হাঁড়ির খবর
বঙ্গে সুইস কানেকশন
দার্জিলিংটাই বরং এখন দুর্গম ঠেকছে। কিন্তু সুইৎজারল্যান্ড দিব্যি কাছে চলে এসেছে।
নইলে বর্ষার কলকাতায় বরফমোড়া আল্পস উপত্যকার সৃষ্টি আখরোটের পুরভরা মিষ্টি খেয়ে মার্কো স্যাক্সর কখনও এমন গদগদ হয়ে ওঠেন! বৃষ্টি ধোয়া বিকেলে তখন টাটকা রোদের ঝলক। সুইসোতেলের সুইস কাফে-য় বসে হোটেলের জিএম মার্কো স্যাক্সরের চোখ দু’টোও জ্বলে উঠল। এ তো একেবারে দেশের মতো হয়েছে! আখরোটের পুরভরা ময়দার প্যাটির ভাল নাম এনগাদিনার নুস তর্তে। দক্ষিণ-পুব সুইৎজারল্যান্ডে আল্পস উপত্যকায় বড় মনোরম ‘স্পট’ এনগাদিনার। সুইস-জার্মানে নুস মানে আখরোট। তর্তে হল টার্ট। বাইরেটা মুচমুচে, ভেতরটা নরম। আমাদের গজা-লবঙ্গলতিকা, ভূমধ্যসাগরপারের বাকলাভা ইত্যাদির জাতভাই বলা চলে। এই তর্তে অনেকটা ভেঙে গপাগপ মুখে পুরে মার্কো বলেন, “এ সব হাই-ক্যালরি বস্তু বাড়িতে আমায় ছুঁতে দিতেই চায় না। ভাগ্যিস, এটা কলকাতা!”
খাস জুরিখ থেকে হাজির শেফ রিকার্ডোর সৌজন্যে নিউটাউনের জমির পাঁচতারায় সুইস দেশের মিট্টি কা খুশবু এখন ভুরভুর করছে। এই সন্দেশ-রসগোল্লার দেশ অবশ্য বরফি-লাড্ডুর বাইরে মিষ্টি বলতে সুইৎজারল্যান্ডই বোঝে। সুইস-শিল্পী ফ্লুরিসাহেবকে বাদ দিয়েই বা কী করে এ শহরের ইতিহাস লেখা হবে? গাজর কা হালুয়ার দেশকে সুইসরা এ বার এক অদ্ভুত নির্ভার ক্যারট কেক (রুবলি তর্তে) খাওয়ালেন। যেমন খেতে, তেমনই সুন্দর দেখতে। ওপরে গাজরের আদলে লালচে একটা মার্জিপ্যান সাজানো।
এক সময়ে সুইস চকোলেট আমাদের কাছে প্রায় কোহিনূর ছিল। এখন বিশ্বায়নের যুগে সেই রোমাঞ্চ শেষ। তবু সুইস দেশের শেফের হাতের তবলোরেন চিজকেক চাখলে এখানেই স্বর্গ মনে হয়। তবলোরেন, বলা বাহুল্য, সেই বাদাম-টাদাম ভরপুর চকোলেট বার। তাতেই চিজকেকটা হয়েছে। আর লিন্ড চকোলেটের ফন্দু যেন জিভে ঈশ্বর। সুইসোতেলে দুরন্ত মার্শম্যালো তৈরি হয়। স্পঞ্জের মতো মোলায়েম সে-টফি। এ ছাড়া, গুচ্ছের প্লাম, আম, পেঁপে, আনারসের টুকরোও রয়েছে। কাঁটায় বিঁধিয়ে এক-এক টুকরো ফল বা টফি তপ্ত চকোলেটের বাটিতে চুবিয়ে খাওয়ার নিয়ম। চকোলেটের এমন সস কদাচিৎ কপালে জোটে। মিষ্টির বাড়াবাড়ি নেই। আর চকোলেট-সুলভ রমণীয় তিক্ততাটুকু প্রেমিকার ঠোঁটে আলগা চুমুর রেশের মতো ছুঁয়ে।
ফন্দুর সঙ্গে কলকাতায় সম্পর্কটা অবশ্য প্রদীপ রোজারিওর দৌলতে গাঢ় হয়েছে। প্রদীপের কে কে’জ ফিউশনে ফন্দুর দারুণ কদর। চিজ সসে ডুবিয়ে মাছ-মাংস-ব্রেডের কিউব চাখার ব্যবস্থা। সুইসোতেলে শেফ রিকার্ডো বলছিলেন, দু’ধরনের সুইস চিজ এমেন্থল ও গ্রুভিয়ের না-মেশালে কিন্তু এই চিজ সসটা ঠিক পোক্ত হবে না। একটু চেরি ব্র্যান্ডির ঝাঁঝটাও দরকার। সুইসোতেলের ফন্দু শাকাহারীদের বিশেষ পছন্দ হবে। সুইসরা বলে, চিজ-টিজ জমিয়ে খেলে সঙ্গে মাংস খাব না! চিজে চুবিয়ে ব্রকোলি, আচারি স্বাদের গেরকিন, ডুমো ডুমো কাটা আলু, ব্রেডের টুকরো চাখাটা বেশ মজাদার। ফন্দু কেউ একা খায় না। এটা সবাই মিলে টেবিল ঘিরে বসে ভাগাভাগির পদ। খাঁটি সুইস-সাহেব মার্কোর সঙ্গে ফন্দু খেতে বসলে অবশ্য সাবধান! তাঁর নিদান, কাঁটায় বেঁধা সব্জি বা ব্রেডের টুকরো যাঁর হাত থেকে চিজের মধ্যে খসে পড়বে তাঁকেই এ বেলার খানার দক্ষিণা মেটাতে হবে। সাধারণত, কলকাতা এখন মিষ্টির বাইরে সুইস পদ বলতে ফন্দু, রাকলেত আর রোস্তি বোঝে। রাকলেতও গলানো চিজ। আর রোস্তি ঠিক যেন ফুটপাথের টিকিয়া চাটের আলু টিক্কি। মাখন-টাখন দিয়ে রান্না এমন আলু টিকিয়ার ওপরটা মুচমুচে পোড়া-পোড়া। এ দেশের শাকাহারীরা অনেকেই এ সব পদে কবেই দীক্ষিত হয়েছেন। সুইস রান্নার ব্যাপ্তি কিন্তু ঢের বেশি।
দেশটায় তিনটে সরকারি ভাষা জার্মান, ইতালিয়ান, ফরাসি। তিনটে ভাষাকেই কিন্তু ওঁরা নিজেদের কায়দায় বলেন। রান্নাতেও এই তিনটে শৈলীই মিশেছে। ভিনিগার-রেড ওয়াইনে সাত দিন ধরে মজানো মাংস ‘সুরে মকে’ এ যাত্রা চাখা হল না। তার বদলে ‘জুরিখ কা টুকরা’ বরাতে জুটল। না, শাহি টুকরার সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। আসল নামটা দাঁতভাঙা! ‘জিউরিগেজনেতসেলতে’। মানে জুরিখের টুকরো। টুকরো-টাকরা মাংস-মাশরুমে সামান্য ক্রিম পড়ে মাংসের নিজস্ব নির্যাসে পাকানো মরিচ-গন্ধী গা-মাখাটা সাপ্টে খেতে হয়। ভিল বা গোবৎসের মাংস দিয়ে খাওয়াটাই দস্তুর হলেও চিকেনেও চলতে পারে। সুইস দেশের পাস্তাবিশেষ স্পাতজেলের সঙ্গে মাটন স্টু (উরনের এফেলিকাবিস) চাখার অভিজ্ঞতাও বেশ। জুরিখের টুকরোর সঙ্গে ‘আলু টিক্কি’ রোস্তি খাওয়ারও চল আছে। ইতালিয়ানদের মতো সুইসরা গোড়ায় নানা কিসিমের স্যালাড খায়। তার সঙ্গে ভাপানো বাঁধাকপিতে মোড়া দোলমাটাইপ এক বস্তুও পাতে এসেছিল। তার নাম কাপুন্স। পেটের ভেতর গুচ্ছের সব্জি, টমেটোর সালসার হাল্কা মোচড়ের সঙ্গে খেতে ভালই লাগে।
আসলে এ সব নিরামিষ পদই গুরুভার চিজ স্যুপ-বার্লি স্যুপ বা মাংসের পদগুলো সাঁটানোর আগে গৌরচন্দ্রিকা। সুইসদেশের ফিনফিনে আটা সঙ্গে করে এনে রিকার্ডো আর এক ধরনের পাস্তাও পাকান, যার নাম পিৎজোকেরি। ছোট ছোট করে কাটা আলু-কুচোন মাংসের সঙ্গে এই পাস্তা জমবে বেশ। সুইৎজারল্যান্ডে নদীর মাছও যথেষ্ট। বাঙালির মতো সি-ফিশের থেকে মিষ্টি জলের মাছই সুইসদের বেশি পছন্দ। রিকার্ডো এখানে এসে গোড়ায় ইউরোপের পাইক-পার্চ মছলির জন্য দুঃখ করছিলেন। এখন কলকাতা ভেটকির প্রেমে হাবুডুবু। গলানো মাখন ও হোয়াইট ওয়াইনের লেবুসুরভিত সসে ডুবু-ডুবু মাছটাও বেড়ে খেতে।
এ সব রান্না চাখতে বসে গুটিকয়েক বাঙালির হয়তো মুজতবা আলির কথা মনে পড়বে। ইউরোপ সফর কালে নাগাড়ে আলুনি মশলাবিহীন ‘যাবনিক’ রান্না চাখতে চাখতে ক্লান্ত দশায় হাঙ্গেরিয়ান গুলাশের দেখা পেয়ে তিনি শান্তি পেয়েছিলেন। সুইসদের মাংসের ঝোল-কাইয়েও কিছুটা ঘরোয়া স্বাদ হয়তো খুঁজে পায় বাঙালি। তবে দোহাই, সুইস-স্বাদটুকু উন্নততর করতে দেদার লঙ্কা, সয়া সস-টস ঢালবেন না। সুইস বন্ধুরা কেউ দেখলে কষ্ট পাবেন।
চিজ-চকোলেটের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অঢেল বিস্ময় নিয়েই সুইৎজারল্যান্ড দুয়ারে অপেক্ষায়!

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.