গুরুঙ্গের ঘাঁটিতে বসেই নজরদারি
চাপ বাড়াতে নাড়াচাড়া পুরনো মামলা নিয়েও
বিমল গুরুঙ্গের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দেহরক্ষী তুলে নিয়ে ইঙ্গিতটা দিয়েই রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার মোর্চা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একাধিক পথে ফাঁস আঁটতে চাইছে রাজ্য প্রশাসন। এক দিকে গুরুঙ্গ, রোশন গিরি, বিনয় তামাংদের বিরুদ্ধে বের করা হচ্ছে পুরনো মামলা। যার ফলে প্রথম দু’জনের পাসপোর্ট সাময়িক ভাবে বাজেয়াপ্ত হতে পারে যে কোনও দিন। অন্য দিকে, আগামী দু’দিনে দার্জিলিং পাঠানো হচ্ছে স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ একাধিক প্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষকর্তাকে। রাজ্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত, কার্যত ‘কন্ট্রোল রুম’ খুলে গুরুঙ্গদের ঘরে বসেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে তৈরি হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বললেও পাহাড়ে হিংসাত্মক ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সেই আন্দোলন কঠোর ভাবে দমন করা হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন দার্জিলিঙের পথে টহল দিয়েছে সিআরপি। সামনে পুজোর ভরা পর্যটক মরসুমে ব্যবসা যে বিরাট ধাক্কা খেতে চলেছে, সে কথা জানিয়ে এর মধ্যেই পাহাড়ের বিশিষ্টজন ও একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠন যোগাযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আর্জিও জানিয়েছেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “লাগাতার বন্ধে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের অবস্থা শোচনীয়। রাজ্য সরকার পাহাড়কে স্বাভাবিক রাখতে সব কিছু করবে। কোনও বেআইনি কাজকর্ম বরদাস্ত করা হবে না।”
দার্জিলিঙের চকবাজারে মহিলা সিআরপি-র টহল। রবিবার। ছবি: রবিন রাই
সরকারি সূত্রে খবর, এই চাপ বজায় রাখতে আজ, রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ডিজি জি এম পি রেড্ডি পৌঁছবেন দার্জিলিঙে। কাল, মঙ্গলবার সকালে যাবেন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। যাওয়ার কথা রয়েছে একদা দার্জিলিঙে কর্মরত জাভেদ শামিম-সহ একাধিক আইপিএস অফিসারেরও। মহাকরণ থেকে এক ঝাঁক শীর্ষ আমলা ও পুলিশ কর্তাকে পাঠানোর লক্ষ্য একটাই, দার্জিলিঙের পরিস্থিতি যাতে সেখানে বসেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বন্ধের দ্বিতীয় দিনে দিনভর পাহাড়ের নানা এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে ২৫ জন মোর্চা নেতা-কর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এর সঙ্গেই যোগ হয়েছে অতীতের মামলা ঘেঁটে কয়েক জন মোর্চার শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি।
মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ, সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির পাসপোর্ট বাতিলের প্রক্রিয়া এর মধ্যেই শুরু হয়েছে। ওই দুই নেতা তৎকাল ভিত্তিতে পাসপোর্ট পেয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, অগ্নিসংযোগ, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট সংক্রান্ত মামলার তথ্য সেই সময়ে পাসপোর্ট দফতরে জানানো হয়নি। সম্প্রতি বিষয়টি জানতে পেরে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা দফতর মামলার বিশদ বিবরণ বিদেশ মন্ত্রকে পাঠিয়েছে। ফলে, ওই দুজনের পাসপোর্ট সাময়িক ভাবে বাজেয়াপ্ত হওয়ার পথে। পাশাপাশি, বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বিনয় তামাং তৎকাল পাসপোর্টের আবেদন করলেও আপত্তি তুলেছে পুলিশ।
শুধু তাই নয়, প্রশাসন সূত্রে খবর, জিটিএ গঠনের আগে মোর্চার হিংসাত্মক আন্দোলনের সময়ে যে কয়েকশো মামলা হয়েছিল, সেগুলির অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইছে রাজ্য। সেই সঙ্গে রোশন গিরি, রমেশ আলে, প্রদীপ প্রধান ও কল্যাণ দেওয়ান নানা ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত জিটিএ-র এই চার সদস্যেরও নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হবে কি না, তা খতিয়ে দেখার কথা ভাবছে প্রশাসন।
গুরুঙ্গ, রোশন এবং বিনয় তামাংয়ের পাসপোর্টে আপত্তি কেন রাজ্যের?
প্রশাসন সূত্রের বক্তব্য, গুরুঙ্গের বিরুদ্ধে দার্জিলিং জেলায় ১৬টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। জলপাইগুড়ির দু’টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়। রোশন গিরির বিরুদ্ধে ৭টি, বিনয় তামাংয়ের বিরুদ্ধেও একাধিক ফৌজদারি মামলা রয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের বিধি অনুযায়ী, কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, কারাবাসের নথি থাকলে তা তাদের জানাতে হয়। সাধারণত, গুরুতর অভিযোগ থাকলে পাসপোর্ট মেলে না। তথ্য গোপন করে পাসপোর্ট পেলেও পরে তা জানাজানি হলে সাময়িক ভাবে পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়ে থাকে।
রাজ্য যে কেন্দ্রকে আপত্তি জানিয়েছে, সে কথা জানেন মোর্চা নেতৃত্ব। রোশন গিরি বলেন, “আমরা সব কথাই শুনেছি। রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে নানা মামলা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। সেটা সকলকেই বুঝতে হবে। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যা বলার বলব।” মোর্চা নেতারা দাবি করেছেন, জিটিএ চুক্তির সময়ে তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার করার আশ্বাস দিয়েছিল রাজ্য। এখন তা তুলে এনে ব্যবস্থা নিলে চুক্তিভঙ্গ করা হবে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতার কথায়, “রাজ্য যদি মনে করে পুরানো মামলা টেনে সবাইকে গ্রেফতার করবে, তা করতেই পারে। কিন্তু, জিটিএ চুক্তি ভঙ্গ করা হলে কেন্দ্রের কাছে বিষয়টি জানাতে হবে।”
সরকারি সূত্রের খবর, সুবাস ঘিসিংকে সরিয়ে পাহাড়ে কর্তৃত্ব কায়েম করার সময় প্রায় আড়াই বছর ধরে নানা হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ ওঠে মোর্চার বিরুদ্ধে। সেই সময় মোর্চা নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নামে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির বিভিন্ন থানা মিলিয়ে পাঁচশোর বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। পরে রাজ্য ও কেন্দ্রের সঙ্গে সমঝোতায় হাঁটার সিদ্ধান্ত নেন গুরুঙ্গ। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “মোর্চা তখন দাবি করেছিল, তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। সেই দাবি মেনে মামলাগুলি খতিয়ে দেখতে ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করে রাজ্য। বেশ ক’টি বৈঠকও হয়েছিল।”
তা হলে? মহাকরণ সূত্রের খবর, ওই কমিটির শেষ বৈঠকটি হয়েছিল গত বছর ২১ ডিসেম্বর। সেখানে দুই জেলার ১২৫টি মামলা (দার্জিলিঙের ৭৬টি, জলপাইগুড়ির ৪৯টি) প্রত্যাহারের সুপারিশ করে কমিটি। সেগুলি সবই পথ অবরোধ সংক্রান্ত। তবে, গুরুতর অভিযোগের মামলাগুলি রয়েই গিয়েছে। মোর্চা নেতৃত্বকে প্যাঁচে ফেলতে সেই সব ফাইলই এখন ধুলো ঝেড়ে বার করতে চাইছে রাজ্য।

মামলার বহর
দার্জিলিং জলপাইগুড়ি
• আগুন ধরানো ৭৮
• পথ অবরোধ ৭৬
• সরকারি কর্মীকে নিগ্রহ ৫৪
• অন্যান্য ১৭৪
• আগুন ধরানো ১০
• পথ অবরোধ ৪৯
• সরকারি কর্মীকে নিগ্রহ ২৫
• অন্যান্য ৪১
• বিমল গুরুঙ্গ, রোশন গিরির পাসপোর্ট বাতিলের লক্ষ্যে কেন্দ্রকে তথ্য পেশ রাজ্যের। বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু
• আপত্তি বিনয় তামাংয়ের পাসপোর্ট নিয়েও
• রোশন গিরি-সহ চার জিটিএ সদস্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হবে কি না, ভাবনা প্রশাসনে
• মোর্চা নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা নিয়ে নয়া তৎপরতা
রাজ্য সরকারের এই ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ অবস্থান দেখেই সম্ভবত এ দিন কিছুটা ‘ব্যাকফুটে’ ছিলেন মোর্চার শীর্ষ নেতারা। এ দিন রাস্তায় খুব বেশি মোর্চা নেতা-কর্মীকে দেখা যায়নি। কয়েকটি এলাকায় পিকেটিং করার সময়ে সিআরপি সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পুলিশ তা উঠিয়ে দেয়। কয়েক জনকে গ্রেফতারও করা হয়। মোর্চা নেতারাও দিনভর দফায় দফায় বৈঠক করেন। দুপুরে বিমল গুরুঙ্গ চকবাজারে সভা করে আজ থেকে পাহাড়বাসীকে আরও বেশি করে রাস্তায় নামার অনুরোধ করেছেন।
এ দিন বড় ঘটনা না ঘটলেও কালিঝোরার কাছে একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। আর একটি গাড়ি ভাঙচুরও করা হয়। সকালে কয়েক জন নেতা-সমর্থকের মুক্তির দাবিতে দার্জিলিং সদর থানা ঘেরাও করে মোর্চা। এই ঘটনায় পাঁচ মোর্চা সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়।
মোর্চার অন্দরের খবর, এত দিন গুরুঙ্গের বহু দাবিই মেনেছেন মমতা। তাঁকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদা দিয়েছেন। তাই মোর্চা নেতৃত্ব ভাবতে পারেননি, এক কথায় সেই গুরুঙ্গের ইস্তফাপত্র গ্রহণ করবেন মুখ্যমন্ত্রী। অনেকেই ভেবেছিলেন, রাজ্যের কাছ থেকে একটা আলোচনার ডাক অন্তত মিলবে। তা হয়নি। এখন প্রতিনিয়িত যে ভাবে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, তাতে শেষ পর্যন্ত সমাধান সূত্র কী ভাবে মিলবে, তা নিয়ে এখনও সকলেই অন্ধকারে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.