অশোকামিত্রন
মার প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদটি নেহাতই মামুলি। তার বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে একখানি ভারী সুন্দর মেয়ের মুখের ছবি। বইটির নাম অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা, লেখকের নাম আরও ঝাপসা। এই বইটিই আবার আমার প্রথম উপন্যাসও। ১৯৬৯ সালে আত্মপ্রকাশের পর বইটি কিছুটা সাড়া ফেলেছিল। আমি এমনিতে চাইছিলাম একটা ছোট গল্পের সংকলন বের করতে। সেই সময় তিরিশটিরও বেশি প্রকাশিত গল্প আমার কাছে ছিল। কিন্তু প্রকাশকরা জানালেন, ছোট গল্পের নাকি তেমন বিক্রি নেই। আর আমার তো কোনও খ্যাতিও ছিল না, কারণ তখনও অবধি তো আমার একটাও বই বের হয়নি।
তবে একদম অংকের হিসেবে, এই উপন্যাসটিকে ঠিক প্রথম বলা চলে না। ১৯৫৭ সালে আমি একটি আধখানা উপন্যাস লিখেছিলাম এবং একটি ছোট উপন্যাস লিখেছিলাম ১৯৫৯-এ। আমার সমস্যাটা ছিল, বহুল প্রচারিত ম্যাগাজিনগুলো আমার লেখা গল্প ছাপতে একটু অস্বস্তি বোধ করত। লিট্ল ম্যাগাজিনগুলো আমার লেখা ছাপত বটে, কিন্তু তাদের ঝামেলা: তারা তো কয়েকশো পাঠকের বৃত্তের বাইরে যেতেই পারত না।
আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসটিও ‘দীপম্’ (আলো) নামে একটি লিট্ল ম্যাগাজিনেই বের হয়েছিল। সম্পাদক আমাকে একটি ধারাবাহিক উপন্যাসের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আবার বার বার পীড়াপীড়ি করতেন গোটা উপন্যাসটার একটি সারাংশ জমা দেওয়ার জন্য। এ দিকে, আমি কখনও আমার গল্প বা উপন্যাসের পুরোটা আগাম ছকে রাখি না। যাঁরা সাহিত্য করবেন বলে ভাবছেন, তাঁদের অবশ্য আমি এই পদ্ধতিটা অনুসরণ করতে বলব না। আসলে সৃষ্টিশীল লেখার ক্ষেত্রে, এক জন যেটায় স্বচ্ছন্দ, অন্য জন সেটায় না-ও হতে পারেন।
কিন্তু সম্পাদক নাছোড়, আমাকে একটা সারাংশ দিতেই হবে, তাই শেষ অবধি আমি একটা সারাংশ বললাম বানিয়ে বানিয়ে। শুনেই তিনি তক্ষুনি জানালেন, তিনি নিজেও ঠিক ওই বিষয়ের ওপরই একটা উপন্যাস লেখার কথা ভাবছেন। কিন্তু আমার ধারাবাহিকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল, তাই আমি আবার নতুন আর একটা সারাংশ বলার হাত থেকে রেহাই পেলাম। এই ছিল আমার ‘কারাইন্দা নিজহালগল’ (মিলিয়ে যাওয়া ছবি) লেখার প্রেক্ষাপট।
উপন্যাসটি কোনও একটা টানা গল্প বলে না। বরং এটায় আলাদা আলাদা দশটা টুকরো আছে। তাই দেখে আমার সম্পাদক খুব ধন্দে পড়ে গিয়েছিলেন। যদিও এটি ভাগ ভাগ করে প্রকাশিত হয়েছিল, তা সত্ত্বেও সবচেয়ে সোচ্চার রাজনৈতিক দলগুলির নজর কেড়ে নিয়েছিল। সাহিত্যের সমালোচকরা অবশ্য প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলেন। এত দিনে তাঁরা এমন এক উপাদান পেলেন, যা নিয়ে যথেচ্ছ আলোচনা বা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা যায়।
সেই সময় বিভক্ত কমিউনিস্টরা ঘোষিত ক্যাপিটালিস্টদের চেয়েও বেশি সমালোচনায় নিজেদের বিঁধে চলেছে। এক দল আমার উপন্যাস সম্বন্ধে বলল, তারা যে যে নীতিকে সমর্থন করে এসেছে, তাদের সব ক’টির স্বপক্ষে এটি একটি বজ্রগর্ভ মতামত। অন্য দল এর মধ্যে অন্তত একশোখানা জন-বিরোধী ঘোষণা খুঁজে পেল এবং আমাকে বলতে লাগল ‘জনগণের শত্রু’।
আমার উপন্যাসটা সাধারণ মানুষের হাতে আসতে কিছুটা সময় লেগেছিল। ১৯৭৫ সালের আগে পর্যন্ত, রাজনৈতিক দলগুলির সাহিত্য-শাখার বাইরে কেউ বোধ হয় আমার বইটা পড়েনি। সারা বিশ্বে সবচেয়ে কম-পড়া বইগুলোর মধ্যে একটি ছিল আমার প্রথম বই। বহু-প্রতীক্ষিত একটি লাইব্রেরি অর্ডারও আমরা পাইনি। তবে বলতেই হবে,আমার প্রকাশক মানুষটি ভারী ভাল ছিলেন। তিনি রয়্যালটি-র হিসেবটিসেব করে আমার সমস্ত পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দেন। এখন অবশ্য, প্রথম প্রকাশের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও, উপন্যাসটির ভালমত চাহিদা। দু’বার এটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। দ্বিতীয়টি, যার নাম ‘স্টার ক্রস্ড’, ক্রসওয়ার্ড প্রাইজ-এর জন্য শর্টলিস্টেডও হয়েছিল।
এ বার উপন্যাসটার বিষয় সম্বন্ধে দু-চার কথা বলি এতে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা দশটি অধ্যায় ছিল, যেগুলো পড়লে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে প্রত্যেকটায় আলাদা আলাদা গল্প বলা হচ্ছে, কিন্তু শেষে গিয়ে পাঠকরা খুঁজে পাবেন সেই একই মানবিক-ট্র্যাজেডি, যা শতকের পর শতক ধরে লেখা হয়ে আসছে। এও মনে হবে, কিছু চরিত্র ক্রমশ বড়লোক হয়ে উঠছে, কিন্তু সেটাও আসলে একটা ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমি বহু বার বলেছি, এই উপন্যাসটা আমার খুব পছন্দের তালিকায় পড়ে না। কিন্তু কালপঞ্জির দিক থেকে দেখতে হলে এটাই আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। তাই মাঝেমধ্যেই আমাকে এটি সম্পর্কে কথাবার্তা বলতেই হয়। সত্যি বলতে কী, এটিকে অবলম্বন করে সিনেমা বানানোর প্রস্তাব নিয়ে কেউ আমার কাছে এলে, একটু অপ্রস্তুতই হয়ে যাই। এমনটা বার বারই ঘটেছে। কিন্তু সরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নেওয়া আর পাঁচটা জমকালো পরিকল্পনার মতোই, শেষ অবধি কোনও কিছুই হয়ে ওঠেনি। ক্ষতি নেই, কারণ আমি লিখি শুধুমাত্র মানুষের পড়ার জন্য। যদি তার কল্পনায় কিছুমাত্র চাঞ্চল্যও তৈরি হয়, তা হলেই আমি খুশি।
উপন্যাসটি জড়িয়ে আরও কয়েকটি স্মৃতি আছে। আমি খোলা জায়গায় কাজ করতে পছন্দ করি। উপন্যাসের বেশির ভাগ অংশই একটা পার্ক-এ বসে লিখতাম। একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চে বসলে, লেখাটা ভাল ‘আসত’। ভোর ছ’টায় পার্কে গিয়ে যদি দেখতে পেতাম বেঞ্চটা ইতিমধ্যেই দখল হয়ে গিয়েছে, দারুণ নিশ্চিন্ত হতাম। যাক বাবা, আজকে আর লিখতে হবে না! পার্কে গাছপালা তেমন ছিল না। সাতটা নাগাদই সূর্যটা একেবারে নির্দয় হয়ে উঠত। সুতরাং লেখার জন্য আমার হাতে আর পড়ে থাকত মোটে আধ ঘণ্টা।
ওই পার্কে বসেই আমি একগাদা গল্প, দুটি উপন্যাস, প্রচুর অনুবাদ, সেমিনার পেপার, এমনকী একটা নাটকও লিখে ফেলেছি। তবে পরিচিত কেউ এসে পাশে বসে হাজারখানা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলে আমায় লেখার আশা ত্যাগ করতে হত। এক জন জ্যোতিষী ছিলেন। ইনি প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, আমি আমার ভবিষ্যৎ জানতে ইচ্ছুক কি না। আমি জানতাম, উনি গরিব মানুষ। আমার কাছ থেকে দুটো পয়সা পেলে এক কাপ কফি কিনতে পারেন। আর এক জন বন্ধু ওখানে আসতেন সিগারেট খেতে এবং তিনি বুঝেছিলেন, আমার লেখায় বাধা দিতে পারলে ধোঁয়ার স্বাদটা তাঁর অনেক বেশি ভাল লাগে। বাঁচতে গেলে প্রত্যেককেই কাজ করতে হয়, কিন্তু মানুষ বোধ হয় অন্যকে কাজ করতে দেখলে সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু আমি এই ধরনের ব্যাঘাতে দুঃখ পেতাম না। আমার লেখা বন্ধ করতে পেরে ওঁরা বোধ হয় সত্যিকারের সুখ পেতেন। আর আমার একটা আন্দাজ: এঁরা আমার কিছু লেখা পড়েছিলেন এবং খুব তীব্র ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, আমার একদম লেখালিখি করা উচিত নয়। ওঁরাই ছিলেন আমার সবচেয়ে সেরা সমালোচক।
প্রায় পনেরো বছর ধরে পার্কটি আমার এলোমেলো লেখাগুলির সৃষ্টিতে সাহায্য করে এসেছে। তার পর এটা অসম্ভব ঘিঞ্জি আর কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে। আমি ওখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু আমার সম্বন্ধে যখনই কেউ কিছু লিখতে যান, পার্কের কথাটা অবধারিত ভাবে উঠে আসে। আসলে, মানুষ যে সমস্ত খারাপ কাজ করে, তার রেশ ঘটনার অনেক দিন পরও থেকে যায়!

লেখক মূল লেখাটি ইংরেজিতে লিখে পাঠিয়েছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.