মুখোমুখি...
সুযোগ এলেও ওকে আবার বিয়ে হয়তো করতাম না

পত্রিকা: গত বছর অষ্টমীর রাত শেষে উনি চলে গিয়েছিলেন। এ বার পুজোয় আপনি কলকাতায় থাকলেন না, তা কি কিছুটা ওই স্মৃতি থেকে পালাতেই?
স্বাতী: সুনীল সাধারণত পুজোটা বিশ্রামই নিত। বড়জোর আমরা একটু শান্তিনিকেতন যেতাম। এ বারও তাই যাব ভেবেছিলাম। তা বোনেরা বলল, ওদের সঙ্গে যেতে। এক মাসি-মেসোসুদ্ধ সিনিয়র সিটিজেনদের বড় দল মিলে অমৃতসর, ডালহৌসি, কাশী, দিল্লি ঘুরে এলাম।

পত্রিকা: এই একটা বছর মানে তো আপনার জন্য অনেক কিছুর বদল?
স্বাতী: আসলে একলা থাকাটা ক্রমশ বুঝতে পেরেছি। গত বছর ও চলে যাওয়ার পরেই আমেরিকায় ছেলের কাছে চলে যাই। তখনও আমি ঘোরের মধ্যে। ক্রমশ বুঝতে পেরেছি সুনীলকে নিয়ে আমার টুকরো-টাকরা কতটা সময় কাটত...

পত্রিকা: আপনার মধ্যে তো একটা ভয় ছিল, ওঁর আগে আপনি চলে গেলে উনি কী ভাবে সব-কিছু সামলাবেন? কে ওঁকে দেখবে?
স্বাতী: আমার সব থেকে ভয় হত, ওর একদম বিশ্রাম হবে না। ওকে যেখানে সেখানে টেনে নিয়ে যাবে। ও তো সহজে না বলতে পারত না। অনেকেই শুধু নিজের স্বার্থটা বোঝে। একবার দেশের অন্য একটি শহরে এক মহিলা তো অসুস্থ সুনীলকে হাসপাতাল থেকে বের করে অনুষ্ঠানে নিয়ে গেল। ও কথা দিয়েছিল, বলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নিয়ে যাওয়াটা কি উচিত হয়েছিল?

পত্রিকা: ওঁর হয়ে না বলার কাজটা কি আপনাকেই করতে হত?
স্বাতী: আমি দু’চারবার চেষ্টা করেছি। খুব একটা আটকাতে পারিনি। দেখো, অনেকেই এত যেতেন না। আমার মনে হত লেখার জন্য সময় দিতে পারছে না। চিন্তা করতে পারছে না। লেখা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওকে সেটা বলতামও। সভা-সমিতিতে যেতে গিয়ে ওর অনেক লেখা নষ্ট হয়েছে। এত চাপ নিতে গিয়েই হয়তো মৃত্যুও এগিয়ে এল।
পত্রিকা: আর লেখার বাইরে আপনাকে সময় দিতে পারা না-পারা নিয়ে কিছু মনে হত?
স্বাতী: আমার মাঝেমধ্যে খুব অভিমান হত। হয়তো দু’জনে বসে খাচ্ছি। কোনও কথা নেই। আমি বলতাম তোমার স-ব বাইরের লোকের জন্য জমিয়ে রেখেছ।

পত্রিকা: এটা বোধহয় সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই কম-বেশি হয়...
স্বাতী: হতে পারে। আসলে আমি ক্রমশ বুঝতে পেরেছি, ছেলেদের ভালবাসাটা এমনই। ছেলেরা কখনও ততটা ভালবাসতে পারে না। সুনীলের জীবনেও তো শুধু আমিই একমাত্র কেউ নই। অনেকের সঙ্গেই ওর অনেক ধরনের সম্পর্ক ছিল।

পত্রিকা: এটা কি খ্যাতির বিড়ম্বনা?
স্বাতী: বিড়ম্বনাই বা বলি কী করে! আমি একলা নীরা হলে তো খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার হত। আমার ভেতরটা নিংড়ে নিয়েছে। খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু উনি তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একটা জায়গাতে উনি আলাদাও। সুমিত্রাদি বলে আমাদের কাছের একজন, আমায় খুব ভালবাসতেন। তিনি বলতেন, স্বাতী এটা বুঝতে হবে, অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ক্রিয়েটিভ মানুষদের জীবনে অনেক কিছু হয়! সুনীলের কিছু লেখা পড়ে আমার এখনও রাগ হয়। অভিমান হয়। কোথাও কোথাও কাউকে চিনতে পারি।

পত্রিকা: আপনি মেনে নিতেন?
স্বাতী: দেখো, সব সময় সুনীলকেও আমি খুব দোষ দিতে পারি না। বলতে খারাপ লাগছে, কোনও কোনও মেয়ের আচরণে ওরও অস্বস্তির কারণ ঘটত। ও সচরাচর রুক্ষ ব্যবহার করতে পারত না। একজন মহিলা, সে-ও কবি, বলত, স্বাতীদি এত মেয়ে এসে ঘাড়ে পড়ে তুমি কিছু বলো না!

পত্রিকা: আপনি কিছু বলতেন না?
স্বাতী: একবার, অনেক বছর আগে ওর ওপরে রাগ করেই মনে হয়েছিল জীবনটা তছনছ করে দিই। আমিও তো কারও কারও মনোযোগ পেতাম। তখন একটি ছেলে, আমি জানতাম ভাল ছেলে নয়, তবু জেনেশুনেই...ট্র্যাপ্ড হয়ে যাই! উফ্ হাঁদার হাঁদা আমি, একটা বড় ক্রাইসিস তৈরি হয়েছিল। তবে সেটার থেকে বেরিয়ে আসি। সুনীলকে কিছুই গোপন করিনি। বলেওছিলাম সবটা।

পত্রিকা: উনি কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করেন?
স্বাতী: ও তো শুনেই বলে, চুপ করো, কী হবে এ সব মনে রেখে। কোনও বাড়তি কৌতূহল দেখায়নি। আমার তখন মনে হচ্ছে, লোকটার একটু ঈর্ষাও নেই। ও কি সত্যিই আমায় ভালবাসে...

পত্রিকা: প্রশ্নের জবাবটা পরে পেয়েছেন?
স্বাতী: আমার মধ্যে সেই অভিমান এখনও আছে। আমি তো এখনও ওর সঙ্গে কথা বলি, তুমি কি সত্যিই আমায় ভালবেসেছিলে? আমি শিওর হতে পারি না। হয়তো বাসত। মনে মনে ঝগড়া করি এখনও। আসলে সুনীলের মধ্যে একটা বন্ধ দরজা ছিল। সেটা ও আমার কাছে খোলেনি। জানি না, আর কারও কাছে খুলেছে কি না...

পত্রিকা: ওঁর কথা ভাবলে এখন কোন্ বয়সের চেহারাটা বেশি চোখে ভাসে?
স্বাতী: শেষ দিকের রোগা হয়ে যাওয়া চেহারাটা একদম দেখি না। অল্পবয়সের চেহারাটাও ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। মাঝখানের মোটাসোটা চেহারাটাই যেন বেশি দেখতে পাই।

পত্রিকা: খুব স্বপ্ন দেখেন?
স্বাতী: আমার খুব আফশোস একদম স্বপ্ন মনে রাখতে পারি না। সুনীলের কী সুন্দর মনে থাকত। দু-একবার দেখেছিলাম সুনীলকে। বোধহয় একসঙ্গে ক’জন মিলে আড্ডা মারছে না কী যেন...এখন একদম দেখি না। খুব মনে হয় একবার ওকে যদি দেখতে পেতাম। কত আশ্চর্য ঘটনাও তো শোনা যায়! আবার এটাও মনে হয়, মৃত্যুর পরে এ সবই মানুষকে কষ্ট দেওয়া। নাহ্ চাই না! কী দরকার...
ছবি: শিবশঙ্কর দে।
পত্রিকা: কবিতার সুনীল আর নিখিলেশ তো নিজেদের জীবন পালটে নিয়েছিল। যশস্বী এক সাহিত্যিক ও তাঁর নেপথ্যচারিণী স্ত্রী হয়ে এতগুলো বছর কাটিয়ে কি কখনও মনে হয়, নিজেদের জীবনটা তেমন পালটাপালটি করা গেলে কেমন হত?
স্বাতী: (হাসি) এটা আমি মাঝেমধ্যে ওকে বলতাম। এই যে আমার জীবন আর তোমার যা জীবন, যদি উল্টোটা ঘটত। এটাও কিন্তু দেখা যায়, মহিলাটি বিখ্যাত, পুরুষটিকে আলাদা করে লোকে চেনে না। পুরুষমানুষ সচরাচর এটা সহ্য করতে পারে না। তবে আমার জীবন নিয়ে কোনও ক্ষোভ নেই। পেয়েছিও অনেক।

পত্রিকা: তবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী হওয়ার একটা চাপ বোধহয় ছিলই।
স্বাতী: তুমি ঠিকই বলছ। তবে এটাও ঠিক কত জনের ভালবাসা পেয়েছি, এত সম্মান। ওর জন্যই পেয়েছি। ও আমার জন্য করেছেও অনেক। আমি ঘুরতে ভালবাসি, আমায় ধার করেও বিদেশে নিয়ে গিয়েছে। কিছু দুঃখ, অপমান সয়েছি। পেয়েছি অনেক। বলব, পাওয়ার পাল্লাই বেশি।

পত্রিকা: কিন্তু সুনীলের স্ত্রী এই পরিচয়ের বাইরে আলাদা করে নিজেকে খুঁজতে ইচ্ছে করেনি?
স্বাতী: ভীষণ! একবার বাংলাদেশের এক বন্ধু প্রায় ঠিকঠাক করে দিয়েছিল। তেহরান না কোথায় যেন চাকরি করব। স্কুল-টুলে পড়াব। এই নিয়ে সুনীলের একটা লেখাও আছে। কখনও মনে হয়েছে রাত্তিরের ট্রেন ধরে একা চলে যাই, কোনও অজানা স্টেশনে গিয়ে নামব।

পত্রিকা: এ তো ধলভূমগড়ের মতো অ্যাডভেঞ্চার...
স্বাতী: না অ্যাডভেঞ্চার নয়! খুব সিরিয়াসলিই সব ছেড়েছুড়ে যেতে ইচ্ছে করেছে। তারপর ছেলে তখন ছোট, আমার শাশুড়ি মা আমায় খুব ভালবাসতেন, আমার মা-বাবা কষ্ট পাবেন! এ সব ভেবেই আর পারিনি। পেরে উঠিনি।

পত্রিকা:জীবন আবার নতুন করে শুরু করা গেলে ফের এ ভাবেই কাটাতেন...
স্বাতী: দেখো আমার কোনও আফশোস নেই। আমি সুনীলকে সত্যিই ভালবেসেছিলাম। ওর এই প্রেমিক ইমেজটাই সব নয়। এত ভাল মানুষ, এত ভাল অন্তঃকরণ আমি খুব কম দেখেছি। এই জন্যই শুধু মেয়েদের নয়, এত জনের এত ভালবাসা পেয়েছে। তবে ওকে বিয়ে হয়তো করতাম না।

পত্রিকা: তাহলে...
স্বাতী: ধরো, যেমন জাঁ পল সার্ত্র আর সিমোন দ্য বোভেয়ার সম্পর্ক। ‘দু’জনেরই আসা যাওয়া, খোলা রবে দ্বার!’ একটা ফিল্ম আমি সবাইকে দেখতে বলি, বার্গম্যানের সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ। এক দম্পতির ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে, কিন্তু বার বার দেখা হচ্ছে। ওদের জীবনে ক-ত জন আসছে, যাচ্ছে, বিয়ে করছে, ভাঙছে। আসল জুড়ি কিন্তু ওরাই।

পত্রিকা: মানে, ভেতরের সম্পর্কটাই আসল।
স্বাতী: (কিছু ক্ষণ চুপ) হ্যাঁ, তাই! অনেক কথা বলে ফেললাম। আসলে এক এক সময় মনটা দ্রবীভুত হয়ে যায়। অনেক কথা বেরিয়ে যায়। আমার তো এখন কোনও বন্ধু নেই।

পত্রিকা: ওঁর সঙ্গে ঠিকঠাক কথা হত না-বলে এত অভিমান করতেন। তবু ওঁকেই এতটা মিস্ করেন...
স্বাতী: (মৃদু হাসি) শান্তিনিকেতনের বারান্দায় দু’জনে বসে আছি। আমি ওর হাতটা একটু ধরলাম। কোনও কথা নেই। কিন্তু একটা অদ্ভুত কমিউনিকেশন তৈরি হল। এ সবই বড্ড মনে হয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.