ব্যাগ গুছিয়ে...
মেঘবাহনে চা-বাগিচায়
খোলা আকাশ, ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া সবুজ গালচের মতো চা বাগান, অনেক নীচে এক ঝলক নদী, দিগন্তে পাহাড়ি ঢেউ।
শহরকে ভুলতে এর থেকে ভাল জায়গা আর কী হতে পারে, রাত্রি?
এর আগে তোমাকে সেলিম হিল টি এস্টেটের গল্প বলেছিলাম। পাহাড়ের ঘেরাটোপে সে বড় প্রাকৃত বাগান। সেলিম হিল তার কাঠের বাংলো আর পুরনো আসবাবে অত্যন্ত ‘কোজি’।
টেমি টি এস্টেট ঠিক তার বিপরীত। এত খোলা হাওয়া, এত অদেখা মেঘবাহিনী! কখনও মেঘ রানা প্রতাপের ঘোড়া চেতকের মতো টগবগিয়ে চলেছে, কখনও ঐরাবতের মতো গজেন্দ্রগমনে। সবুজ চায়ের খেতের ওপর কখনও পড়েছে তার ছায়া, কখনও সে ছুঁয়ে যাচ্ছে ঝাঁকড়া গাছগুলোকে।
তিস্তাবাজারে গাড়িবদল। বাজারের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তায় গাড়ি এগোল হোঁচট খেতে খেতে। কিন্তু সিকিমে ঢুকতেই ম্যাজিক! বদলে গেল পথঘাট, পাহাড়, জনবসতি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার মুখে থামলাম নামচি থেকে ১০-১২ কিলোমিটার আগে এক অখ্যাত জনপদে। সেখানে রাস্তার ধারে ঘুপচি দোকানও ঝকঝকে পরিষ্কার। চাউয়ের স্বাদে মিশে মিষ্টি আতিথেয়তা। টেমিতেও এমনই আতিথ্যের স্বাদ দিল প্রকৃতি নিজেই। রিসর্টের গাড়িবারান্দায় দাঁড়াতেই চোখ জুড়িয়ে দেয় সবুজ চায়ের বাগান। বাগান ধরে সরু পায়ে-চলা পথ গিয়েছে অনেক নীচের কারখানায়। সে পথে ছোট্ট বসতি। পাকা সড়ক থেকে বৃষ্টিভেজা পিছল পাকদণ্ডী পথে যখন পা রাখছি, কাছেই ছবির মতো ছোট্ট বাড়িটি থেকে বেরিয়ে এলেন প্রৌঢ় দম্পতি।
বোঝালেন, রাস্তা সহজ নয়। সাবধানে পা ফেলতে হবে। ছোট বাচ্চা কোলে থাকলে তো আরওই বিপজ্জনক। তার পরে বলে দিলেন যেতে হবে কোন পথে। ওঁদের কলতলার পাশ দিয়েই পা রাখা সেই পথে। তার পরে দেখা হল শিশুকোলে এক স্থানীয়ের সঙ্গে। মেঘের ফাঁকে রোদের মতো হাসছে সেই শিশু। দেখা হল ফুলগাছে সাজানো একটি কুটিরের সঙ্গে। দেখা হল এক কলেজ ছাত্র এবং আর এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে, যিনি অবসরজীবনেও কারখানার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া বন্ধ করতে পারেননি। এখানে পথের ধারে কিছু দূর অন্তর কাফে। সবগুলোরই দোতলা কাচে ঘেরা। ফেরার পথে পাইন-দেবদারু গাছ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখছিলাম জানলায়। এর মধ্যে নেড়ামুন্ড পুতুলটাকে নিয়ে নিঃশব্দে ভাব করে গেল বছর তিনেকের অ্যাঞ্জেলা, কাফে-মালিকের মেয়ে। কাফের সঙ্গেই চা পাতা বিক্রির দোকান। বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে নানা জাতের টেমি-র বিখ্যাত চা।
সিকিমের যত্রতত্র মেলে মদ-বিয়ার। কিন্তু কাফেতে? নৈব নৈব চ। অন্তত কাফে-মালিক মুখে সেটাই বলছেন। কাফেগুলো সিকিম সরকারের সম্পত্তি। লিজ নিয়ে চালাচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। তবে সকলেই যে রাজ্যের আইন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন, তেমন নয়। এক গ্রাহক এসে জোরাজুরি করতে তাই বেরিয়ে এল স্থানীয় বিয়ার। চা-বাগানের গা ঘেঁষা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই বিয়ারের স্বাদ ভোলার নয়, রাত্রি। তার পরে ফেরার পথ। আমাদের সঙ্গে পা মেলালেন এক প্রৌঢ়াও। নাকে নোলক, কানে দুল ঝলমল করছে। সঙ্গে বিশাল বোঝা। তাই নিয়েও তরতর করে পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে লাগলেন আমাদের আগে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিতে লাগলেন পিছন ফিরে। আর আমরা শহুরে জং ধরা শরীর নিয়ে হাপরের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলাম, আপনি এগিয়ে যান!
গেলেন না। যদি পথ হারাই (টেমির এই খোলা বিস্তারে পথ হারানো কিন্তু খুবই কঠিন। বড়জোর ঘুরপথে কিছুটা বেশি হাঁটতে হবে), তাই শেষ পর্যন্ত সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।
জানো রাত্রি, এই রিসর্টের এক দিকে ঘর লাগোয়া ঝুলবারান্দার ঠিক নীচেই চা বাগিচার ঢেউ। তার পিছনে পাহাড় পেরিয়ে নাকি মুখ তোলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। গোটা দিগন্ত জুড়ে। কিন্তু আমি তো প্রিয় পাহাড়কে হারিয়ে ফেলেছি! তাই বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে দেখলাম শুধু আজানুকেশ মেঘ, আকাশছেঁচা জলে সে মাঝেমধ্যে ভিজিয়ে দিচ্ছে বাগানকে। আমাদেরও।
তুমি বরং অক্টোবর-নভেম্বরে এসো। শরতে। বা জানুয়ারিতে, বসন্ত এলে চার দিক তখন ভরে থাকে রডোডেনড্রন, চেরি ও ম্যাগনোলিয়ার ফুলে। তখন টেমি আরও সুন্দরী। গাড়িবারান্দার শেষে যে এক ফালি সবুজ ঘাস, রিসর্টে বললেই ওখানে চেয়ার পেতে দেবে ওরা। তখন তোমার সামনে থাকবে আদরমাখা বাগিচা, সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ। সেই আকাশে মেঘ মুছে যাবে। ঝকঝক করবে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
এসো এক বার। শহরকে ভুলে যাবে।

কী ভাবে যাবেন
শিলিগুড়ি/নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ১১৯ কিলোমিটার দূরে সিকিমের এই চা-বাগান। গাড়ি নিয়ে চলে আসুন নামচি হয়ে।
লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টা। সামান্য বেশি সময় লাগে বাগডোগরা থেকে। উচ্চতা প্রায় ছ’হাজার ফুট। ফলে গরমেও শীতের কাপড় লাগে।
কোথায় থাকবেন
সিকিম সরকারের অনুমোদিত একটিই রিসর্ট এখানে। ওয়েবসাইট থেকে বুক করা যায়।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.