পুরুষ নেই-ই, গ্রাম ছাড়ছেন মহিলারাও
খনও ভোট দিতে যাওয়ার সময় পাননি সারিয়া বিবি। শুক্রবার সকালে এক বছরের মেয়েকে নাইয়ে-খাইয়ে তৈরি করার আগেই গ্রামে হানা দিল দুষ্কৃতীরা। অবাধে শুরু হল ভাঙচুর, বোমাবাজি। বাড়ির জিনিসপত্র টেনে টেনে বার করে ফেলে দিতে লাগল পুকুরে। ট্রাক্টরগুলো বার করে পেট্রোল ঢেলে দাউদাউ করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। সারা দিন ধরে চলল তাণ্ডব। রাত নামার আগেই ঘরছাড়া গ্রামের পুরুষরা। অথচ দিনে-রাতে কোনও পুলিশ দেখা গেল না গ্রামে।
“এক বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে এক বার স্বামীকে ফোন করছি, সে কোথায় জানতে। এক বার ফোন করছি বাবাকে। বলছি, আমাদের বাঁচাও,” বললেন সারিয়া বিবি।
মেয়ের ফোন পেয়ে তমজিৎ আলি ছুটে এসেছেন নদিয়ার হরিণঘাটা থেকে। যে গ্রামে পুলিশ তখনও ঢুকতে পারেনি, শনিবার সকালে আমডাঙার সেই টেঙাটেঙি গ্রামে এসে মেয়ে-নাতনিকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন রাস্তার পাশে। শুক্রবার রাতে আতঙ্কে গ্রাম ছেড়েছেন পুরুষেরা, আর শনিবার সকাল থেকে দফায় দফায় গ্রাম ছাড়ছেন মহিলারা। সিপিএম, তৃণমূল দু’জনেই পরস্পরকে দুষছে। এবং দু’দলের কর্মী-সমর্থকদের পরিবারই আক্রান্ত।
গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে এখনও স্পষ্ট বোমার চিহ্ন। ভাঙা কাচ ও পোড়া ছাইয়ের কাদা ছড়িয়ে রয়েছে এ দিক-ও দিক। রাস্তার পাশে শিশুদের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মহিলারা। “বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের। মেয়ের পড়ার বইগুলোও পুড়িয়ে দিয়েছে,” বললেন আম্বিয়া বিবি। তিনি ওই গ্রামের তৃণমূল প্রার্থীর বউদি। আর, সারা মুখে আতঙ্ক মেখে মঞ্জুরা বিবি অভিযোগ করলেন, তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল।
তৃণমূল-সিপিএম সংঘর্ষে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঘরবাড়ি। শনিবার আমডাঙায়। ছবি: সুদীপ ঘোষ
তৃতীয় দফার ভোটের আগের দিন, বৃহস্পতিবারই সিপিএম ও তৃণমূল সংঘর্ষে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল আমডাঙায়। তার পরেও গ্রামে পুলিশি নজরদারি ছিল না বললেই চলে। তার প্রমাণ মেলে ভোটের দিন। শুক্রবার দু’দলের সংঘর্ষ ব্যাপক আকার নেয়। সারা দিন অশান্ত ছিল গ্রাম। মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা-গুলির সঙ্গে চলেছে তিরও। সিপিএম ও তৃণমূলের সংঘর্ষে মৃত্যু হয় মাদারবক্স মল্লিকের (৬০)। আহত হন বেশ কয়েক জন। ঘটনার পর এলাকায় এক বার টহল দিলেও টেঙাটেঙি গ্রামে শুক্রবার রাত পর্যন্ত ঢুকতে পারেনি পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনী। অবশেষে ভোটের পরের দিন ঢুকল বাহিনী। সেই সঙ্গে ঢুকল সংবাদমাধ্যমও।
এ দিনও বোমা পড়ার শব্দ পাওয়া গিয়েছে। গ্রামবাসীদের অনেকের শরীরেই স্পষ্ট আঘাতের দাগ। জেলা পুলিশ সুপার সুগত সেন বলেন, “পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সংঘর্ষের ঘটনায় ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ।” এ দিন আমডাঙা থানাতেও মজুত ছিল পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী।
সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, গুলি চলেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পুলিশের সামনেই। মাদারবক্স মল্লিকের স্ত্রী সোফিয়া বিবি বলেন, “বোমার আঘাতেই আমার স্বামী ঢলে পড়লেন। উনি আহত হওয়ার পরেও বোমা ও গুলি চলছিল বলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছিল।” আর এক গ্রামবাসী আজমিরা বিবির অভিযোগ, “আমাকে, আমার স্বামীকে মারধর করা হয়েছে।” সোফিয়া ও আজমিরার অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে।
কথা হচ্ছিল গ্রামের বৃদ্ধ চাষি লতাপৎ মল্লিকের সঙ্গে। তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক তখনও স্পষ্ট। বললেন, “আমার বাড়ি ভেঙে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়িতে থাকা দু’টি ট্রাক্টর। এখন আর চাষবাস করতেও পারব না।” বোদাই পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএমের প্রার্থী, টেঙাটেঙি গ্রামের মঞ্জুরা বিবিরও অভিযোগ, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর বাড়িতে। ভোট দিতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। তাঁরও অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
নিহত মাদারবক্স মল্লিকের পরিবারের অভিযোগ, হামলা হয়েছে স্থানীয় বোদাই গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রার্থী ফজের আলির নেতৃত্বে। অবশ্য ভাঙচুর হয়েছে ফজের আলির নিজের বাড়িতেও। এ দিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর দোকান-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফজের আলির স্ত্রী তানজিরা বিবির অভিযোগ, “গ্রামের বুথে প্রথমে মাত্র দু’জন পুলিশ ছিল। কোনও কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল না।” বউদি আম্বিয়া বিবি বলেন, “আমরা রাতে ঘুমোতে পারিনি। যে কোনও সময় সিপিএম হামলা করতে পারে আমাদের উপর।” গ্রামেরই এক পাশে থাকেন মনজিলা খাতুন। তাঁরও অভিযোগ, শুক্রবার তাঁদের উপর হামলা করেছে সিপিএম।
“এ রকম ভোট হওয়ার মানে কী? ভোট এলেই আতঙ্কে থাকি।” তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বললেন মাঝবয়সী জহেরা বিবি। জামাকাপড়ের পুঁটলি নিয়ে, পরিবারের মেয়ে-শিশুদের নিয়ে তিনি তখন গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পথে।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.