রীরা (যেমন সরকারি নিয়ন্ত্রিত ভাড়া), না কর্মীরা (নির্দিষ্ট মাইনে, ইনশু্যয়োরেন্স ইত্যাদি)। ঝুলি ঝেড়ে পরিবহণ দফতর বামফ্রন্ট সরকারের একটি পুরনো প্রেসক্রিপশন বের করে এনেছে ট্রামের ক্ষেত্রে। পরিবহণ দফতর তথা রাজ্যের শূন্য কোষাগার সমৃদ্ধ করতে ট্রামের উদ্বৃত্ত জমি ব্যবহার করে (বেচে দিয়ে) টাকার ব্যবস্থা করা। উদ্বৃত্ত জমির ঠিক ব্যবহার করে ট্রাম তথা পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির বিরোধিতা কেউ করবেন না, কিন্তু ভাবটা খানিকটা ট্রাম তুলে দিয়ে টাকার ব্যবস্থা করো। মনে রাখতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকার বার বার ট্রাম ব্যবস্থার উন্নতিতে সাহায্যের কথা বললেও, রাজ্য সরকারের হেলদোল দেখা যায়নি। মাথাই যখন রাখব না, তখন মাথাব্যথা কীসের!
পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কলকাতার জন্য নির্দিষ্ট ‘বেঞ্চমার্ক’ শহর লন্ডন থেকে শুরু করে সারা পৃথিবীর যাবতীয় বড় বড় শহরে ট্রাম প্রবল ভাবে ফেরত এসেছে আবহাওয়া পরিবর্তন ও দূষণের প্রতিষেধক হিসেবে, কিন্তু কলকাতার পরিবহণ ব্যবস্থা পিছনের দিকে এগিয়ে চলেছে। অটো রিকশার ক্ষেত্রেও পরিবহণ দফতর এক-এক সময় এক-এক কথা বলছেন বা কাজ করছেন, এবং যাদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে বিশেষ সামঞ্জস্য নেই। কিছু দিন আগে এক দিকে পরিবহণ দফতর বেশ অনেকগুলি নতুন রুটের অটোকে অনুমতি দিলেন, উল্টো দিকে বলতে শুরু করলেন, অটোকে এখন থেকে গলিঘুঁজি দিয়ে যেতে হবে। পরিবহণকে আপনি রুট দিচ্ছেন, মানে হল গন্তব্যের শুরু ও শেষ বিন্দুর মধ্যে থাকা মানুষজন সেই পরিবহণে ওঠার হকদার। এবং তা না হলে রুটের ফর্মুলা খাটে না, সাধারণ যাত্রীরাও সমস্যায় পড়েন। অন্য দিকে, অধিকাংশ অটোর নিয়ম মানা (বলা ভাল না-মানা), চার জন যাত্রী বসা নিয়ে বারংবার চাপান-উতোর হচ্ছে, হাইকোর্টের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শহরতলি ও মফস্সলে বেআইন ও দূষিত অটো চলছে, কমিটির পর কমিটি হচ্ছে, কিন্তু দিশাহীনতা বাড়ছে বই কমছে না।
কেন এই আপাত-দিশাহীনতা? লক্ষ লক্ষ ভ্যানো’কে নিয়মমাফিক করার কথা ভাবা হচ্ছে, কয়েকশো ‘নো রিফিউজাল’ ট্যাক্সি বের করে, বাকি হাজার হাজার ট্যাক্সিকে প্রত্যাখ্যান করার ঘুরিয়ে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিল, রাজ্যপাটে নতুন আশার কারণে ও নানা সমস্যায় জেরবার হয়ে বোধহয় পরিবহণ দফতরের এমন অবস্থা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা কমার বদলে বাড়া দেখে মনে হচ্ছে, হঠাৎ করে নয়, হিসেব করেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। নয়তো প্রথম প্রথম বিরোধিতা করলেও এখন এটা স্পষ্ট যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এখন এটা বুঝেছেন যে, আর্থিক নিয়মেই কোথাও কোথাও দাম বাড়ানো প্রয়োজন। তাই বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, বেড়েছে দুধের দাম, এমনকী এই পরিবহণ দফতরই ‘জে এন এন ইউ আর এম’-এর পয়সায় কলকাতা শহরে ‘উঠলেই কুড়ি টাকা’ এমন এসি বাস বার করতে চলেছেন। শুধুমাত্র পাবলিক ট্রাম-বাসের ভাড়া প্রয়োজন মতো বাড়াতেই যত বিরোধিতা, এবং তা এখন পর্যন্ত শুধু পরিবহণ দফতর নয়, রাজ্য সরকারের নীতি বলেই মনে হচ্ছে। কারণটা সম্ভবত এই যে, মদনবাবু কোথাও কোথাও সংকেত দিয়ে ফেলেছেন, প্রয়োজন হলে সরকার হাজার হাজার ম্যাজিক (অটোর থেকে কয়েক জন বেশি যাত্রী নিতে পারে, অটোর বড়দা বললে অত্যুক্তি হয় না) গাড়ি বের করে ফেলবে যাত্রীসাধারণের সুবিধার্থে! শহরতলি বা গ্রামে আসবে ভ্যানো। বোধহয় বস্তুত শূন্য কোষাগারে চলা রাজ্য সরকারের কাছে এটাই আগামী দিনে কর্মসংস্থানের মডেল, এদের মাধ্যমে রাজ্য রাজনীতিতে কর্তৃত্বে থাকার মডেল। তার জন্য কলকাতা শহর তথা রাজ্যের পরিবহণ ব্যবস্থা গোল্লায় উঠলে, সাধারণ মানুষের সমস্যা আর খরচ বাড়লে, দূষণে জেরবার হলে কারই বা কী আসে যায়?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.