|
|
|
|
ত্রিপল ছাউনিতে বাস, লোধাদের
উন্নয়নের কোটি কোটি টাকা পড়ে
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
চারদিক খড় দিয়ে ঘেরা। উপরে ত্রিপলের ছাউনি। দু’বছর আগে ছোট্ট মাটির ঘর ভেঙে যাওয়ার পর এটাই আস্তানা মেদিনীপুর সদর ব্লকের বিষড়া গ্রামের কিনু নায়েকের।
শুধু কিনু নায়েকই নয়, ওই গ্রামেরই সন্দীপা কোটাল, লতিকা নায়েকদেরও একই অবস্থা। কারও ছোট্ট মাটির ঘরের দেওয়ার যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। আবার কেউ সামান্য দেওয়াল তুলে যা হোক করে দিন কাটাচ্ছেন। শীতে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরে। বর্ষায় জলের ছাঁট। হাড় হিম করা ঠাণ্ডা বা জলের ছাঁটকে সঙ্গী করেই রাত্রিযাপন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার লতিকা, সন্দীপাদের মতো লোধা সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র বহু মানুষেরই।
তবু তাঁদের জন্য একটা ঘর জোটেনি। অথচ, ২০০৭-০৮ আর্থিক বছরে লোধাদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য যে ৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার, তার মধ্যে ১২ কোটি টাকা পেয়েও ৬ বছরে খরচ করতে পারেনি জেলা। এখনও প্রায় ২ কোটিরও বেশি টাকা পড়ে রয়েছে। যে টাকা খরচ হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে সেক্ষেত্রে প্রকৃত উপভোক্তাদের তালিকা মেলেনি! কেন এমন ঘটনা ঘটল। এ ব্যাপারে বর্তমান জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহের কথায়, “আগের জেলা পরিষদ কেন টাকা খরচ করতে পারেনি তা জানা নেই। আমাদের প্রথম লক্ষ্য গরিব মানুষের উন্নয়ন। যাতে দ্রুত ওই টাকায় বাড়ি তৈরি করা যায় তার জন্য পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। যে টাকা খরচ হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে, তা কোন কোন খাতে খরচ হয়েছে তাখতিয়ে দেখা হবে।”
পূর্বতন জেলা পরিষদের সভাধিপতি অন্তরা ভট্টাচার্যের কথায়, “বাড়ি তৈরির জন্য যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল তাতে বাড়ি তৈরি সম্ভব নয় বলে ঠিকাদারি সংস্থাগুলি কাজ করতে রাজি হয়নি। তবে যে বাড়িগুলি তৈরি হয়েছিল তার সম্পূর্ণ তালিকা জেলা পরিষদে থাকার কথা।” |
 |
বছর দু’য়েক আগে বাড়ি ভেঙে গিয়েছে। তাই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কিনু নায়েকের দিন কাটে
ত্রিপলের ছাউনিতেই। মেদিনীপুর সদর ব্লকের রিষড়া গ্রামে সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি। |
এই টাকা খরচ না করতে পারায় বাকি বরাদ্দ অর্থাৎ লোধা উন্নয়নের আরও ২৫ কোটি টাকা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে জেলা। শুধু ওই ২৫ কোটি টাকাই নয়, পরবর্তী বছরের বরাদ্দও মেলেনি। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৭-০৮ অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে যে অর্থ মঞ্জুর করা হয়েছিল তা ৫ বছরের জন্য। অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবর্ষেই সে টাকা খরচ করার কথা। আর তা করতে পারলেই, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে ফের বরাদ্দ মিলত। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই প্রকল্পে বছরে গড়ে আরও ২৮ কোটি টাকা করে চেয়েছে প্রশাসন, কিন্তু সে টাকা এখনও মঞ্জুর হয়নি।
লোধা শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাই নায়েকের কথায়, “সারা জেলা জুড়েই লোধারা বঞ্চনার শিকার। বারবার প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছি, অনশনে বসেছি। তবু কাজ হয়নি। লোধা উন্নয়নের কোটি কোটি টাকা পড়ে থাকছে অথচ লোধারা থাকার ঘরটুকুও পাচ্ছে না। বিগত সরকারও আমাদের জন্য কিছু করেনি, বর্তমানও সরকারও তাই।”
বিষড়া গ্রামের কিনু নায়েক বলেন, “বাড়ি দেবে বলেছিল। কিন্তু এখনও তা মেলেনি।” শক্তি কোটাল বলেন, “আমার বাড়ির অর্ধেক কাজ হয়েছিল। তারপর আর কাজ করেনি। প্রশাসনকে জানিয়েও সুফল মেলেনি। বাধ্য হয়েই অনেক কষ্টে নিজের টাকায় অর্ধসমাপ্ত কাজ শেষ করেছি।”
১২ কোটি টাকায় কী হয়েছে? প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১২ টাকার মধ্যে সাড়ে ৬ কোটি টাকা নিয়েছিল জেলা পরিষদ। যে টাকায় বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। বাকি টাকা ছিল জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের কাছে। সেই টাকায় পানীয় জল প্রকল্প, ক্রেশ, বাগানের পাশাপাশি বাড়ি তৈরিরও পরিকল্পনা করা হয়। ২০৪টি বাড়ি তৈরিও হয়েছিল। কিন্তু বাগান তৈরি সহ বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা সম্পূর্ণ খরচ করতে পারেনি দফতর।
জেলা পরিষদ বাড়ি তৈরি করে প্রায় ২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা খরচ দেখিয়েছে। আর গত বছর ২ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরকে ফেরত দিয়েছিল। যে টাকায় ২৭০টি বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা নেয় দফতর। তার মধ্যে বেশিরভাগ বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেলেও এখনও প্রায় ৩০টির মতো বাড়ি তৈরির কাজ শেষ করা যায়নি। তার বাইরে জেলা পরিষদে পড়ে থাকা প্রায় ১ কোটি ১৯ লক্ষ টাকা সম্প্রতি অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরকে ফেরত দিয়েছে জেলা পরিষদ। যে টাকাতেও বাড়ি তৈরির জন্য পদক্ষেপ করা হবে বলে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর জানিয়েছে। কিন্তু যে ২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা জেলা পরিষদ খরচ দেখিয়েছে, সেই টাকায় কোন এলাকায় কার বাড়ি তৈরি করা হয়েছে তার কোনও সম্পূর্ণ তালিকা দিতে পারেনি। অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) পাপিয়া ঘোষ রায়চৌধুরী বলেন, “আমরা একটি তালিকা পেয়েছি। তা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরকে দিয়েওছি।” অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলা পরিষদ তাঁদের যে তালিকা দিয়েছে তা প্রশাসনিক কর্তার স্বাক্ষরহীন তালিকা। ফলে তা কেন্দ্রীয় সরকারকে খরচের হিসাব দাখিল করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। পূর্বতন ও বর্তমান জেলা পরিষদ এবং অনগ্রসর শ্রেণি কল্যান দফতরের চাপান উতোর চলছেই। পড়ে থাকছে টাকা। বঞ্চিত হচ্ছেন গরিব লোধারা। |
|
|
 |
|
|