পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে বিস্ময়ের অবকাশ নাই। কিন্তু সতর্কতা বাঞ্ছনীয়— ইহা পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল, ইহার ভিত্তিতে রাজ্য রাজনীতির ভবিষ্যৎ চলনের পূর্বাভাস করিতে বসা বিপজ্জনক। পঞ্চায়েত ভোট ভিন্ন গোত্রের খেলা, তাহার সহিত লোকসভা-বিধানসভার অঙ্কের মিল না-ই থাকিতে পারে। এই নির্বাচনের ফলাফল হইতে যেটুকু বোঝা সম্ভব, তাহাই আলোচনার পরিসর হিসাবে মান্য। সেই পরিসরে তিনটি কথা স্পষ্ট।
প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেস এবং তাহার নেত্রীর জনপ্রিয়তা এখনও প্রবল। গত দুই বৎসরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচুর ভুল এবং অন্যায় করিয়াছেন, প্রশাসক রূপে বহু ক্ষেত্রেই তিনি চরম ব্যর্থ। কিন্তু স্পষ্টতই সেই ব্যর্থতা তাঁহার জনপ্রিয়তায় আঁচড় কাটিতে পারে নাই। উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গের বিভাজিকা রহিয়াছে, শহরের নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চলের ফলাফল লইয়াও চুলচেরা বিচার চলিতেছে— কিন্তু কোনও অঙ্কেই তাঁহার জনপ্রিয়তা অস্বীকার করিবার নহে। কেন তাঁহার মুখ্যমন্ত্রিত্বের দুই বৎসরের প্রভাব গ্রামের ভোটে পড়িল না, তাহার একাধিক ব্যাখ্যা সম্ভব। নির্বাচনে শাসক দল তথা তাহার দ্বারা প্রভাবিত প্রশাসনের অন্যায় আচরণ বা সেই আচরণের ভয় দৃশ্যত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লইয়াছে। কিন্তু তাহা ব্যতীতও অনেকগুলি সম্ভাবনা আছে, যেমন— মানুষ এখনও বামফ্রন্টের অপশাসনের স্মৃতি বিস্মৃত হন নাই; মানুষ স্থিতিজাড্যে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনে তাঁহাদের মন নাই; রাজ্যের অন্যত্র, বিশেষত শহরাঞ্চলে কী ঘটিতেছে, তাহাতে তাঁহারা বিচলিত নহেন; তাঁহাদের বিচারে সরকার কাজ করিতেছে। আরও একটি কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন— পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল, ঐতিহাসিক ভাবেই, রাজ্যের শাসককুলের দিকে হেলিয়া থাকে। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল স্মর্তব্য। বামফ্রন্টের ভবিষ্যৎ ধসের আনুপাতিক পূর্বাভাস সেই ফলে পাওয়া যায় নাই। ২০১৩-র ফলাফলকে এই প্রেক্ষিতে দেখাই বিধেয়।
দ্বিতীয়ত, রাজ্যে কংগ্রেস কোণঠাসা হইয়াই থাকে, এই নির্বাচন তাহাকে আরও বেশি কোণঠাসা করিয়াছে— উত্তরবঙ্গেও তাহার পদতলে বিস্তর জমি সরিয়াছে। দলের এই হাল কেন, তাহার উত্তর বিধান ভবন না জানিলেও ২৪ আকবর রোড বিলক্ষণ জানে। নয়াদিল্লির নিকট পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস গুরুত্বহীন। ফলে, এই রাজ্যে কংগ্রেসের সংগঠন নাই, উদ্যোগ নাই, জিতিবার ইচ্ছা নাই। বস্তুত, তৃণমূলের দুয়োরানি হওয়া ভিন্ন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের যে কোনও ভবিষ্যৎ থাকিতে পারে, প্রাদেশিক নেতৃত্বের সম্ভবত সেই বিশ্বাসই নাই। অথচ, সংগঠনে গুরুত্ব দিলে, একেবারে ব্লক স্তরে কাজ করিলে এবং সর্বোপরি আত্মবিশ্বাস বজায় রাখিলে কংগ্রেসও যে সদাপট জিতিতে পারে, মুর্শিদাবাদ তাহার প্রমাণ। নেতা হিসাবে অধীর চৌধুরীই আদর্শতম কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন কিন্তু এই রাজ্যে দলের পক্ষে তিনিই একমাত্র সফল, ইহা অনস্বীকার্য।
তৃতীয়ত, সি পি আই এম-এর রক্তক্ষরণ বন্ধ হইল না। যে ভঙ্গিতে দলটি দীর্ঘ কাল এই জাতীয় নির্বাচনী লড়াই জিতিয়াছে, তাহা যে তৃণমূল কংগ্রেস সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করিয়া ফেলিয়াছে, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট তাহা টের পাইয়াছে। কিন্তু বিকল্প রাজনীতিটি কী, তাহার হদিশ সম্ভবত বামপন্থী তত্ত্বের পাহাড় হাতড়াইয়াও পাওয়া যাইতেছে না। যে গৌতম দেবরা ২০১১ সালে ব্যর্থ হইয়াছিলেন, তাঁহারাই ২০১৩ সালে ভেলকি দেখাইবেন, এমন আশা ছিল কি? সি পি আই এম নেতৃত্ব এখন সম্ভবত অপেক্ষায় আছেন— কখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়িবে, এবং সেই ছিদ্রপথেই তাঁহারা ফের রাজ্য রাজনীতির বাসরঘরে প্রবেশ করিবেন। আপাতত যে সে আশা নাই, তাঁহারা টের পাইয়াছেন। কিন্তু একটি দলের যাবতীয় সামর্থ্য শাসনক্ষমতার উপর নির্ভরশীল হইলে বোধ করি এমন পরিণতিই অবশ্যম্ভাবী। |