|
|
|
|
প্রথম দিনেই বদলি ৯ আমলা |
দুর্নীতি রোখার শপথে শুরু অরবিন্দ জমানা
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি
২৮ ডিসেম্বর |
এ এক আশ্চর্য যাত্রা।
সকালেও তিনি ছিলেন আম আদমি। বেলায় যাত্রা শুরু কৌশাম্বি মেট্রো স্টেশন থেকে, আমজনতাকে সঙ্গে নিয়ে। যাত্রা শেষ দুপুরে, রামলীলা ময়দানে। সেখানেই আম জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে শপথ নিলেন দিল্লির তরুণতম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে।
আম আদমি অরবিন্দ কেজরিওয়াল পরিণত হলেন খাস আদমি-তে।
শপথ নেওয়ার পরে রামলীলার বক্তৃতায় মূলত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন তিনি। নিজের মন্ত্রীদের সঙ্গে উপস্থিত জনতাকে দিয়েও শপথ করিয়ে নিলেন, “ঘুষ দেব না, নেবও না।” এবং এই শপথবাক্য পাঠের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কাজও শুরু করে দিলেন দিল্লির নয়া মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিনই রাজ্যের অর্থসচিব, বিদ্যুৎসচিব, দিল্লি জল বোর্ডের সিইও-সহ ৯ জন পদস্থ আমলাকে বদলি করে দিয়েছেন অরবিন্দ। ভোটের আগে তাঁর দলের প্রধান দুই প্রতিশ্রুতি ছিল অর্ধেক বিদ্যুৎ মাসুল এবং পরিবার-পিছু বিনামূল্যে দৈনিক ৭০০ লিটার জল। অর্থ, পরিকল্পনা, বিদ্যুৎ, স্বরাষ্ট্র, ভিজিল্যান্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলি নিজের হাতেই রেখেছেন নয়া মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, সোম-মঙ্গলবারের মধ্যেই জল ও বিদ্যুতের দাম নিয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন।
সব মিলিয়ে অরবিন্দ জমানার প্রথম দিনের চিত্রনাট্যে তাই নাটক মজুত রইল যথেষ্ট।
তার আগে আজ সকাল থেকে এক অন্য প্রস্তুতি দেখেছে দিল্লি। আম জনতার মুখ্যমন্ত্রীর শপথের প্রস্তুতি।
মেট্রোয় চড়ে শপথ নিতে যাওয়ার কথা গত কালই জানিয়েছিলেন অরবিন্দ। সেই মতো আজ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ গিরনার আবাসন থেকে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে রামলীলার উদ্দেশে রওনা হন তিনি। সঙ্গে স্ত্রী-মেয়ে। লক্ষ্য কৌশাম্বি স্টেশন থেকে মেট্রো ধরা। |

রামলীলা ময়দানে যাওয়ার আগে কৌশাম্বি মেট্রো স্টেশনে
অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ঘিরে সমর্থকদের ভিড়। ছবি: পিটিআই |
আম আদমির মুখ্যমন্ত্রী মেট্রোয় চড়ে শপথ নিতে যাবেন, এ খবরের ধাক্কায় গোটা স্টেশন চত্বর তত ক্ষণে চলে গিয়েছে ভিড়ের দখলে। একের পর এক মেট্রো যাচ্ছে, কিন্তু তাতে কেউ চড়ছেই না! সকলেরই ইচ্ছে অরবিন্দের সঙ্গে মেট্রোয় উঠবেন। এ দিকে ভিড় বাড়ছে। পরিস্থিতি দেখে মুখ শুকোচ্ছে নিরাপত্তারক্ষীদের।
সকাল পৌনে এগারোটা নাগাদ অরবিন্দ ঢুকলেন স্টেশনে। মুহূর্তে ভিড় লাগামহীন। সকলেই এক বার ছুঁতে চান তাঁকে। চতুর্দিকে শঙ্খধ্বনি। তার মধ্যেই ঢুকে পড়ল মেট্রো। ফের এক প্রস্ত ধাক্কাধাক্কি। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত কামরায় অরবিন্দের স্ত্রী ও মেয়েকে কোনও মতে তুলে দেওয়া হল। তিনি নিজে উঠলেন তৃতীয় কামরায়। সমর্থক, সংবাদমাধ্যমের ভিড়ে তখন সেখানে তিল ধারণের জায়গা নেই! সকলেই চাইছেন অরবিন্দের কাছে যেতে। আনন্দবিহার, লক্ষ্মীনগর কিংবা ইন্দ্রপ্রস্থ সব স্টেশনেই প্রবল ভিড়ের চাপ আছড়ে পড়ছে ট্রেনের উপর। শেষ পর্যন্ত বারাখাম্বা স্টেশনে নামলেন সকলে। নিরাপত্তারক্ষীদের সাহায্যে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে কোনও রকমে স্টেশন থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে চড়ে বসলেন। গন্তব্য রামলীলা ময়দান। বেলা বারোটায় শুরু হল শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। কেজরিওয়ালের পরে শপথ নিলেন মন্ত্রিসভার ছয় সদস্যও।
অরবিন্দ আগেই জানিয়েছিলেন, তিনি কোনও ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী নেবেন না। নেবেন না সরকারি বাংলো বা লালবাতি লাগানো গাড়ি। কারণ দিনের শেষে তিনি আম আদমিই থাকতে চান। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এ ভাবে কত দিন আম আদমি হয়ে থাকতে পারবেন অরবিন্দ? ক’দিনই বা সফর করতে পারবেন মেট্রোয়? তাঁর দল বলছে, আজকের যাত্রা ছিল নেহাতই প্রতীকী। লালবাতি সর্বস্ব, ভিভিআইপি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত দিল্লির তথাকথিত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বার্তা দেওয়াই ছিল অরবিন্দের লক্ষ্য। পরিবারতন্ত্র, পেশি বা অর্থবল না থেকেও লক্ষ্য স্থির রাখলে একজন সাধারণ ব্যক্তিও যে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছতে পারেন, সেই বার্তা দিতেই আজ তাঁর এই যাত্রা।
তবে এ-ও ঠিক, অরবিন্দ আজকের যাত্রায় সচেতন ভাবে বার্তা দিতে চেয়েছেন দিল্লিবাসীকেও। তাই খুব ভেবেচিন্তে মেট্রোকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। রাজনীতিকদের বিশ্লেষণ, নেতা হিসেবে কেজরিওয়ালের অন্যতম সম্পদই হল অনাড়ম্বর, আম আদমি সুলভ ভাবমূর্তি। তিনি প্রশাসনের কাছে আজ থেকে দিল্লির খাস নাগরিক হিসেবে গণ্য হতে পারেন, কিন্তু নিজের ভোটব্যাঙ্কের কাছে সযত্নলালিত ভাবমূর্তি ভাঙতে নারাজ অরবিন্দ। হয়তো সেই কারণেই এ দিনের শপথ অনুষ্ঠানে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল দিল্লির অভিজাত সমাজকে।
এক বছর আগে অণ্ণা হজারের সঙ্গে মতবিরোধ থেকে রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই দলের এই সাফল্যের কাহিনি দেশের ইতিহাসে বিরল। সম্ভবত বিশ্বেও। কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করে বিজেপির স্বপ্ন ভেঙে দিল্লির ক্ষমতায় এখন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ। যা দেখে সমাজমনস্তত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, কংগ্রেস, বিজেপির মতো দলগুলির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। তারই ফায়দা তুলেছে অরবিন্দের দল।
আপ-এর এই সাফল্যের পটভূমি কিন্তু প্রস্তুত হয়েছে নাগরিক আন্দোলনের হাত ধরেই। বছর দুয়েক আগে, রাজধানীর মাটিতে জন লোকপাল বিল নিয়ে অণ্ণা হজারের আন্দোলনের সময় থেকেই এই সাফল্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে নির্ভয়া কাণ্ডে সরকার বিরোধী যে জনরোষ দিল্লির রাজপথে আছড়ে পড়েছিল, তারই প্রতিফলন এ বার ভোটের বাক্সে দেখা গিয়েছে বলে মানছেন সকলে। আপ-এর এই সাফল্যের পিছনে যে অণ্ণারও ভূমিকা রয়েছে, তা আজ প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন কেজরিওয়াল। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দল গড়া নিয়ে আপত্তি ছিল অণ্ণার। তিনি মনে করেন, রাজনীতি হল নোংরা জায়গা। কিন্তু আমি ঠিক করি, এই নোংরায় নেমেই তা সাফাই করব।” আজকের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হলেও কেজরিওয়াল এবং তাঁর মন্ত্রিসভাকে অবশ্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অণ্ণা।
আজ শপথগ্রহণ হল। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীও হলেন কেজরিওয়াল। কিন্তু কত দিন এই সরকার চালাতে পারবেন তিনি? দল জানে, সামনে বহু চ্যালেঞ্জ। তার মধ্যে যেমন রয়েছে জনতার কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করা, তেমনই বিজেপি-কংগ্রেসকে সামলে আগামী ২ জানুয়ারি আস্থা ভোটে উতরে যাওয়া। কেজরিওয়াল নিজেও সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কায়। তাঁর কথায়, “কত দিন সরকার থাকবে, জানি না। আস্থা ভোটেই সরকার পড়ে যেতে পারে।” তবে তাঁর কাছে স্বস্তির কারণ একটাই। তাঁকে সমর্থন করা নিয়ে দলে বিরোধ থাকলেও কংগ্রেস এখনই ভোট চায় না। তাই এ যাত্রায় সরকার বেঁচেও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কাজ দেখানোর জন্য অন্তত ছ’মাস সময় পাবেন অরবিন্দরা।
আর ওই সময়টুকু ভীষণই প্রয়োজন তাঁদের। তাই আজ এক দিকে যেমন কাজ শুরু করে দিয়েছেন অরবিন্দরা, তেমনই বার্তা দিয়েছেন দিল্লিবাসীকে পাশে পাওয়ার জন্য। শপথ নেওয়ার ঠিক পরের বক্তৃতায় অন্যান্য প্রতিশ্রুতির কথা সে ভাবে না তুললেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা তুলে অরবিন্দ বলেছেন, সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে এবং ঘুষ ঠেকাতে বিশেষ হেল্পলাইন চালু করা হবে। জনতাকে বলেছেন, “যদি কোনও ব্যক্তি ঘুষ চায়, তা হলে চুপচাপ তার কথা মেনে নিন। তার পর তার নাম-ঠিকানা আমাদের হেল্পলাইন নম্বরে জানান।”
সৎ আমলাদেরও অভয় দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনে তাঁদের উপযুক্ত পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, “অনেক আমলা শুনছি ভয় পাচ্ছেন। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আমি মনে করি অধিকাংশ আমলাই সৎ। অথচ সৎ আমলারা এক কোণে পড়েছিলেন আর রাজত্ব করেছেন দুর্নীতিগ্রস্ত আমলারা। সেই ব্যবস্থা পরিবর্তনের সময় এসেছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেজরিওয়ালের অত্যন্ত কৌশলী এক দ্বিমুখী চাল। তিনি জানেন, জল-বিদ্যুৎ নিয়ে প্রতিশ্রুতি পূরণ, দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া, জন লোকপাল বিল পাশ করানো এ সব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আজ অভিনন্দন জানালেও কার্যক্ষেত্রে কংগ্রেস কতটা সাহায্য করবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আপ নেতৃত্বের। তাই দায়িত্ব নিয়েই সবার আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করার সুযোগ ছাড়তে চাননি তিনি। আবার একই সঙ্গে জল-বিদ্যুৎ নিয়ে প্রতিশ্রুতি পালনে তিনি যে সচেষ্ট, সেই বার্তাও দিতে চেয়েছেন প্রশাসনিক রদবদলে।
তবে প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আম আদমিরই সাহায্য চেয়েছেন কেজরিওয়াল। দিল্লিবাসীর প্রতি তাঁর বার্তা, “আমার কাছে কোনও জাদু ছড়ি নেই যে, এক দিনে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু দিল্লির দেড় কোটি মানুষ যদি এক সঙ্গে কাজ করেন, তা হলে অবশ্যই সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব।” তাঁর এই ‘পার্টিসিপেটরি ডেমোক্রেসি’-র কৌশলকে অবশ্য কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বিজেপি নেতারা।
অরবিন্দ নিজেও জানেন তিনি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন। এই সরকারের মেয়াদ যে দীর্ঘ হবে না, তা-ও বিলক্ষণ জানেন তিনি। তা ছাড়া লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে। তাতেও ভাল করার লক্ষ্য নিয়েছে দল। এই অবস্থায় সুষ্ঠু প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনে নিজেদের আন্তরিকতার ছবিটা দ্রুত তুলে ধরতে চান আপ নেতৃত্ব।
এই অবস্থায় আজ মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই দিল্লিতে ভিআইপি সংস্কৃতি বন্ধ করার ফরমান জারি করেছেন অরবিন্দ। দু’দিন আগে দিল্লিতে গাড়ির জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে একটি বেসরকারি সংস্থা। কেন, তা জানতে সংস্থাটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এ ছাড়া দুর্নীতি দমনে একটি বিশেষ দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অরবিন্দ। যাদের কাজ হবে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি অফিসারদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার করা। যা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট। প্রতিশ্রুতি পালনে তিনি যে বদ্ধপরিকর, প্রথম দিন থেকেই সেই বার্তা দিতে শুরু করেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
কিন্তু কত দিন? আদৌও কি কোনও পরিবর্তন হবে? প্রতিশ্রুতি পালন কি করতে পারবেন অরবিন্দ?
সব উত্তর লুকিয়ে সময়ের গর্ভে। |
পুরনো খবর: আজ মেট্রো চেপে শপথ নিতে যাবেন কেজরিওয়াল |
|
|
|
 |
|
|