প্রবন্ধ ২...
হিন্দুত্ব আর কঠোর প্রশাসনের মোদীপাক
৯৯০ সালের বাসি রুটি কি মাইক্রোওয়েভ আভেনে গরম করে ২০১৪ সালে খাওয়া যাবে? এ বিষয়ে দু’রকম মত আছে। কেউ বলছেন, এত দিনের রুটি গরম করতে গেলে শক্ত হয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, আর খাওয়াই যাবে না। অন্য মতটি হল, মাইক্রোওয়েভের দরকার কী? দেশি ঘি মাখিয়ে তাওয়ায় চাপিয়ে নাড়াচাড়া করে নিলে চমৎকার সুস্বাদু খাদ্য হবে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রা দেশে যে ‘হিন্দুত্ব’ নামক এক বিশেষ রাজনৈতিক আবেগের জন্ম দিয়েছিল, সে আবেগ নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ফের জাগিয়ে তোলা কি সম্ভব? পুরনো জিনিস বাজারে ফিরিয়ে আনতে হলে নতুন করে ভাবতে হবে। এখানেই নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে প্রশ্ন। তাঁর স্বপ্নের সওদাগরিতে অস্বাভাবিকতা দেখি না। কিন্তু তিনি কি আসলে পুরনো বোতলে পুরনো মদই পরিবেশন করে নতুনের দাবি করছেন?
‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির জন্মদাতা বীর সাভারকর। তিনি হিন্দুত্বকে রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে বিশেষ ভাবে যুক্ত করে দেখেছিলেন। বলেছিলেন, এক ভৌগোলিক চৌহদ্দির মধ্যে ‘হিন্দুত্ব’ হল এমন এক অনুভূতি, যা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অখণ্ড জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাবে, যার নাম ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’। সাভারকরের তত্ত্ব থেকেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাষ্ট্রভাবনা এবং দীনদয়াল উপাধ্যায়ের সুসংহত মানবতাবাদের তত্ত্ব গড়ে ওঠে। ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আর এস এস) জন্মলগ্ন থেকে হেডগেওয়ারও চেয়েছিলেন ‘হিন্দুরাষ্ট্র’। সেই লক্ষ্যপূরণেই ছিল আডবাণীর রথযাত্রা। আর এস এস, বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এই তিনটি সংগঠন একে অন্যের পরিপূরক। হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশে বিজেপি রাজনৈতিক দিক থেকে আর এস এস সাংস্কৃতিক ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ধর্মীয় দিক থেকে কাজ করে। আডবাণীর রথযাত্রার সময় এই পারস্পরিক সমন্বয় ছিল সবচেয়ে বেশি। এই হিন্দুত্বের অনুভূতি বিজেপিকে নির্বাচনী রাজনীতিতেও প্রভূত সুবিধা দিয়েছিল। ১৯৮৪ সালে বিজেপির লোকসভায় মাত্র দুটি আসন ছিল। ১৯৯১ সালে তা বেড়ে হয় ১২০।

অভিযান। নির্বাচনী জনসভায় নরেন্দ্র মোদী। গুজরাত, অক্টোবর ২০১২। ছবি: রয়টার্স
২০০৪ সালে রামমন্দির নির্মাণ ও হিন্দুত্ব প্রচার জাতীয় বিষয়কে কার্পেটের তলায় পাঠিয়ে বিজেপি ‘ভারত উদয়’ প্রচারে নেমেছিল। নির্বাচনের ফল তাদের পক্ষে ইতিবাচক হয়নি। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস অ্যান্ড পলিটিকাল সায়েন্স-এ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক স্টুয়ার্ট করব্রিজ, সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল ফর ইনটারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর অধিকর্তা জন হ্যারিস এবং অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ক্রেগ জেফ্রি লিখেছেন, যদি বিজেপি হিন্দুত্বকে মূলধন করে জাতিগত ও ধর্মগত প্রচারের ভিত্তিতে এগোয়, তবে ২০১৪ সালের ভোটে হিন্দুত্বের মেরুকরণে দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সঙ্ঘ নেতারাও মনে করছেন, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাজপেয়ী-আডবাণী জোট-রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় অনেক বেশি আপস করেছেন। আর তাই বিজেপির ভোট কমেছে। বিজেপির নিজস্ব ভোট বাড়তে পারে, যদি দল আবার হিন্দুত্ববাদী প্রচারকেই অগ্রাধিকার দেয়। সঙ্ঘ পরিবারের এই মতামত এই মুহূর্তে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সঙ্ঘ পরিবার এখন বিজেপিকে অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজপেয়ী-আডবাণীর সময় পরিবারের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ মতপার্থক্যের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ছিল বিজেপি-র। এখন তা নেই।
অতএব নরেন্দ্র মোদী। অতএব নরেন্দ্র মোদীর ভাষণে কংগ্রেসের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার বোরখা’ নিয়ে কটূক্তি, কুকুরছানার উপমা, সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় নিয়ে সাবেকি ভোট-কলহ। বাজপেয়ী যখন উদার ভাবমূর্তির মুখ ছিলেন, তখন আডবাণী ছিলেন কট্টরবাদী হিন্দু নেতা। আবার আডবাণী যখন জিন্না-বিতর্কের পর শেষ নির্বাচনে ছিলেন সুশাসনের স্বপ্ন বিক্রির প্রধান ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, তখন মোদী ছিলেন গোধরার কলঙ্কিত নায়ক। অর্থাৎ, বিজেপি-তে, পরিকল্পিত ভাবেই হোক বা স্বাভাবিক ভাবে, এক জন উন্নয়নপন্থীর সঙ্গে এক জন উগ্র হিন্দুত্ববাদী উপস্থিত ছিলেন সব সময়। এ বারে মোদী কি দ্বৈত ভূমিকায়? না কি উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার, বরুণ গাঁধী, কল্যাণ সিংহ থেকে মোহন ভাগবত-অশোক সিঙ্ঘল সমবেত ভাবে আরও উগ্র হিন্দুয়ানার জন্য তৈরি হচ্ছেন? দৃশ্যত, ভোট যত এগিয়ে আসছে, হিন্দুত্বই হয়ে উঠতে চলেছে বিজেপির প্রধান হাতিয়ার। তবে অতীতের রামমন্দির আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত না করে হিন্দুত্বের সঙ্গে শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগঠন, দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের একটা প্যাকেজ তৈরি করতে চাইছে বিজেপি।
অন্য দিকে কংগ্রেস পুরো প্রচারটাকেই মোদী-কেন্দ্রিক করতে মরিয়া। কারণ, কংগ্রেসেরও মনে হচ্ছে, মোদী যদি প্রধান প্রতিপক্ষ হন, তা হলে ভারতীয় মুসলমান সমাজের নিরাপত্তার অভাববোধ বাড়বে আর সে ক্ষেত্রে ভোটার সমাজে আরও তীব্র হয়ে উঠবে রাজনৈতিক মেরুকরণ। তখন প্রাণে বাঁচতে মুসলমান সমাজ আঞ্চলিক দলনেতাদের চেয়েও কংগ্রেস ও রাহুলের নেতৃত্বের দিকে বেশি ঝুঁকবে। নরেন্দ্র মোদী যতই ফেসবুক, টুইট করুন, শতকরা ৬৫ ভাগেরও বেশি ভারতীয়র গড় বয়স ৩৫। কংগ্রেসের ধারণা, এঁরা রাহুল গাঁধী তথা কংগ্রেসের সাবেকি নেহরুবাদী বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিই আস্থা রাখবেন।
এ বারের ভোট যদি নেহরুবাদী বহুত্ববাদ বনাম হিন্দু জাতীয়তাবাদের লড়াই হয়ে দাঁড়ায়, তবে সাধারণ মানুষ, বিশেষত নবীন প্রজন্ম, ‘হিন্দুত্ব প্লাস মোদীত্ব’র প্যাকেজকে কতখানি গ্রহণ করবেন জানি না, কিন্তু আশঙ্কা বাড়ছে অন্যত্র। রথযাত্রার স্বতঃস্ফূর্ত হিন্দু-উন্মাদনা তৈরি না হলে কট্টরবাদীরা আরও বেশি উগ্র সাম্প্রদায়িকতার পথে হাঁটবেন না তো? তা হলে কিন্তু ধর্মীয় হানাহানি-দাঙ্গা বাড়তে থাকবে।
আর এস এস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও জনসঙ্ঘ-বিজেপির জন্মের উৎসে ছিল নেহরুর সমাজতান্ত্রিক এবং বহুত্ববাদের নামে ‘নরম রাষ্ট্র’র সমস্যা। সংখ্যালঘু তোষণ ও কাশ্মীর নীতি (৩৭০ ধারা) নিয়ে বিতর্ক। নেহরু ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চিন্তার সংঘাতের শিকড় সেখানেই। সঙ্ঘ মনে করে, এই স্বকীয় হিন্দুত্বর ভাবনাই বিজেপির শ্রীবৃদ্ধির কারণ। আর তাই এনডিএ-র প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর উদার প্রশাসনের নমুনা দেখে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তৎকালীন সহ সভাপতি আচার্য গিরিরাজ কিশোর একদা বাজপেয়ী সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন: ‘ছদ্ম হিন্দু’। বাজপেয়ী নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদের চেয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ। এ বার তাই তেড়েফুঁড়ে নেমেছে আরএসএস।
আপাতত আডবাণী-সুষমা স্বরাজ ‘নির্বিষ’ জাতীয়তাবোধ প্রচার করতে চাইছেন, কিন্তু দেশের পরিস্থিতি যে দিকে এগিয়ে চলেছে, তাতে আশঙ্কা হয় যে, এ দেশে মূল বিতর্কটা সাম্প্রদায়িকতা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মোদী-কেন্দ্রিকতার তারে বাঁধা হয়ে যাওয়ায় নানা রাজ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি না পায়। তখন কিন্তু নরম হিন্দু জাতীয়তা পালটে গিয়ে উগ্রমূর্তি ধারণ করতে পারে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.