জলে জীবাণুর দাপটে রোগেরই আড়ত গঙ্গা
কোথাও তা সহনমাত্রার তেরো গুণ। কোথাও বা আট-ন’গুণ!
মানুষ ও জলজ প্রাণীর শরীরের পক্ষে তুমুল ক্ষতিকারক এক পরজীবীর এ হেন বাড়বাড়ন্তে দূষণের সাক্ষাৎ আধার হয়ে উঠেছে গঙ্গার জল। পশ্চিমবঙ্গের ন’টি পুর-এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার জলের নমুনা পরীক্ষা করে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ দেখেছে, ওই ‘ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়া’র পরিমাণ কোথাওই সহনমাত্রার তিন গুণের কম নয়। তেইশ বছর ধরে চলা গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের পিছনে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা বয়ে যাওয়ার পর এটাই এ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা-দূষণের বাস্তব ছবি!
সম্প্রতি কলকাতায় আয়োজিত জল সংক্রান্ত এক অলোচনাসভায় এই ছবিটাই উঠে এল। কী রকম?
জাতীয় গঙ্গানদী অববাহিকা কর্তৃপক্ষের বিশেষজ্ঞ-সদস্য তথা কলকাতার কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্থ’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা কুমারজ্যোতি নাথের কথায়, “গঙ্গার জলে এই ব্যাক্টেরিয়ার রমরমা প্রমাণ করছে, এত বছরেও গঙ্গার দূষণ কমানো যায়নি।” ফিক্যাল কলিফর্মের উৎস হল মানুষ ও অন্যান্য পশুর মল এবং কীটনাশক। মানুষের পেটে এক বার তা ঢুকলে আমাশা-সহ পেটের বিবিধ রোগ তো বটেই, এমনকী টাইফয়েড, কলেরাও হতে পারে বলে পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
পরিবেশবিদেরা এ-ও বলছেন, নির্বিচারে বর্জ্য ক্ষেপণের পরিণামে গঙ্গা দূষিত হওয়া নতুন কিছু নয়। এ রাজ্যে গঙ্গার ধারে ৩৭৩টি জনপদ, তাতে কয়েক কোটি মানুষের বসবাস। সেখান থেকে দূষিত বর্জ্য পদার্থ নাগাড়ে এসে সরাসরি মিশছে গঙ্গার জলে। বস্তুত ১৯৮৬-তে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান রূপায়ণের সময়ই এ নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছিল (প্রকল্প শেষ হয়েছে ২০০৯-এ)। ঠিক হয়েছিল, গঙ্গা তীরবর্তী পুরসভাগুলো তাদের যাবতীয় নিকাশি নালা সরাসরি গঙ্গার পরিবর্তে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে ফেলবে, যেখানে বিশেষ যন্ত্র বসিয়ে সেই সব বর্জ্য পরিশোধন করে লাগানো হবে অন্য কাজে।
কিন্তু পরিবেশবিদদের অভিযোগ, ব্যবস্থাটি চালু হয়েছে হাতে গোনা কিছু জায়গায়। সার্বিক ভাবে পরিস্থিতির কোনও বদল ঘটেনি। ফিক্যাল কলিফর্মের দাপাদাপিতে রাশ টানা যায়নি। ফলে টাইফয়েড-কলেরা-হেপাটাইটিসের মতো রোগ আকছার ছড়াচ্ছে। ফিকা্যল ব্যাক্টেরিয়া জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ায় জলজ প্রাণীর জীবনচক্রেও ক্ষতিকর পরিবর্তন ঘটছে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন-আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “গঙ্গার ধারের বস্তির লোকজন তো মূলত নদীর পাড়েই মলমূত্র ত্যাগ করেন! সব মিলিয়ে গঙ্গা কার্যত একটা বড় নিকাশি নালা হয়ে উঠেছে।”
শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়। সারা দেশেই মোটামুটি এক চিত্র। জাতীয় গঙ্গানদী অববাহিকা কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট বলছে, গঙ্গা তীরবর্তী দেশের বিভিন্ন বড় শহর থেকে দৈনিক গড়ে ৩০ কোটি লিটার বর্জ্য নদীতে এসে পড়ে। সাকুল্যে তার ১০ কোটি লিটার পরিশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে। “গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মল, কীটনাশক ও শিল্প-বর্জ্যের ছোঁয়াচ থেকে নদীকে মুক্ত করা। তা করা যায়নি।” আক্ষেপ পর্ষদের এক কর্তার।
গঙ্গা দূষণের পিছনে আরও একটা কারণের কথা তুলে ধরছেন নদী-বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের দাবি, দু’ধারের চাষের জমি থেকেও গঙ্গা প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের ব্যাখ্যা, “বহু জায়গায় গঙ্গার দু’ধারে প্রচুর চাষের জমি। ওই মাটিতে মিশে থাকা কীটনাশক ও রাসায়নিক সার জলে ধুয়ে এসে গঙ্গায় পড়ছে। বাড়ছে দূষণ।” ফলে মাছ-সহ নানা ধরনের জলজ প্রাণীরও অস্তিত্ব সঙ্কটে।
ফিক্যাল কলিফর্ম
স্থান মাত্রা*
বহরমপুর ১৭
পলতা ২৩
শ্রীরামপুর ১৪
দক্ষিণেশ্বর ১৭
শিবপুর ৩৩
গার্ডেনরিচ
উলুবেড়িয়া ১৪
ডায়মন্ড হারবার
*১০০ মিলিলিটারপিছু
এমপিএন (মোস্ট প্রোবাবল নাম্বার), হাজারে
• ফিক্যাল কলিফর্ম কী
• এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া। মানুষ ও পশুর মলে থাকে
• কেন ক্ষতিকর
• আমাশা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসের কারণ
• জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমায়
• জলজ প্রাণীরও জীবন বিপন্ন করে তোলে
সূত্র: কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ
কল্যাণবাবু বলেন, “এক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গায় শুশুক দেখা যেত। এখান দূষণের চাপেই তারা বিহারের দিকে সরে গিয়েছে।” গঙ্গায় ইলিশ মাছ কমে যাওয়ার পিছনেও দূষণের বড় ভূমিকা দেখছেন তিনি।
তা হলে গঙ্গার ভবিষ্যৎ কি এমনই অন্ধকার থাকবে?
পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, ২০০৯-এ গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের মেয়াদ ফুরোনোর পরে কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় গঙ্গানদী অববাহিকা কর্তৃপক্ষ গড়েছে। গঙ্গায় দূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষের বেশ কিছু বিধি-নির্দেশিকাও মজুত। সেগুলো ঠিকঠাক রূপায়িত হলে বিপদ রোখা যেতে পারে। নচেৎ নয়।
নির্দেশ কাগজে-কলমেই আবদ্ধ থাকবে নাকি বাস্তবের আলো দেখবে, সেটাই আপাতত কোটি টাকার প্রশ্ন। যাতে ঝুলে রয়েছে গঙ্গার দূষণমুক্তি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.