পাতে নিরীক্ষা
জোগানে কাঁটা
সুনের হালকা ঘ্রাণ বা টক-মিষ্টি আম আচারের স্বাদ মিশেছে ইলিশের অঙ্গে। এমনকী, ভিনদেশি ফেতা চিজকেও বাঙালির জলের রুপোলি শস্য দিব্যি আপন করে নিয়েছে।
ইলিশের জোগান, আয়তন বা স্বাদ-গন্ধ নিয়ে আমাদের হৃদয়ে যতই বেদনা থাকুক, ইলিশ নিয়ে নতুন নিরীক্ষায় কিন্তু ক্ষান্তি নেই। চিরাচরিত সর্ষে-ভাপা বা কাঁচা ঝালের সীমানা ছাড়িয়ে ইলিশকে নতুন করে পেতে এ বঙ্গের হেঁসেল-শিল্পীরা দেশ-বিদেশের মশলাপাতি বা রন্ধনশৈলীর আত্মীকরণ করছেন।
তবে গৃহস্থবাড়ি নয়, শহরের রেস্তোরাঁর হেঁসেলেই এখন ইলিশ-চর্চার হিড়িক পড়েছে। ওহ্ ক্যালকাটার হেঁসেলে জন্ম নিচ্ছে ধনে-রসুনের বোনলেস ইলিশ। কিংবা মার্কোপোলোয় ফেতা চিজ, শুকনো লঙ্কা, টমেটো, রসুনের গ্রেভিতে গ্রিস দেশের ঢঙে ইলিশ পিপারেতস সৃষ্টি হচ্ছে। কয়েক দিন আগেও অবশ্য এই বর্ষায় ইলিশ-উৎসব করার ব্যাপারে শহরের রেস্তোরাঁগুলো তত আশাবাদী ছিল না। মার্কোপোলো-র কাঁটামুক্ত ইলিশের উৎসব গত এক দশক ধরে কলকাতার বর্ষার বাঁধা পার্বণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ বার ইলিশের জোগান নিয়ে অনিশ্চয়তায় সেই উৎসবটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। একদা কলকাতাকে বড়িভাজার ব্যাটারে মোড়া ইলিশ কাটলেটের মতো পদ চাখিয়েও ওহ্ ক্যালকাটা অবধি ইলিশ-ভাগ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। শেষমেশ সবার মুখেই হাসি ফুটেছে। ইলিশ-বিশারদ দু’টি রেস্তোরাঁই মনের মতো এক কেজি-দু’কেজির ইলিশের হদিস পাচ্ছে। ওহ্ ক্যালকাটা-র তরফে শেফ ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য অবশ্য বলছিলেন, সবই যে পদ্মার ইলিশ তা হয়তো নয়, তবে সাপ্লায়াররা ভরসা দিচ্ছেন। ভাল ইলিশও কিছু হাতে আসছে।
উৎসবের মেনুতে মার্কোপোলো ইলিশের কিছু সাবেক রান্না ও নতুন এক্সপেরিমেন্টের স্বাক্ষর রেখেছে। বোনলেস ইলিশ ভাপা, কাজুবাদামের গ্রেভিতে কোর্মা বা ইলিশ বিরিয়ানি তারা ফি-বছরই বানিয়ে থাকে। তার সঙ্গে কাঁচা আম দিয়ে টক-ঝাল মৌরি ইলিশের ঝোল, লেবু-শুলপো পাতার তেজিয়ান স্পাইসি লেমন ডিল সসের ইলিশ ও ইলিশ পিপারেতসও তারা নামাচ্ছে। ইলিশকে কাঁটামুক্ত করে স্বাদ বজায় রাখাটা সোজা কাজ নয়। কিন্তু মার্কোপোলো-র শেফ অমিতাভ চক্রবর্তী, এই শিল্পকলাটি পুরোপুরি মজ্জাগত করেছেন। সাধারণ ভাবে বোনলেস ইলিশের রূপকাররা রেস্তোরাঁয় একটি নিয়ম মেনে চলেন। ইলিশের ল্যাজা-মুড়ো-কাঁটা সেদ্ধ করে একটা ইলিশগন্ধী স্টক বানানো হয়। এর পরে রান্নার সসটিতে সেই স্টক প্রয়োগ করা হয়। তাতে ইলিশের প্রাণ, ঘ্রাণটুকু অটুট থাকে।
ওহ্ ক্যালকাটা-ও বেশ কয়েকটি বোনলেস ইলিশ পদে তাদের মুন্সিয়ানা দেখাচ্ছে। যেমন, কুমড়োপাতা আম আচারে ইলিশ বা তিল লঙ্কার ইলিশ। আমতেল ইলিশের লাউভাতেও বেশ লোভনীয়। চিজ-হার্বস দিয়ে কন্টিনেন্টাল ইলিশও পাবেন। আবার ইলিশ ভক্ষণের সাবেক রীতিও ওহ্ ক্যালকাটা-য় বিসর্জিত নয়। লবঙ্গ, দারচিনি, জিরে, মৌরিগুঁড়ো দিয়ে বরিশালি স্টাইলে ভাজা হালকা মুচমুচে ইলিশ বা সর্ষের তেল-কাঁচা লঙ্কার ইলিশ পোলাওয়ের স্বাদ ওই তল্লাটে নিতেই পারেন। মেনুতে সব নতুন-পুরনো মিলিয়ে ইলিশের গোটা ২০ পদ রাখা হয়েছে।
বাঙালি রান্নার রেস্তোরাঁ সিক্স বালিগঞ্জ প্লেস-এও (সল্টলেক ও বালিগঞ্জ) চলছে ‘ইলিশ উৎসব’। প্রমাণ সাইজের স্বাদু ইলিশ ভোজনরসিকদের পাতে তুলে দিতে পেরে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ দারুণ খুশি। কসবা, বেহালায় সিক্স বালিগঞ্জ প্লেস-এর থালি রেস্তোরাঁতেও থাকছে স্পেশাল ইলিশ থালি।
রেস্তোরাঁ-কর্তারা আপাতত আশায় বুক বাঁধছেন, বর্ষার আমেজ ও ইলিশ-ভাগ্য দু’টো সুপ্রসন্ন থাকলে এই মরসুমে ভোজনরসিক বাঙালিকে ঠেকাবে কে!

ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী ও শৌভিক দে




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.