চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
যেখানে সৌন্দর্য আক্রান্ত হয় পাশবিকতার হানায়
বাস্তবের দৃশ্যরূপকে কল্পরূপে রূপান্তরিত করা চিত্রশিল্পের একটি প্রক্রিয়া। স্বাভাবিকতাবাদী চিত্রেও বাস্তব খুব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লিষ্ট হয়। রূপান্তর এতই সামান্য বা ‘মিনিমাল’ যে কল্পরূপের উপস্থিতি সেখানে খুব একটা শনাক্ত করা যায় না। ‘রূপ’ যখন স্বাভাবিকতা থেকে দূরে সরতে থাকে, তখনই প্রতিমাকল্পে কল্পরূপের আভাস আসতে থাকে। প্রতিচ্ছায়াবাদী চিত্রে রূপের যে সরলীকরণ, তাকে কল্পরূপ অভিধায় অভিহিত করা যায় না সব সময়। অবয়ব ভাঙতে ভাঙতে যখন নিরবয়বের দিকে যায়, তখন কল্পরূপ বিবর্তিত হয়। বিবর্তিত হতে হতে এক সময় শূন্যে পৌঁছায় যখন মূর্ততা পরিপূর্ণ বিমূর্ত হয়ে যায়।
অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দেবব্রত চক্রবর্তীর নবম একক প্রদর্শনীর ছবিগুলি দেখতে দেখতে কল্পরূপের এই নানাবিধ চরিত্র সম্বন্ধে ভাবনা জাগছিল। তাঁর ছবিকে বলা যেতে পারে কল্পরূপে রূপান্তরিত বাস্তব। প্রকৃতপক্ষে বাস্তবই তাঁর চিত্রীয় কল্পনার মূল ভিত্তি এবং প্রস্থানভূমি। সেখান থেকেই তিনি কল্পরূপের জগতে প্রবেশ করেন বাস্তবেরই গহন সত্যের উন্মোচনের জন্য। ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী তিনি। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেছেন ১৯৭১ সালে। এক জন লেখক ও শিল্পসমালোচক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। আমাদের ১৯৬০-এর দশকের আধুনিকতাবাদী চিত্রকলায় কল্পরূপের বিশেষ ভূমিকা ছিল। স্বাভাবিকতাবাদী ছবি থেকেও কল্পরূপ বা ফ্যানটাসি তৈরি হয়েছে। অভিব্যক্তিবাদী চিত্র থেকেও হয়েছে।
শিল্পী: দেবব্রত চক্রবর্তী।
এই প্রদর্শনীতে ছিল তাঁর দশটি ছোট বর্গাকার ক্যানভাসের উপর দশটি কালি-কলমে ড্রয়িং এবং অ্যাক্রিলিকে আঁকা ১৪টি বড় ক্যানভাস। ড্রয়িংগুলিতে সমাজ বাস্তবের প্রেক্ষাপট অনেক স্পষ্ট। ছোট ছোট ভাঙা ভাঙা রেখা অনেক সময়ই বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রবাহিত হয়ে গড়ে তুলেছে এক একটি রূপাবয়ব। পিঠে বড় ঝোলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। হতে পারে কাগজ কুড়োনোই তার পেশা। একটি কাগজ দু’হাতে তুলে সে পড়ছে। তাঁর মাথার কাছে উড়ছে দু’টি পাখি। কোমর পর্যন্ত জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক কিশোর। মাছ ধরেছে। তাঁর হাতে সেই মাছ। এ রকম সহজ আলেখ্যের পাশাপাশি জটিলতাও এসেছে। তখন সূক্ষ্ম রেখাজালিকা রচনা করেছে ছায়াতপ। অভিব্যক্তিবাদী অনুষঙ্গ গড়ে উঠেছে। অভিব্যক্তির ভিতর দিয়েই উঠে এসেছে কল্পরূপ। আভাসিত হয়েছে জীবনের নিভৃত করুণা।
ড্রয়িংগুলি সবই সাম্প্রতিক। বড় রঙের ক্যানভাসের মধ্যে কয়েকটি ছিল আগের রচনা। অধিকাংশই সাম্প্রতিক। এর মধ্যে একটি ছবি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে বাস্তব রূপান্তরিত হয়েছে কল্পরূপে। আভাসিত হয়েছে আজকের শুধু নয়, চিরন্তন সমাজবাস্তবতা ও মানবী পরিস্থিতির এক অমোঘ বার্তা। একটি জলকন্যা এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। অর্ধেক মৎস্য অর্ধেক মানবী এই মৎস্যকন্যা জলের ভিতর মাছেদের সঙ্গে খেলা করছে। রেখার প্রাধান্যে আঁকা অবয়বগুলি। এ পর্যন্ত বেশ আনন্দঘন পরিস্থিতি। এর পরই নেমে আসে শঙ্কার ছায়া। আকাশে উড়ছে একটি বাজপাখি। বিস্ফারিত ঠোঁটে সে দ্রুত নেমে আসছে জলকন্যার দিকে। সৌন্দর্য আক্রান্ত হতে চলেছে পাশবিকতা দ্বারা। বাস্তব জীবনে যে রকম ঘটে থাকে। কল্পরূপের সুষমার ভিতর দিয়ে এই ভয়াবহতার বার্তা তুলে আনছেন শিল্পী।
ম্যাজিক কার্পেট’ শীর্ষক ছবিতে শূন্য আকাশের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত একটি দরিদ্র বালক। একটি কার্পেটের উপর সে বসে আছে। বিস্ময়বিস্ফারিত করুণামাখা দৃষ্টি। কার্পেটটি জাদুসম্পৃক্ত। কেননা তা আকাশপথে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেটিকে। জীবনে যে বঞ্চিত, কল্পনায় সে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইছে। স্বপ্ন দিয়ে বাস্তবকে অতিক্রম করার প্রয়াস এখানে। স্বপ্নিলতা বিষয় হয়ে উঠেছে তাঁর অনেকগুলি ছবিতেই। মানুষের চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে যে ব্যবধান, তা থেকেই জেগে ওঠে স্বপ্ন। স্বপ্ন তো কল্পরূপেরই এক প্রকাশ। তাঁর এই শিরোনামের ছবিগুলিতে অবয়ব বিশ্লিষ্ট হয়েছে অভিব্যক্তিবাদী রীতিতে। বাস্তব থেকে দূরে সরে গিয়ে গড়ে তুলেছে কল্পরূপ। ‘শি’ শীর্ষক ছবিটি ২০০৭ সালে আঁকা। কৃষ্ণাভ প্রেক্ষাপটে জলের ভিতর মৎস্য পরিবৃত এক নগ্নিকার উপস্থাপনা। ছন্দময়তা বা লিরিসিজমের সুন্দর দৃষ্টান্ত এই ছবি। কল্পরূপ ক্রমান্বয়ে বিমূর্ততার দিকেও গেছে। নিসর্গরচনাগুলি এর দৃষ্টান্ত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.