|
|
|
|
তেলেঙ্গানায় স্বস্তি, অশান্তি বাকি অন্ধ্রে |
শঙ্খদীপ দাস • হায়দরাবাদ |
ভোররাতে কখন যে চুপিসারে বৃষ্টি শুরু হল, জনা টেরও পাননি। সামনে চৌরাস্তার মোড়ে কাল খুব হুল্লোড় হয়েছে। বাজি পুড়েছে। ওঁর দোকান থেকে মিষ্টি আর তেলেভাজাও বিক্রি হয়েছে খুব। জনা নিজেও কাল রাতে টিভিতে রাজ্য ভাগ নিয়ে তরজা দেখেছেন। আর দেখতে গিয়ে ঘুম ভাঙতেও দেরি হয়েছে।
ভিজে চুলোয় কাঠ গুঁজতে গুঁজতে শিস দিচ্ছেন জনা। কোনও তেলুগু গানের সুর বোধ হয়! বড় খুশি যে! নতুন রাজ্য হচ্ছে বলে? জনা ফিরে তাকালেন না। দেশলাই ধরাতে ধরাতে শুধু আওয়াজ করলেন, “হুমম্।” তার পর চুলোয় হাওয়া দিয়ে, চা বানিয়ে কালসিটে পড়ে যাওয়া টেবিলে কাপ রেখে বললেন, “না! আর অন্তত বন্ধ হবে না। নইলে সকাল নেই, বিকেল নেই হর হপ্তায় একটা না একটা ঝক্কি!” তেলেঙ্গানা আন্দোলন খুব কাছ থেকে কাছ থেকে দেখেছেন জনা। সিদ্দিপেটের এই মোড়ে কত যে কুশপুতুল পুড়েছে, ইয়ত্তা নেই। তারপর পুলিশ, লাঠি, দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করা, বারবার একই গল্প!
তা বলে নতুন রাজ্য মানে ওটুকুই! জনা হেসে ফেলেন, “আমাদের কী আছে! যেমন ছিল তেমনই থাকবে। ওরা বলছে, ছেলেপুলেদের হিল্লে হবে। বড়টা কলেজে পড়ছে। ছোটটা সামনের বছর বারো ক্লাস পাশ দেবে।”
বাইরে অনর্গল বৃষ্টি! তার ওপর তেলেঙ্গানার উৎসব দেখার কৌতূহলে জনাও খানিকটা জল ঢেলে দিলেন। বিক্ষোভের ঝঞ্ঝাট আর সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তা থেকে মুক্তিটুকু বাদ দিলে তাঁর কাছে ২৯তম রাজ্য গঠনের আর কোনও তাৎপর্য নেই! অবশ্য শুধু জনাকে দোষ দেওয়া কেন, মেডক জেলার এই সিদ্দিপেট বাজারে চক্কর দিয়ে মোটের ওপর এমন কথাবার্তাই তো শুনতে হল সাতসকালে। |
|
রাজ্য ভাগের প্রতিবাদ। বুধবার বিশাখাপত্তনমে। ছবি: পিটিআই। |
গাড়ি এগোল। বেলাও গড়াল। করিমনগরের বড় ফটক গলে রোজকার শহর। ঝিরঝির বৃষ্টিতেও গমগমে। পরিবেশে স্বস্তি। তেলেঙ্গানা আন্দোলনের এই স্নায়ুকেন্দ্র কিন্তু হতাশ করল না। ইতিউতি জটলায় গর্বিত সব মুখ। সেখানে ঢুঁ মারলে উত্তেজিত স্বরে জানাচ্ছেন, “সেই তো দিলে তেলেঙ্গানা, এত দেরি করলে কেন! খামোখা প্রাণ গেল এতগুলো ছেলের!” তার থেকেও বড় গর্বের বিষয়, ‘ছিনিয়ে নিলাম হায়দরাবাদ’ গোছের উল্লাস! এই আবেগের ব্যাখ্যা দিলেন বিদ্যানগর হাইস্কুলের শিক্ষক ভীম রেড্ডি। বললেন, “তেলেঙ্গানা শাসন করেছেন নিজামরা। অন্ধ্র ছিল ব্রিটিশ শাসনে। হায়দরাবাদ তাই তেলেঙ্গানার হকের দাবি।” বেশ খানিকটা সময় নিয়ে মাস্টারমশাই বোঝাতে চাইলেন, করিমনগর ও তার আশপাশের শিল্পসংস্থাগুলো থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র সমস্ত সুফল এত দিন কী ভাবে তেলেঙ্গানাকে বাদ দিয়েই ভোগ করেছে বাকি অন্ধ্র। কিন্তু এ বার ঘরের টাকা ঘরে থাকবে। তেলেঙ্গানার সংসারে আর টান থাকবে না। সরস মন্তব্যও গুঁজে দিলেন তিনি, ‘‘রাজ্য আর রাজকন্যা (পড়ুন হায়দরাবাদ) দুই-ই এল যে!”
সাতবাহন ডিগ্রি কলেজেও একই উল্লাস! দোরগোড়ায় রঙিন জলের ছোপ এ দিক-ও দিক। বৃষ্টির জলে আবির পড়লে যেমন হয় আর কি! ক্যান্টিন সরগরম। হায়দরাবাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বার থেকে তেলেঙ্গানার জন্য সংরক্ষিত আসন বাড়বে। গ্রেটার হায়দরাবাদের সমস্ত বহুজাতিক সংস্থা, সরকারি চাকরিতে আরও হাটখোলা হবে দরজা।
কিন্তু এ তো গেল তেলেঙ্গানা। রাজ্য ভাগের পরের দিনটা কেমন কাটল সীমান্ত অন্ধ্রের? চোখ ফেরাতেই এত ক্ষণের স্বস্তির ভাবটা কেটে গেল। উপকূল অন্ধ্র ও রায়লসীমার ১৩ জেলায় পুরোদস্তুর বন্ধ হয়েছে আজ। প্রতিবাদের মূল কথা একটাই, “হায়দরাবাদ চলে গেলে অন্ধ্র তো অন্ধ! মুকুট থেকে নিজামের হিরেটাই যে খসে যাবে!” এই পাল্টা আবেগ নিয়েই আজ থেকে আন্দোলন শুরু হয়ে গেল ওই ১৩ জেলায়। অনন্তপুর, গুন্টুর, বিজয়ওয়াড়া, বিশাখাপত্তনম, কাডাপ্পায় সকাল থেকে রাস্তায় নেমে পড়ল বিক্ষুব্ধ জনতা। তাতে কে নেই? সরকারি চাকুরে, স্কুলপড়ুয়া, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী। গাড়ি ভাঙচুর হল। জ্বলল সরকারি বাস। কুশপুতুল পুড়ল সনিয়া গাঁধীর। রাতারাতি মাথা তুলল জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি। পৃথক তেলেঙ্গানা তবু মানা গেল, কিন্তু হায়দরাবাদ ছাড়া যাবে না। |
|
অনন্তপুরের পথে উপড়ে ফেলা হল রাজীব গাঁধীর মূর্তি। বুধবার। ছবি: এপি। |
ক্ষোভে হাওয়া দিতে লহমা-মাত্র দেরি করেনি অন্ধ্র-রাজনীতি। সনিয়ার নিষেধ সত্ত্বেও আজই ইস্তফা দিয়েছেন রাজ্যের ৬ জন মন্ত্রী। ময়দানে নেমে পড়েছে জগন্মোহন রেড্ডির দল ওয়াইএসআর কংগ্রেসও। এমনকী জগনের স্ত্রীও লাগাতার আন্দোলন ও অনশনের হুমকি দিয়েছেন। অন্ধ্রের নতুন রাজধানী গড়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে ইতিমধ্যেই ২ থেকে ৪ লক্ষ কোটি টাকা দাবি করেছেন চন্দ্রবাবু নায়ডু। তা হলে কি এ বার পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া শুরু? একে তো হায়দরাবাদ, তার ওপর জল বণ্টন, বিদ্যুৎ বণ্টন-সহ হরেক কিসিমের সংঘাতের প্রেক্ষাপট তৈরি! অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানী কী হবে? সে-ও তো এক আলাদা বিতর্ক। সমৃদ্ধ বন্দর শহর বিশাখাপত্তনম, নাকি প্রকাশম জেলার ওঙ্গোল!
এত সহজে অন্ধ্র ছেড়ে দেবে? মনে তো হয় না!
|
পুরনো খবর: গোলাপের পাপড়ি ছুড়লেন চন্দ্রশেখর |
|
|
|
|
|