আজ বেঁচে থাকলে স্যর আশুতোষের বয়স হত দেড়শো বছর। অথচ এই একটি সার্ধশতবর্ষ নিয়ে তেমন হইচই নেই, খুঁজে পেতে পাওয়া গেল শুধু আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ক্যালকাটা ম্যাথমেটিকাল সোসাইটিতে সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিতব্য স্মারক আলোচনাচক্রের হদিশ। কেন এই বিস্মরণ, বা নীরক্ত স্মরণ?
এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বিদ্যাসাগর, নেতাজি বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় থাকতেও বাংলার বাঘের শিরোপা আশুতোষের গলাতেই পরিয়েছি আমরা। আমার ছোটবেলার মফসসল শহরে চুল কাটার সেলুনেও আশুবাবুর ছবি থাকত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরাক্রান্ত উপাচার্য থাকার সময় ভোরবেলা ময়দানে পরিভ্রমণরত আশুবাবুর দিকে ‘ওই বাঘ, ওই বাঘ’ বলে চেঁচিয়ে ছুটে যেতেন সহকর্মীরা। এই গল্প দীনেশচন্দ্র সেন মশাইয়ের স্মৃতিমূলক বইতে পড়েছি। কিন্তু বঙ্গশার্দূলের অভিধাটি আশুতোষের বৃষস্কন্ধে চাপল কী করে?
একটি সহজ উত্তর সেনমশাই আমাদের জানিয়েছেন। একই রকম পরাক্রান্ত অপ্রতিরোধ্য গোঁফের মালিক ছিলেন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেঁশো-ও। তাঁর ডাকাবুকো স্বভাবের জন্য দেশের লোকের কাছে পেয়েছিলেন ফরাসি ব্যাঘ্রের অভিধা। সেই ফরাসি পুরুষপ্রবরের সঙ্গে তাঁর গুম্ফশোভিত, প্রতিস্পর্ধী মুখাবয়বের সাদৃশ্য লক্ষ করে অমৃতবাজার পত্রিকা আশুতোষের ঘাড়েও চাপিয়ে দিয়েছিল বাংলার বাঘের শিরোপা। সেই বাক্যবন্ধ এখনও আশুবাবুর পিছন ছাড়েনি।
কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরটি অন্যতর, বৃহত্তর, গভীরতরও বটে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দীর্ঘদিন জাঁকিয়ে জজিয়তি করা ছাড়াও দু’দফায় উপাচার্য হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম রেখেছিলেন স্যর আশুতোষ, চালু ধারণা এ রকমই। এবং এমন এক সময়ে, যখন স্বদেশি আর বয়কট আন্দোলন দিয়ে শুরু করে অসহযোগ আর আইন অমান্যের প্রতিস্পর্ধী রাস্তায় দ্রুত হাঁটছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের ফুলকিও সে রাস্তায় সতত দৃশ্যমান। নিয়ম ভাঙার আর প্রতিষ্ঠান বর্জনের সেই বিপুল জোয়ারে গা না ভাসিয়ে, নিয়মের মধ্যে থেকেই একটি প্রতিষ্ঠানকে লালন করে চলেছেন একটি মানুষ। এ গল্পের মধ্যে বিপ্লবী জৌলুস প্রায় নেই বললেই চলে। তাই বিপ্লব, স্বদেশি, জাতীয়তাবাদ, বয়কট, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা ইত্যাদি শব্দবন্ধের অদম্য শোভাযাত্রার সামনে আশুবাবুকে এক বৃষস্কন্ধ, প্রতিকূল (অথবা, যুগভেদে, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’) প্রাকার বলে চট করে ভেবে নেওয়া দুষ্কর নয়।
আর গোলমালও ঠিক ওইখানেই। বাঘের শৌর্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নিয়মতান্ত্রিকতাকে মেলাব কী করে? এখানে আশুবাবু আমাদের স্বদেশিয়ানা বা জাতীয়তাবাদের ধারণাগুলিকেই আবার ফিরে দেখতে বাধ্য করেন। আজ শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ভারতের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই বিভিন্ন বিষয়ের পঠনপাঠন যে ভাবে হয়, আশুবাবু নিঃসন্দেহে তার পথিকৃৎ। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর প্রায় অর্ধশতক ধরে পঠনপাঠন হত কলেজগুলিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সীমিত ছিল শুধু সিলেবাস তৈরি, পরীক্ষা নেওয়া আর ডিগ্রি দেওয়ার মধ্যেই। পঠিত বইগুলির মধ্যেই সংস্কৃত আর ফার্সি ছাড়া ভারতচর্চার সুযোগ প্রায় ছিল না বললেই চলে। |
সে দিনের দিশারী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হল। |
ভারতীয়দের ইংরেজি শিখিয়ে রুচি, মতাদর্শ আর নীতিবোধে তাদের আমরা ইংরেজ করে তুলব, মেকলে সাহেবের এমত দাবিকে অনেকে যতই শস্তায় সাম্রাজ্যের করণিক বানানোর অছিলা বলে মনে করুন না কেন, অস্বীকার করার উপায় নেই যে, উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালির সিলেবাসে প্রধানত ঠাঁই পেয়েছিল অঙ্ক, তর্কবিদ্যা, রাষ্ট্রনীতি, কাব্য, দর্শন ও পদার্থবিদ্যার মতো বিষয়গুলিই। সারাংশ লেখা বা হিসেবরক্ষার মতো কেরানিবৃত্তির বিকাশ-বান্ধব বিষয়াবলি নয়।
এই রকম এক ‘ইংরেজিমনস্ক’ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশজ ভাষার চর্চা সম্ভব করেছিলেন স্যর আশুতোষ। অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন দ্বিতীয় দফায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময় (১৯২১-২৩) চালু করেছিলেন বাংলা ভাষার স্নাতকোত্তর পাঠক্রম। অল্প দিনের জন্য হলেও বাংলার হেড এগজামিনার হতে রাজি করিয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর উদ্যমেই চালু হয় প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, যার দরুন শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের মনে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের কুশীলবদের পাশাপাশি জায়গা করে নিতে শুরু করেন অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, ধর্মপাল, শীলভদ্র বা অতীশ দীপঙ্কর। এই সব চরিত্রকে নিয়েই গড়ে উঠবে ভারতীয় ইতিহাসের এক জাতীয়তাবাদী পাঠ ও চর্চা। এই নিঃশব্দ বিপ্লবের অন্তর্লীন সংঘটক এক বঙ্গশার্দূল। তাঁর উদ্যমেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর স্তরে উচ্চ মানের গবেষণার রাস্তায় পা দেয়, প্রধানত জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এই নতুন পদক্ষেপ সবার মনঃপূত হয়নি। কিন্তু তাতে এর রাস্তা আটকায়নি, এমনকী সরকারি অনুশাসনের নিগড় থেকেও আশুবাবু এই নতুন ব্যবস্থাকে মুক্ত করে নেন নানান বেসরকারি অনুদান জোগাড় করে, ‘এনডাওমেন্ট’ গড়ে তুলে। যাঁদের আর্থিক বদান্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিজ্ঞানের প্রফেসর পদগুলি তৈরি হয়, তাঁদের মধ্যে ছিলেন তারকনাথ পালিত আর রাসবিহারী ঘোষের মতো দুঁদে আইনজীবী। এ যেন স্বদেশি আন্দোলনের সময়েই, স্বদেশি রাজনীতির নেতাদের চক্ষুশূল এক ঔপনিবেশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকেই স্বদেশি অর্থানুকূল্যে মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণার সূত্রপাত, যা শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের এক দিকচিহ্ন হয়ে উঠবে। তাই, আপাতবিরোধী শোনালেও, স্যর আশুতোষকে প্রকৃত স্বদেশি শিক্ষার এক পুরুষপ্রবর হিসেবে গণ্য করতে হবে অবশ্যই।
কিন্তু তাঁর নেতৃত্বের শৈলী ও প্রকরণ নিয়ে প্রশ্নের সংখ্যাও কম নয়। এ সম্পর্কে সমসাময়িক সমালোচনার খোঁজ নিতে গিয়ে একটি চমকপ্রদ তথ্য আবিষ্কার করেছিলাম। ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জের (১৭৬০-১৮২০) আমলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, যার নিষ্পত্তি প্রায়ই হত লোকচক্ষুর আড়ালে পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুগ্রহ বিতরণের মাধ্যমে। এ নিয়ে ১৯২৯ সালে বিখ্যাত বই লেখেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক লিউইস নেমিয়ার, যে বই হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতিকে পরস্পরবিরোধী স্বার্থান্বেষণের প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখার এক নতুন প্রবণতার দিশারী। কিমাশ্চর্যম্, নেমিয়ারের বিখ্যাত বইটি বেরনোর চার বছর আগেই, ১৯২৫ সালে ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় অভিযোগ করেছিলেন ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যে, স্যর আশুতোষ শুধু আইন এবং গণিতেই পারদর্শী নন, জর্জিয়ান ইংল্যান্ডের কায়দায় পেনশন, ইনক্রিমেন্ট ইত্যাকার অনুগ্রহ বিতরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট সুনিশ্চিত করতেও সিদ্ধহস্ত।
কথাটা নিতান্ত উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সেনেটে প্রতিপত্তি ছিল আশুবাবুর স্নেহভাজনদেরই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অঙ্গ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণও ছিল তাঁর হাতেই। বাংলা আর অসমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পরিব্যাপ্ত ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব। সেখানে সিন্ডিকেট আর উপাচার্যের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠে পৃষ্ঠপোষকতার এক বৃহদায়তন ব্যবস্থা, একটি ছোটখাটো সাম্রাজ্যও যাকে বলা যায়। সব কলেজের গভর্নিং বডিকেই অনুমোদন নিতে হত সিন্ডিকেটের কাছ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির এক বিপুল সংখ্যক শিক্ষক চাকরি পেয়েছিলেন আশুবাবুর কৃপায়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত প্রতিটি পরীক্ষার (ম্যাট্রিক পরীক্ষাও তার মধ্যে পড়ে) জন্য নিযুক্ত হতেন অসংখ্য পরীক্ষক। তাঁদের ভাতা নেহাত মন্দ ছিল না। পসার জমেনি, এমন অনেক তরুণ আইনজীবী আশুবাবুর কৃপাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরীক্ষার পরীক্ষক হওয়ার বরাত পেতেন। স্কুল-কলেজের যাবতীয় পাঠ্যবইয়ের জন্য অবশ্যপ্রাপ্তব্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন, অতএব অনুগ্রহ-বিতরণের অন্যতম প্রকরণ ছিল এটিও। বস্তুত, আশুবাবুকে প্রায় একটি গোটা প্রজন্মের শিক্ষিত হিন্দু বাঙালির প্রধান অন্নদাতা হিসেবে দেখলে নিতান্ত ভুল হবে না।
স্যর আশুতোষের নেতৃত্বের এ আর এক আকর্ষণীয় দিক। গবেষণা-জ্ঞানচর্চার জগতের সবচেয়ে প্রতিভাবান নক্ষত্রদের— উদাহরণ, সি ভি রমণ, মেঘনাদ সাহা, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, দীনেশচন্দ্র সেন বা আর জি ভান্ডারকর— চিহ্নিত করে তাদের আদরে অভ্যর্থনা করতে তিনি যেমন কখনওই মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করেননি, তেমনই তার বিপরীতে অনুগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষণার দানসত্রও খুলে দিয়েছিলেন এমন বহু জনের কাছে, মেধা ও উৎকর্ষের পরীক্ষায় পাশ করা যাঁদের পক্ষে নিতান্ত সহজ ছিল না। এক দিকে উচ্চ মানের গবেষণার স্বার্থে প্রাদেশিকতাকে আপসহীন ভাবে বর্জন করে দেশবিদেশ থেকে সর্বোৎকৃষ্ট মেধাকে আবাহন করা, অন্য দিকে বাংলার ঘরে ঘরে অন্তত এক জন করে গ্র্যাজুয়েট পৌঁছে দেওয়ার জন্য এনট্রান্স, এফ এ, আর বি এ পাশ কোর্সের পরীক্ষা তুলনায় সহজ করে দেওয়া: এই দোলাচলের মধ্যেই আশুবাবুর অবদানকে যাচাই করতে হবে।
মেধার দাবি হয়তো এক প্রবর পৃষ্ঠপোষকের পক্ষে নিরন্তর মেনে চলা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এমন এক সময়, যখন শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের জীবনের অনেকখানি জুড়ে চাকরির জন্য উদ্বেগ আর হাহাকার, যখন জাতীয়তাবাদের গ্রন্থিমূলে কুঠারাঘাত করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার উপর ইংরেজের সর্বময় নিয়ন্ত্রণ, তখন তাদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুগ্রহের প্রতি-ব্যবস্থা চালু করার মধ্যে অদম্য সাহসের পরিচয় আছে বইকী। জীবজগতে বাঘকে ঠিক গণতন্ত্রের অগ্রসৈনিক বলা যায় না, কিন্তু নেতৃত্ব, সাহসিকতা আর ক্যারিশমার মিশ্রণ যদি কারও গায়ে ডোরা-ডোরা দাগ কাটতে পারে, তবে সেই নির্ভুল স্বাক্ষরে আশুবাবুকে অমোঘ ভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
|
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সচিব ও সংগ্রহাধ্যক্ষ |