সতর্ক করেছিলেন বাবা-মা, প্রাণ নিল চোরা গর্ত
সাঁতার না জানা ছেলেকে বারবার সতর্ক করেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু কাজে এলো না সেই সাবধানবাণী। কারণ, অবৈধ ভাবে বালি কাটার ফলে হাঁটুজলেই তৈরি হয়ে রয়েছে চোরা গর্ত, অজয়ের পাড়ে এ নিয়ে ছিল না কোনও সতর্কবার্তা।
প্রতিদিনের মতো সকাল পৌনে ৯টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোনোর যখন তোড়জোড় করছিলেন লক্ষ্মণ গড়াই, মোবাইলে এল দুঃসংবাদ, অজয়ে নেমে তলিয়ে গিয়েছেন ছেলে প্রশান্ত (২২)। বিকেল ৩টে নাগাদ দেহ উদ্ধারের পর থেকে কেঁদে চলেছেন দুর্গাপুরের আড়রা শ্রীপল্লির লক্ষ্মণ গড়াই ও তাঁর স্ত্রী মঞ্জুদেবী।
প্রশান্ত গড়াই।
মঙ্গলবার বীরভূমের জয়দেব মেলায় গিয়ে তলিয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রশান্তর। এ দিনই অন্ডালের কুঠিডাঙায় দামোদরে মকরস্নান করতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছেন দুর্গাপুরের গোপালমাঠ বনগ্রামের আরও দুই যুবক, বছর বাইশের ঝন্টু ঘোষ ও একুশ বছরের পাপ্পু ঘোষ। রাত পর্যন্ত তাঁদের কোনও হদিস মেলেনি।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত দু’বছর ধরে বন্ধুদের সঙ্গে জয়দেব মেলায় যাচ্ছেন প্রশান্ত। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ বাসে চেপে দুই বন্ধুর সঙ্গে রওনা দেন। বেরোনোর আগে বাবা লক্ষ্মণবাবু ও মঞ্জুদেবী বারবার করে সতর্ক করেন, অজয় নদে নামলেও জল থেকে সাবধান। পাশের বাড়ি থেকে পাড়া, দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই ভিড় জমে যায় লক্ষ্মণবাবুর বাড়িতে। কয়েক জন প্রতিবেশীকে নিয়ে তিনি রওনা দেন জয়দেবে। বাড়িতে তখন মা মঞ্জুদেবী। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন দুর্গাপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের সংস্কৃত স্নাতকের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মেয়ে পূর্ণিমা। বিকাল ৩টের কিছু পরে অজয় থেকে দেহ উদ্ধার হয় প্রশান্তর। সে খবর আসতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা-মেয়ে। রাত পর্যন্ত কান্না থামেনি।
আড়রা শ্রীপল্লিতে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সুনসান প্রশান্তর বাড়ি।
লক্ষ্মণবাবু শুদ্ধ পানীয় জল ও ঠান্ডা পানীয়ের ব্যবসা করেন। একা সব দিক সামলে উঠতে পারেন না। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে প্রশান্ত বাবাকে সাহায্য করতে শুরু করেন। তখন থেকে দু’জন মিলেই ব্যবসা সামলাতেন। প্রশান্তের প্রতিবেশী উত্তম রুইদাস জানান, তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছান দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ। কিন্তু সেখানে পুলিশ-প্রশাসনের তরফে উপযুক্ত ব্যবহার করা হয়নি বলে অভিযোগ তাঁর। তিনি বলেন, “এক বার শুনি ডুবুরি আসবে রামপুরহাট থেকে, আবার কিছুক্ষণ পরে শুনি ডুবুরি আসবে কলকাতা থেকে। প্রতিবাদ করলে পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসে।” তিনি জানান, তাঁরা এক সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন, পিকনিকে যেতেন, বেড়াতেও বেরোতেন। উত্তমবাবু বলেন, “উদ্যোগী ছেলে ছিল প্রশান্ত। একডাকে হাজির হয়ে যেত। ও আর নেই, ভাবতেই পারছি না!”
সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিবেশীদের জটলা ছিল লক্ষ্মণবাবুর বাড়ির সামনে। লক্ষ্মণবাবু বললেন, “জানি না কী ভাবে আমি স্ত্রী-মেয়েকে সান্ত্বনা দেব। নিজেই এক এক সময় ভেঙে পড়ছি।” প্রশান্তদের আদি বাড়ি কাঁকসার কুলডিহায়। সেখানে এখনও তাঁদের জমি-বাড়ি রয়েছে। মাঝে মাঝেই প্রশান্তরা সেখানে যেতেন। সেখানকার বাসিন্দা তরুণকান্তি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ভাল ছেলে, মিশুকে ছেলে ছিল প্রশান্ত। দুঃসংবাদ আসার পর থেকে গ্রামেও সবার মন ভার।”
অন্ডালে তলিয়ে যাওয়া এক যুবকের স্বজন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকালে দুর্গাপুরের বনগ্রাম এলাকা থেকে কয়েক জন যুবক অন্ডালের কুঠিডাঙার কাছে দামোদরের পাশে পিকনিক করতে যান। দুপুর ২টো নাগাদ পাপ্পু ও ঝন্টু-সহ পাঁচ জন একটি নৌকায় চেপে দামোদরের অন্য পাড়ে মকরস্নানে যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেখানে স্নান করতে নেমেই এই বিপত্তি ঘটে। জলের তোড়ে প্রথমে তলিয়ে যান পাপ্পু। এর পরে একই ভাবে তলিয়ে যান ঝন্টু। সঙ্গে থাকা বন্ধুরা তাঁদের হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করলেও সফল হননি। পরে তাঁরা নৌকা করে কুঠিডাঙায় ফিরে ঘটনার কথা বাকিদের জানান। কান্নায় ভেঙে পড়েন বাকি বন্ধুরা। রাজীব ধর নামে তাঁদেরই এক জন বলেন, “আমরা পিকনিক করতে এসেছিলাম। এই রকম ঘটবে ভাবতেও পারিনি।”
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে স্থানীয় বাসিন্দারা জড়ো হন। পৌঁছয় পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দারা দেহ উদ্ধারের জন্য জাল নিয়ে আসার দাবি জানালেও পুলিশ জানায়, যেখানে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেটি বাঁকুড়া জেলার মধ্যে পড়ে। তাই এ বিষয়ে যা করার সেখানকার পুলিশই করবে। এর পরে স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। সেই সময়ে এক পুলিশকর্মীকে ধাক্কাধাক্কি করা হয় বলে অভিযোগ। পরে পুলিশ লাঠি চালায় বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এসিপি অজয় প্রসাদ লাঠি চালানোর কথা অস্বীকার করে বলেন, “দুই যুবকের খোঁজে আমাদের দিক থেকে বাঁকুড়া পুলিশকে সব রকম সহযোগিতা করা হবে।”

—নিজস্ব চিত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.