... অবশেষে
সাংবাদিক হওয়ার একটা মস্ত সুবিধে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে চেনাজানা আছে এমন লোকেদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়।
সালটা ২০০৫। ফিল্ম রিপোর্টারদের কাছে প্রথম খবর আসে হৃতিক-সুজানের বিয়ে আপাতদৃষ্টিতে সুখী দাম্পত্যের ছবি হলেও আসলে তা ঝুলছে সরু সুতোয়।
মুম্বইতে আমি যে খবরের কাগজে চাকরি করতাম, তার সম্পাদক খালিদ মহম্মদ ছিলেন হৃতিক ও তাঁর পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ববিতা কপূর আর তাঁর মেয়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল সেই সম্পাদকের। এমনকী এই ফিল্ম সাংবাদিক পরে হৃতিককে নিয়ে ‘ফিজা’ ছবিটাও পরিচালনা করেন।
একদিন তাঁর সঙ্গে এমনই এক আলোচনায় প্রথম শুনেছিলাম বিয়ের দিন সকালেও নাকি হৃতিক-করিনার ফোনে কথা হয়েছিল। পরস্পরকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। এমনকী ববিতাও সেই সম্পাদকের মতো কয়েক জনকে বলেওছিলেন মেয়েকে বোঝানোর জন্য।
এটা যদি অতীতের আয়না হয়, তবে বর্তমান সময়েই ফেরা যাক।
সুজানের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা হয়ে যাওয়ার ক’মাস আগেও করিনা-হৃতিকের প্রেম চলছিল পুরোদমে। মুম্বইয়ের হাওয়ায় সে গসিপ উড়তে উড়তে একদিন পৌঁছেছিল সঞ্জয় আর জরিন খানের জুহুর বাংলোতে। করিনার সঙ্গে হৃতিকের সম্পর্ক কিন্তু সুজানের সঙ্গে চার বছর চুটিয়ে প্রেমপর্বের পর শুরু হয়েছিল। হৃতিক সহজে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাইছিলেন না।
এক রাতে হৃতিকের বাড়ি পৌঁছোন সঞ্জয়। পরিষ্কার করে জানিয়ে দেন, চার বছর সম্পর্কের পর বিয়ে থেকে সরে আসতে পারবে না হৃতিক।
বিয়ে তো হল। সমস্যাও শুরু হল সেই দিন থেকেই।
“যখন পাত্রী জানে পাত্রই বিয়ে করতে দোনামনা করছিল, বিয়ে হয়ে গেলেও শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে পাত্রীর পক্ষে মানিয়ে নেওয়া সহজ হয় না। সুজানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল,” বলছিলেন রোশন পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন।
সুজানের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা হয়ে যাওয়ার ক’মাস
আগেও করিনা-হৃতিকের প্রেম চলছিল পুরোদমে

সুজান অনেক বার হৃতিকের এই নিজেকে নিয়ে মোহগ্রস্ত থাকায়
অভিযোগ তুলত। আমরা সে কথা তখন বিশ্বাস করতাম না
প্যালাজো-তে (হৃতিকের জুহুর বাড়ি) পা দেওয়ার পর থেকে কখনওই সুজান ইচ্ছেমতো স্বাধীনতা পাননি। আর তার পর শুরু হয়, ঝগড়া।
এ সব ব্যাপার জুহুর প্রতিবেশীদের ভালই জানা। “মাঝরাতেও দেখেছি হঠাৎ গাড়ি নিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল সুজান। পিছন পিছন হৃতিক। দু’তিন ঘণ্টা পরে দু’জনেই ফিরে আসত। এটাই চলত দিনের পর দিন। প্রতিদিন দেখে দেখে আমাদেরও চোখ সয়ে গিয়েছিল,” আড্ডা মারতে মারতে বলছিলেন রোশনদের প্রতিবেশি বিক্রম মদনানি (নাম পরিবর্তিত)।
অন্য দিকে তত দিনে হৃতিকের ঘনিষ্ঠরা বলতে শুরু করেছিলেন তিনি অসম্ভব কমপ্লেক্স একটি চরিত্র।
এমনকী মিডিয়ার লোকেদেরও তাঁকে ইন্টারভিউ করার কথা উঠলে গায়ে জ্বর আসত।
কারণ হৃতিকের ছিল সব সময় নিজের জগতে থাকার অভ্যেস।
“যদি আপনি হৃতিককে প্রশ্ন করেন, ‘কেমন আছেন?’ নির্ঘাত হেসে ও উত্তর দেবে, ‘কাল রাতে স্বপ্নে তিন পরিকে দেখলাম। ওরা বলল আগামী কাল খুব ভাল কাটবে...’ এমনটাই হয়ে গিয়েছিল হৃতিক,” বলছিলেন তাঁর সঙ্গে কাজ করা এক পিআর ম্যানেজার।
হৃতিক-ঘনিষ্ঠদের মতে এই দিকটা সুজানের কাছে তত দিনে আরও অসহ্য হয়ে উঠছিল। “সুজান নিজেকে নিয়ে মোহগ্রস্ত হৃতিকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করত। আমরা সে কথা তখন বিশ্বাস করতাম না। স্টার সব সময় বেনিফিট অব ডাউট পায় তো! এখন বুঝতে পারি, সুজান এক বর্ণও বাড়িয়ে বলেনি। হৃতিক শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। অন্য কারও কথা ও ভাবতে চাইত না,” বলছিলেন হৃতিকের কুড়ি বছরের পুরনো এক বন্ধু ফিল্মমেকার।
কিন্তু এই ছবিটার অন্য একটা দিকও রয়েছে। সেই গল্পটা অনেকটা ‘ডক্টর জেকিল আর মিস্টার হাইড’-য়ের মতো।
“হৃতিক নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ওর মতো সরল হৃদয়ের মানুষ দু’টো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ঘরে বয়োঃজ্যেষ্ঠ কেউ ঢুকলে ও উঠে দাঁড়াবে। বন্ধুদের যে কোনও সমস্যায় ও আছে। পরিবারের কোনও অনুষ্ঠানে ও অনুপস্থিত থাকবে না। সুজান হয়তো এই দিকটা দেখেই ওর প্রেমে পড়েছিল। বিয়ের পর আবিষ্কার করল অন্য দিকটা। আর তখনই স্বপ্নভঙ্গ,” বলছিলেন এক সিনিয়র মিডিয়া কমেন্টেটর, যিনি ৩০ বছর ধরে রোশন পরিবারকে চেনেন।
পরিবারের ঘনিষ্ঠদের মতে আজকে হৃতিকের এই বিয়ে ভাঙার গল্পের আর একটা বড় কারণ রাকেশ রোশনের ব্যক্তিত্ব।
শুরুটা হৃতিক করেছিলেন ধামাকা দিয়ে। ‘কহো না পেয়ার হ্যায়’। কিন্তু তার পর? ‘মিশন কাশ্মীর’ থেকে ‘মুঝসে দোস্তি করোগে’— একটার পর একটা ফ্লপ। ইতিমধ্যে ‘ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার’দের খাতায় নাম উঠতে বসেছিল তাঁর।
আর রোশন পরিবারের একটা বড় নিয়ম, কোনও কিছুই রাকেশ রোশনের বিনা-অনুমতিতে হতে পারে না। নিজের ছবি যখন বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ছে, স্বাভাবিক ভাবেই ছবি করিয়ে বাবার উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন হৃতিক। গভীর রাতেও বাবা-ছেলের আলোচনা হত সিনেমা নিয়ে। চিত্রনাট্য নিয়ে। আর সুজান? “রাতে সুজান আমাদের ফোন করে বলত, বাবা-ছেলের এই লেট নাইট মিটিংগুলোর কথা। সেই সময় থেকেই আরও দূরত্ব বাড়ে হৃতিক-সুজানের,” জানাচ্ছেন সুজানের এক বন্ধু।
এর পর এল ২০০৬। অবিশ্বাসের বীজ আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করা শুরু করছিল। মুম্বই-বিনোদন জগতের সব সাংবাদিকই জানতেন সিঙ্গাপুরে ‘কৃশ’য়ের লম্বা শিডিউলে হৃতিক আর প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ‘রকিং অ্যাফেয়ার’য়ের গল্প। কেউ বলছিলেন কয়েক দিনের ব্যপার। কারও কাছে কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদী ‘ইনফিডিলটি’র শুরু বলেই মনে হয়েছিল। অবশেষে সে খবর সুজানের কানেও যায়।
সুজানের পরিবার কিন্তু প্রথমে খবরটা পাত্তাই দেয়নি। “জরিন খান ও ছেলে-মেয়েরা অসম্ভব ওয়েল-গ্রুমড। ওয়েল বিহেভড। তাঁরা হৃতিককেও খুব পছন্দ করতেন। এমনকী সুজানের ভাইয়ের সঙ্গেও জায়েদের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। নিয়মিত পার্টিও করতেন তাঁরা। তাই হৃতিক-প্রিয়াঙ্কার প্রেমের খবরকে প্রথমে পাত্তাই দেননি তাঁরা,” বলছিলেন জায়েদের বন্ধু।
প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারলেও বারবারা মোরি-র ঘটনা কিন্তু অত সহজে উড়িয়ে দেয়নি কেউ।
‘কাইটস’য়ের যে ক্রু আমেরিকায় গিয়েছিল, তারা এখনও হৃতিক-বারবারার প্রেম নিয়ে হাসাহাসি করে।
হয়তো সুজান-হৃতিকের রূপকথার বিয়ের শেষের শুরু, লাস ভেগাসের ওই আউটডোর থেকেই।
এরই মধ্যে এক সময় দুই সন্তানের মা সুজানের সঙ্গে আলাপ হয় দুই সন্তানের বাবা অর্জুন রামপালের।
শাহরুখ খান শিবিরের অনেকেই জানতেন ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন সুজান-অর্জুন। অনেকে চাইতেনও তাঁরা প্রেম চালিয়ে যান। এমন সময়ে সুজান ঢুকে পড়েন গৌরী খান, মাহিপ কপূরের ‘বান্দ্রা ওয়াইভস ক্লাব’য়ে। ইনফ্যাক্ট বান্দ্রা ওয়াইভসদের এই ক্লাব নিয়ে একটা এপিসোডও করেছিলেন কর্ণ জোহর যেখানে ‘কফি উইথ কর্ণ’য়ে হাজির ছিলেন গৌরী খান ও সুজান রোশন।
ইউ টিউবের সেই ভিডিও আজকে দেখলে মনে হয়, সময় কতটা পাল্টে যায়!
কর্ণ ওই এপিসোডেই গৌরীকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁর কেমন লাগে যখন তিনি দেখেন সুন্দরী হিরোইনরা শাহরুখের সঙ্গে শু্যটিং করছেন? এর উত্তরে গৌরী বলেন,“কর্ণ, এই রকম সব প্রশ্ন শুনলে আমার খুব ইরিটেশন হয়। আমরা যদি আর একসঙ্গে নাই থাকতে পারি, তা হলে ভগবানকে বলব তিনি যেন আমাকে এমন কারও সন্ধান দেন যার সঙ্গে আমি থাকতে পারি।”
আমি ভাবতেও পারি না হৃতিককে ছাড়া আমি কী করে বাঁচব। আমি ওর সঙ্গে অসম্ভব অ্যাটাচড।
এমন দিন যদি আসে আমি জানি না আমি কী ভাবে ‘মুভ অন’ করব...
২০০৪য়ে ‘কফি উইথ কর্ণ’তে সুজান রোশন
একই প্রশ্ন ওই অনুষ্ঠানে কর্ণ যখন হৃতিকের স্ত্রীকে করেন, তার উত্তরে সুজান বলেছিলেন, “আমি ভাবতেও পারি না, হৃতিককে ছাড়া কী করে বাঁচব। আমি ওর সঙ্গে অসম্ভব অ্যাটাচড। এমন দিন যদি আসে আমি জানি না আমি কী ভাবে ‘মুভ অন’ করব। হৃতিক ছাড়া ভাবতেই পারি না আমার জীবনটা।”
এই ইন্টারভিউ দেখলে দুই সুপারস্টারের বৌয়ের মনের জানালাটা যেমন দেখা যায়, তেমনই অর্জুন রামপালের সঙ্গে সুজানের অ্যাফেয়ারটাও যে পুরোটাই ‘রিবাউন্ড’য়ে সেই ছবিটাও পরিষ্কার হয়ে যায়। এমন সময়েই তাঁরা ঠিক করেন একসঙ্গে বিজনেস শুরু করবেন। ব্যবসাও হবে, অর্জুনের সঙ্গে সম্পর্কটাও পাশাপাশি থাকবে।
কিন্তু সেখানে একটাই সমস্যা ছিল।
অর্জুনের স্ত্রী মেহের জেসিয়া।
তুমুল প্রেমের মধ্যেও মেহেরকে ছেড়ে আসতে রাজি ছিলেন না অর্জুন। এ সময়ই হৃতিকের কাছেও অর্জুন-সুজানের প্রেমের খবর পৌঁছয়।
“তত দিনে আমির খানের মতো পারফেকশনিস্ট হতে হতে, নিজেকে একটা শেলের মধ্যে নিজেকে নিয়ে গেছিল ও। একই সময়ে উঠে এল রণবীর কপূর। খানদের সঙ্গে এত দিন একমাত্র যার নাম উচ্চারিত হত, সেটা ছিল হৃতিক রোশন। রণবীর এসে পড়ায় সেই জায়গাতেও তার আর একাধিপত্য থাকল না,” বলছিলেন এক পরিচালক।
এই সব অবস্থার মধ্যেও কয়েক জন বন্ধু সুজান-হৃতিকের সমস্যা মেটানোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। সুজান তখন থাকতেন এক অন্য ফ্ল্যাটে। “আমরা তখন শুনতাম ছেলেদের একজন থাকে হৃতিকের সঙ্গে, অন্য জন সুজানের সঙ্গে। সুজান চাইত রোশন পরিবার থেকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু হৃতিক বাড়ির সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ যে ওর পক্ষে প্যালাজো ছাড়া সম্ভব ছিল না,” জানালেন এক বন্ধু যিনি নিজে মধস্থতা করার বহু চেষ্টা করেছেন।
নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকল। হৃতিক আরও বেশি করে গুটিয়ে ফেলতে লাগলেন নিজেকে। এর মাঝেই জানা গেল ব্রেনে ক্লট হয়েছে হৃতিকের।
সুজানের বন্ধু-বান্ধবরা বলছিলেন, “আমরা ভারতীয়রা দুঃখের সময় সব সময় কাছাকাছি চলে আসি। আমরা ভেবেছিলাম হৃতিকের ব্রেন ক্লটের খবর হয়তো ওদের দু’জনকে কাছাকাছি এনে দেবে। কিছু দিনের জন্য হলও সেটা। কিন্তু সার্জারির দু’মাস পরে আমরা বুঝতে পারলাম মেরামতির অনেক বাইরে চলে গিয়েছে হৃতিক-সুজানের সম্পর্ক।”
এমন ব্যাকগ্রাউন্ডে শুক্রবার এল হৃতিকের প্রেস বিবৃতি।
যা শুনে বলিউডের অনেকেই যেন সমস্বরে বলে উঠলেন ‘আমরা তো আগে থেকেই জানতাম।’
শোভা দে যেমন সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য দু’জনের প্রশংসা করলেন ট্যুইটারে।
অনেকের এটাও মনে হয়েছে প্রেস রিলিজে নিজেদের কথা বলার আইডিয়া হৃতিকেরই।
রোশন পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ জানালেন, “মনের দিক থেকে হৃতিক খুব জেনুইন। ওর প্রেস বিবৃতি দেখুন। সেখানেও দেখতে পাবেন এর প্রতিফলন। ও সেপারেশনের ব্যাপারে বলিউডে একটা উদাহরণ সেট করল।”
তবে হৃতিক-সুজানের গল্পে আয়রনি হয়তো অন্য জায়গায়।
সব সময়ই আমিরের মতো পারফেকশনিস্ট হতে চাইতেন হৃতিক। তাঁর কেরিয়ারটাও মডেল করেছিলেন আমিরের দিকে তাকিয়ে।
পেশাদারি ক্ষেত্রে সে পথে হেঁটে সফলও হলেন হৃতিক।
কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনও যে তাঁদের এমন ভাবে মিলে যাবে, কে জানত!
দুই সুপারস্টারের এই পারফেক্ট জীবনে হয়তো সবচেয়ে বড় মূল্য দিয়ে গেলেন রিনা আর সুজান।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.