|
|
|
|
বলছে বাণিজ্য মন্ত্রক |
লগ্নি টানার লড়াইয়ে রাজ্য বহু পিছনে
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
গত বছর টেক্কা দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য। এ বছরের প্রথম ছয় মাসের হিসেবে প্রথম স্থানে পৃথ্বীরাজ চহ্বাণের মহারাষ্ট্র। জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে যত বিনিয়োগ হয়েছে, তার প্রায় ২০ গুণ বিনিয়োগ হয়েছে মহারাষ্ট্রে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের হিসেব বলছে, নতুন লগ্নি টানার নিরিখে এখনও প্রথম পাঁচটি রাজ্যের ধারেকাছেও নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গ।
মন্ত্রক ও বণিকসভাগুলির কর্তারা মনে করছেন, শিল্পপতিরা মহারাষ্ট্র, গুজরাত ছেড়ে কেন পশ্চিমবঙ্গে যাবেন, কেনই বা হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু বাদ দিয়ে কলকাতার বিমান ধরবেন, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কারণ, নতুন লগ্নি
টানার জন্য কোনও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ। যে সব মাপকাঠি বিচার করে শিল্পপতিরা কোনও রাজ্যে লগ্নি করতে উৎসাহিত হন, সেগুলির কোনওটিতেই পশ্চিমবঙ্গ নজর কাড়ার মতো কিছু করে উঠতে পারেনি।
বাণিজ্য মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ১,৩৩১ কোটি টাকার নতুন লগ্নি এসেছে। তুলনায় মহারাষ্ট্রে লগ্নি হয়েছে ২০,৭৫৬ কোটি টাকা। মহারাষ্ট্রের পরেই অন্ধ্রপ্রদেশ। সেখানে লগ্নি হয়েছে ৪,৪৩৪ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থানে রয়েছে গুজরাত। নরেন্দ্র মোদী ৩,৯২৬ কোটি টাকার লগ্নি টেনেছেন। প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে বাকি দু’টি হল কর্নাটক এবং উত্তরপ্রদেশ।
বাণিজ্য মন্ত্রকের এই হিসেব অবশ্য খারিজ করছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, আরও অনেক বেশি লগ্নি
এসেছে রাজ্যে। কিন্তু সর্বশেষ তথ্য কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হয়নি। তাঁর কথায়, “আমরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ৩০৩টি প্রকল্পে মোট ১ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এসেছে। অনেক রাজ্যই আমাদের থেকে পিছিয়ে।
আর মুম্বইয়ের শিল্প সম্মেলনের পর যদি আরও ৪০০-৫০০ কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাব চলে আসে, তা হলে আমরা আরও এগিয়ে যাব।”
শিল্প দফতরের এক কর্তাও দাবি করেন, “গত বছরের তুলনায় নতুন বিনিয়োগের ছবিটা অনেক ভাল। ২০১২ সালে ২৫টি প্রকল্পে মোট ৯৬২ কোটি টাকার বিনিয়োগ এসেছিল। এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই ১৮টি প্রকল্পে ১,৩৩১ কোটি টাকার লগ্নি এসেছে। অর্থাৎ তুলনামূলক ভাবে বড় মাপের শিল্প আসছে। এ ছাড়া বহু নতুন লগ্নি প্রস্তাবও জমা হয়ে রয়েছে।”
কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, “রাজ্য সরকারগুলি হয়তো বলতে পারে, তাদের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু প্রস্তাবের কতখানি বাস্তবে রূপায়ণ হয়েছে, এই পরিসংখ্যান তারই প্রতিফলন।” সেই নিরিখে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
কেন? শিল্পমহল মনে করছে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মেঘ কাটাতে লগ্নিকারীদের মনে রাজ্যের লগ্নি-বান্ধব ভাবমূর্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল। তা হয়নি। উল্টে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না-করার অনড় মনোভাব, ইনফোসিসকে এসইজেড তকমা না-দেওয়ার জেদাজেদি এবং খুচরো ব্যবসা থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতা মমতার সরকার সম্পর্কে শিল্পপতিদের কাছে নেতিবাচক বার্তাই পাঠিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রক বলছে, প্রশাসনিক জটিলতা, লাল ফিতের ফাঁস আর শিল্পবান্ধব নীতির অভাবই অন্য রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক গড়ে দিচ্ছে।
পাশাপাশি পড়ে পাওয়া সুযোগও হাতছাড়া করেছে এ রাজ্য। বাণিজ্য মন্ত্রকের কর্তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তৃণমূল ইউপিএ-তে থাকাকালীন ‘গ্লোবাল পার্টনারশিপ সামিট’ কলকাতায় করার কথা হয়েছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতা করে মনমোহন-সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরেই রাতারাতি সেই আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলন কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আগরায়।
আর সেই সুযোগকে ষোলো আনা কাজে লাগিয়ে নতুন লগ্নি টানার দৌড়ে প্রথম পাঁচে উঠে এসেছে অখিলেশ যাদবের রাজ্য। ২০১২ সালে উত্তরপ্রদেশে লগ্নি হয়েছিল ১,৪৫০ কোটি টাকা। এ বছর ছয় মাসেই তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ২,৭১৫ কোটি টাকা।
লগ্নি টানতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন রাজ্য কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে বিষয়ে একটি পর্যালোচনাও করেছে বাণিজ্য মন্ত্রক। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট, বণিকসভা সিআইআই-এর সমীক্ষা এবং রাজ্যগুলির নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতেই এই পর্যালোচনা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ, এক জানলা ব্যবস্থা, স্ট্যাম্প ডিউটি জমা দেওয়া, নির্মাণের দ্রুত অনুমতি, জল-নিকাশি ব্যবস্থার মতো দশটি মাপকাঠির হিসেবে দেখা যাচ্ছে, কোনও ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গ প্রথম সারিতে আসতে পারেনি। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে ক্ষেত্রে প্রথমে রয়েছে হরিয়ানা। এক জানলা ব্যবস্থায় এগিয়ে পড়শি ওড়িশা। সম্পত্তির রেজিস্ট্রেশন, ভ্যাট জমা দেওয়ার সুবিধাজনক ব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে এক নম্বর অন্ধ্র।
কিছু দিন আগে বণিকসভা ফিকি-ও গুজরাত, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, কর্নাটক, রাজস্থান, তামিলনাড়ুর এবং পশ্চিমবঙ্গ এই সাত রাজ্যে প্রায় একই ধরনের একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষাও দেখিয়ে দিয়েছিল, সব মাপকাঠিতেই অন্য রাজ্যগুলির থেকে পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। একমাত্র কর ব্যবস্থায় ই-গভর্ন্যান্স চালু করা, নতুন শিল্পে বিনিয়োগের জন্য আবেদনপত্রের সরলীকরণ এবং পর্যাপ্ত বিদ্যুতের জোগানের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ কিছুটা সাধুবাদ কুড়িয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রকের কর্তারা অবশ্য বলছেন, শিল্পে প্রয়োজন পড়ছে না বলেই পশ্চিমবঙ্গে যত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, তা কাজে লাগছে না। |
|
|
|
|
|