প্রবন্ধ ...
যে ঘৃণা সম্রাট ক্যালিগুলার চরম আশ্রয়
নন্দবাজার পত্রিকায় অমর্ত্য সেন-এর একটি সাক্ষাৎকার (‘সামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনা অনেক, অভাব যথার্থ সুচিন্তার’, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩) পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সহজ, সুন্দর ভাবে বলা ওঁর কথাগুলো মনের জানলাটা টান দিয়ে খুলে দিয়েছিল। ‘ক্ষমতা’র প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলি কতটা অন্যায় ও মিথ্যাচার করতে পারে, সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উনি বললেন... ‘আমার ধারণা এটার প্রধান কারণ সুচিন্তার অভাব আমি বরাবরই মনে করেছি, যে খারাপ জিনিসগুলি ঘটে, তার অধিকাংশই চিন্তার অভাবে ঘটে...’। সাক্ষাৎকারটি পড়ার দু’তিন দিনের মধ্যে ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের অভিনয় ছিল। তখনও পর্যন্ত চৌত্রিশটি অভিনয় হয়ে গিয়েছে। তবু সেই সন্ধ্যায় বহু বার উচ্চারিত সংলাপগুলো আরও এক বার নতুন রূপে ধরা দিল আমার কাছে:
ম্যাকবেথ: এক জন চিৎকার করল ‘খুন’, প্রার্থনা করে বলল ‘দয়া করো ভগবান’। অন্য জন বলল, ‘আমেন’। মনে হল তারা যেন দেখতে পেয়েছে আমায়, দেখেছে খুনির রক্তাক্ত হাত। চুপ করে শুনলাম তাদের ভয়ার্ত স্বর। কিন্তু আমি ‘আমেন’ বলতে পারলাম না কেন?
লেডি ম্যাকবেথ: এ নিয়ে এত চিন্তাকোরো না।
ম্যাকবেথ: কী আশ্চর্য, আমারই তোপ্রয়োজন ছিল ভগবানের দয়া, অথচ গলাটা বুজে এল। কেন?
লেডি ম্যাকবেথ: ভাববে না, একদম ভাববে না। চিন্তায় পাগল হয় মানুষ...
‘চিন্তাশক্তি’কে বিসর্জন দিতে বলে লেডি ম্যাকবেথ, কারণ চিন্তা না করলেই তো সমাধা করা যায় এমন সব কাজ, যা ডেকে আনে সর্বনাশ। ‘ম্যাকবেথ’ও দ্রুত শিখে নেয় ‘চিন্তাশূন্য’ হতে পারার মন্ত্র। কারণ প্রবল ক্ষমতালিপ্সা তার বুকের ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়েছিল সামান্য নাড়া দিতেই সে ফণা তোলে...
ম্যাকবেথ বড় প্রকট, বড় স্বচ্ছ। কিন্তু পৃথিবী আরও বহু শাসক দেখেছে, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ‘শাসন’ কাকে বলে। যেমন, দু’হাজার বছরের প্রাচীন রোমান সম্রাট ‘ক্যালিগুলা’। বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত সময়কালে লেখা আল্ব্যের কামুর অসামান্য নাটক ‘ক্যালিগুলা’ মঞ্চস্থ করে নির্দেশক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রযোজনা: ‘প্রাচ্য’ নাট্যদল) এই মুহূর্তের ভারত তথা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা নানান রকমের শক্তি প্রদর্শনের, অন্যায়-অবিচারের ছবি তুলে ধরেছেন।
‘কেউ একা হতে পারে না’। ‘প্রাচ্য’ নাট্যদলের ‘ক্যালিগুলা’ নাটকের একটি দৃশ্য।
বোন ও প্রেমিকা দ্রুসিলার মৃত্যুর পর থেকে ক্যালিগুলা ‘চাঁদ’ খুঁজতে থাকে। উদ্ভ্রান্ত সম্রাট বলে, ‘এখনও পাইনি, আরও খুঁজতে হবে, আরও... আমাকে যে এমন কিছু পেতে হবে, যা আর কেউ পেতে পারে না...’ খুঁজতে গিয়েই ক্যালিগুলা বাজি রাখে নিজের জীবন। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ের সে বাজি রাখে গোটা দেশটাকে, অগণিত মানুষকে। এক অর্থহীন শূন্যতার ভেতর একা দাঁড়িয়ে সে গোটা সমাজের ওপর নামিয়ে আনে এক রক্তক্ষয়ী অভিশাপ।
ভারতের দিকে তাকালে মাঝেমধ্যে ভ্রম তৈরি হয়। ‘উন্নয়ন’-এর দামামা, গরিব মানুষদের জন্য কতশত প্রকল্প ও প্রতিশ্রুতি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, সচিন তেন্ডুলকরের রাজকীয় প্রস্থানে উদ্বেলিত আসমুদ্রহিমাচল, যেন ‘সব ঠিক আছে’। মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হানা, উগ্রপন্থীদের আক্রমণ, কয়েকশো নিরপরাধ মানুষের অসহায় বলিদান একটু নাড়িয়ে দিয়ে যায় বটে, কিন্তু দ্রুত, খুব দ্রুত আমরা সামলে নিই, আশ্বস্ত বোধ করি, শপিং মলে যাই, দুর্গাপুজো, ধনতেরাস, গণেশ পুজো, দীপাবলি উপলক্ষ করে, কিংবা কোনও উপলক্ষ ছাড়াই পকেট উজাড় করে নিজেদের ভুলিয়ে রাখি। সামনের বছর গণতান্ত্রিক মহোৎসবের অংশীদের হতে পারব ভেবে গর্ববোধ করি। কারণ দেশের শাসক এবং বিরোধী দল আমাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, চাঁদ ধরার স্বপ্ন।
এরই মাঝে উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরে প্রাণ হারালেন ষাটজন মানুষ, ঘরছাড়া চল্লিশ হাজার। অধিকাংশই সংখ্যালঘু মুসলমান। প্রচার করা হল, ‘এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের বহু-বেটিদের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করছে।’ গোটা দেশে, হিন্দু, মুসলমান বা অন্য যে কোনও ধর্মের নারীরাই যে পথেঘাটে, কর্মস্থলে, এমনকী নিজেদের বাড়িতেই নানান ভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন, সেই সত্যিটাকে পাশ কাটিয়ে আওয়াজ তোলা হল, মেয়েদের সম্ভ্রম লুঠ করছে মুসলমানরা। অমনি ‘বদলা’ নেওয়ার জন্য অস্ত্র হাতে মাঠে নেমে পড়ল ঘাতক বাহিনী। সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তৈরির রাস্তাটা তো আর কারও একচেটিয়া নয়। হিন্দু মৌলবাদীদের মতো মুসলমান মৌলবাদীরাও একই জিগির তোলেন। যাঁরা এই সাম্প্রদায়িক এবং জাতপাতের রাজনীতি করেন, তাঁরা জানেন এর পরিণাম কত মারাত্মক, কত সুদূরপ্রসারী। ঠিক যেমন জানতেন সম্রাট ক্যালিগুলা। এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী যখন বলেন ‘...স্বেচ্ছাচারী উন্মাদ সম্রাট আমরা দেখেছি। কিন্তু ক্যালিগুলা ঠিক উন্মাদ নয়। কারণ ও জানে ও কী করতে চায়।’ সে স্থির ভাবে জানে সব কিছু, সে পারে মানুষের বুকের মধ্যে ভয়কে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই সে হাসিতে ফেটে পড়ে বলতে পারে, ‘...মান, সম্মান, বোধবুদ্ধিগুলি কেমন একে একে খসে পড়ছে দেখো। ভয়। ভয় একটা মহান আবেগ, একেবারে শুদ্ধ, সহজ এবং পরিপূর্ণ...’
উগ্র জাতীয়তাবাদ, ততোধিক উগ্র অথচ সাবধানী সাম্প্রদায়িক ধ্বনি এবং উন্নয়নের চোখধাঁধানো সংমিশ্রণ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে আলোচিত এবং আলোকিত নেতা নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে দাঁড়িয়েছেন আমাদের সামনে। এক বিধ্বংসী মতবাদ ও স্বপ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। কোনও সন্দেহ নেই, সময়টাও উপযুক্ত। দরিদ্র পরিশ্রান্ত, প্রতি দিন একটু একটু করে ধুঁকতে থাকা মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের নানান কাজে বিরক্ত, বিধ্বস্ত। তার আঁচ ছড়াচ্ছে গ্রাম থেকে শহরেও। আর এক সম্রাটের সময়কালকে মনে করাচ্ছে।
এব্রাহাম এরালি-র লেখা এম্পারার্স অব দ্য পিকক থ্রোন বইটিতে আওরঙ্গজেবের বিপুল সাম্রাজ্যের পতনের শেষ পর্বটি পড়লে চমকে উঠতে হয়। অধ্যায়টির নাম ‘অব দ্য ফিউচার দেয়ার ইজ নো হোপ’। যে ভয়ানক রক্তপাত ঘটিয়ে আওরঙ্গজেব মসনদে বসেছিলেন, তার পেছনে ছিল অমর্ত্য সেন যাকে বলেছেন ‘সুচিন্তা’র অভাব। তাই তাঁর সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল অবিশ্বাস্য ভাবে। এব্রাহাম এরালি বলছেন, ‘আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সম্ভবত এখানেই যে তিনি আসলে ছিলেন এক দুর্বল শাসক, অর্থাৎ প্রচলিত ধারণার ঠিক উল্টো, আনুগত্য আদায়ের জন্য বলপ্রয়োগ করতে তিনি দ্বিধান্বিত ছিলেন।’ (পৃ ৫০৭)। ইতালীয় পরিব্রাজক নিকোলাও মানুচ্চিকে (যিনি কাছ থেকে দেখেছেন মুঘল সাম্রাজ্যের পতন) উদ্ধৃত করে এব্রাহাম এরালি জানাচ্ছেন, বিধ্বস্ত, অসুস্থ সম্রাট আওরঙ্গজেব এক সময় আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমি বলে বলে অমিতবাক হয়ে গেলাম, কিন্তু তোমরা কেউ আমার কথায় কান দাওনি।’ ঠিক এমনই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে, যখন দেশে কোথাও শাসন নেই, সাম্রাজ্যের প্রতিটি ইঞ্চি যখন দুর্নীতিতে ভরে গিয়েছে, জায়গিরদার, ফৌজদার, জমিদাররা লুঠ করছে সম্পদ, ঠিক সেই সময়ে মরাঠাদের আগ্রাসী আক্রমণ ত্বরান্বিত করল মুঘল সাম্রাজ্যের পতন।
মরাঠা সাম্রাজ্যের উত্থানকে অনেক সময় পেশ করা হয় ইসলামি গোঁড়ামির বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মের মুক্তির লড়াই হিসেবে। আসলে তা ছিল নিছকই ক্ষমতা দখলের লড়াই, ঠিক আজকের মতো। জাতপাত বা ধর্মীয় ভাবাবেগকে যে ভাবে কাজে লাগায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ঠিক একই ভাবে সেই সময়েও চলেছিল সুবিধাবাদের খেলা। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই গরিব অসহায় মানুষকে শোষণ করতে মরাঠা রাজপুত মুঘল, কেউ পিছপা হয়নি। শাসকদের মতিগতি আজও পাল্টায়নি, বরং ভয়টা আরও বেড়েছে। কারণ আল্বেয়্র কামু-র ভাষায়, ‘আমাদের ক্রিমিনালদের... হাতে আছে মোক্ষম দার্শনিক অজুহাত, যে কোনও উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যা ব্যবহার করা যায়, এমনকী ঘাতকদের বিচারকের আসনে বসানোর জন্যও।’
গৌতম হালদারের অসামান্য অভিনয়ে সমৃদ্ধ ‘ক্যালিগুলা’ এই সর্বনেশে জীবনদর্শনকে প্রতিষ্ঠা করে। বিরতির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ক্যালিগুলা বলে, ‘কেউ একা হতে পারে না, কারণ আমাদের চারপাশে ভিড় করে থাকে আমাদের অতীত, আমাদের ভবিষ্যৎ, তাড়া করে বেড়ায় আমাদের...’। কথাগুলো শুনে তরুণ কবি স্কিপিও ক্যালিগুলাকে প্রশ্ন করেন, ‘তবে মানুষের নিভৃত নিরাময় কীসে? কোথায় আছে আশ্রয়? তোমার মধ্যে তেমন কিছু নেই?’ ক্যালিগুলা, ‘আছে। ও রকমই কিছু একটা আছে ঘৃণা!’
এই শান্ত, অমোঘ উচ্চারণের সঙ্গে ভয়ংকর নির্জন ও আদিম কয়েকটি ঘৃণার মুখোশ পরিহিত ছায়ামূর্তিরা বিভিন্ন জ্যামিতিক ফ্রেমের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। মুহূর্তে মনে হয়, ক্যালিগুলার শরীর চুঁইয়ে পড়া শ্যাওলা মাখা ‘ঘৃণা’র গন্ধ যেন ঢুকে পড়ল আমাদের প্রত্যেকের শরীরে, রক্তকণিকায়। এক বার তা শরীরে মিশে গেলে যুক্তিতর্ক কোন অলৌকিক জ্যোৎস্নায় হারিয়ে যায়। জেগে থাকে শাসকের দেওয়া রঙিন স্বপ্নের ফানুস আর পরস্পরের প্রতি এক অন্তহীন ঘৃণা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.