আদিবাসী কন্যাদের টক্করে জমাট আন্দোলনের ধাত্রীভূমি
মেয়েদের উপরে অত্যাচার বন্ধ করার দুই ‘দাওয়াই’ রয়েছে মগজে। এক, “স্বাস্থ্য দফতরের প্রকল্প আছে বয়ঃসন্ধির মেয়েদের এবং ছেলেদের বোঝানো শরীরের বদলগুলোর কথা। সেটা এলাকায় বেশি করে চালু করতে চাই।” দুই, “এলাকার যে সব মহিলাদের স্বামী দূরে থাকেন, তাঁদের অবাঞ্ছিত যৌন সংসর্গে জড়িয়ে না পড়তে বা এক নারী-এক পুরুষ নীতিতে ভরসা রাখতে বলব।”
বলছেন গ্রাম পঞ্চায়েতের এক মহিলা প্রার্থী। আদিবাসী এই মহিলা এমন একটা এলাকার বাসিন্দা, যার বর্ণনা করতে গেলেই খাদান-ক্রাশার, পাথর-ধুলো এবং ট্রাক এসে পড়বে। উঠবে নারী নির্যাতনের কথা।
বীরভূমের মহম্মদবাজারে ট্রাক-পাথরের এই দুনিয়া ঘুরে মনে হয়েছে, এলাকার শ্রমিক মেয়েরা (মূলত আদিবাসী) খুব ভাল নেই। অনেকেই স্বামী-বিচ্ছিন্না। ঘরে খাওয়ার মুখ অনেকগুলো। হাতে-পায়ে ধুলো মাখা মেয়েরা ক্রাশারে প্রতি টন পাথর ভাঙানোর জন্য পান ২৪ টাকা। সাত-আট জনের এমন একটা দল দৈনিক গড়ে ৬০ টন পাথর ভাঙাতে পারে। একাধিক মহিলা শ্রমিকের দাবি, কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের রক্তচক্ষু দেখতে তাঁরা অভ্যস্ত। কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় খাদান এলাকা পেরিয়ে গ্রামে ফিরতে তাঁদের গা ছমছম করে। ভয় হয়।
এমনিতে সাগরবাঁধি গ্রামের কথা শোনাতে গেলে ট্রাক, পাথর আর ধুলোর কথা বলাই যথেষ্ট হতে পারত। হচ্ছে না কারণ তিন বছর আগে শুরু হওয়া আদিবাসী আন্দোলনের অন্যতম ধাত্রীভূমি এই গ্রাম। ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েতের এই আসনে এ বার টক্কর তিন আদিবাসী মহিলারই।
আশা-কর্মী মানি হেমব্রম তাঁদেরই এক জন। ‘বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা’র মাঝবয়সী প্রার্থী।

মালতি হাঁসদা

মানি হেমব্রম

সনকা মুর্মু
২০১০-এ পাথর খাদান ও ক্রাশারের মালিকদের সঙ্গে আদিবাসীদের লড়াইয়ে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে মহম্মদবাজারের পাঁচামি পাথর শিল্পাঞ্চল। সেই এলাকারই গ্রাম সাগরবাঁধিতে আক্ষরিক অর্থেই জ্বলেছিল আগুন। গ্রামেই খুন হন এক আদিবাসী। আদিবাসী-আন্দোলনের রাশ হাতে তুলে নিয়েছিল গাঁওতা। খাদান-ক্রাশার মালিকদের সঙ্গে তাদের বিরোধে দীর্ঘকাল বন্ধ ছিল পাঁচামি শিল্পাঞ্চল। এখন তা চালু হলেও দ্বন্দ্ব যে পুরোপুরি মেটেনি, তা স্পষ্ট দু’পক্ষের নেতাদের কথায়। গাঁওতা নেতাদের দাবি, প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে স্বচ্ছতা, শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে।
সাগরবাঁধির গাঁওতা-প্রার্থী অবশ্য নজর টানেন চিন্তা-বক্তব্যের ঋজুতায়। যাঁর ভোটে দাঁড়ানোর কারণ, “আদিবাসীরা, বিশেষ করে মেয়েরা পিছিয়ে আছে। একটা জায়গা চাই, সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কোনও রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হলে, তাদের নীতি মানতে হবে। আদিবাসীদের কথা বলার সুযোগ মিলবে না।”
পাখি-পড়ানো বুলি যেন?
একই কথা তো শোনা গিয়েছিল গাঁওতার শিক্ষক-নেতা স্নাতকোত্তর সুনীল সোরেনের মুখেও। ভুল ভাঙালেন ক্লাস এইট পাশ মহিলা। রাস্তা-জলের মতো পঞ্চায়েতি সমস্যার টুকরো-টাকরার ফাঁকেই তুলে আনলেন খাদান এলাকায় মেয়েদের ‘দশা’র কথা। তার পরেই এল তাঁর নিজের দর্শন। কামদুনি, খোরজুনার মতো ঘটনা আর ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য-ধ্বস্ত রাজ্যে নারী নির্যাতন ঠেকানোর দুই ‘দাওয়াই’।
এমন এক সপ্রতিভের মোকাবিলায় প্রথম দেখায় শান্ত ঠেকে তৃণমূল প্রার্থী মালতী হাঁসদাকে। আদিবাসী হয়ে আদিবাসী সংগঠনের প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়ছেন, অস্বস্তি হচ্ছে না? জবাব বোঝায় সাগরবাঁধিতে প্রার্থী বাছাইয়ের ‘হোমওয়ার্ক’-এ শাসক দল ফাঁকি দেয়নি। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সহায়িকা মালতী বলেন, “গাঁওতা মানে ক্লাব। ক্লাব তো সবার। আমি ভেবেছি, রাজ্যে যাঁরা শাসক, তাঁদের সাহায্য পেলে এলাকার চেহারা বদলাতে সুবিধে হবে। তৃণমূল রাজ্যে আছে, গাঁওতার দৌড় জেলায়। ক্লাব থাকুক না, ক্লাবের মতো।”
কিন্তু দলীয় নীতি মানতে গিয়ে যদি আদিবাসীদের হয়ে কাজ করতে সমস্যা হয়? “সে তো গাঁওতাও প্রার্থী বেছেছে আদিবাসী সমাজের মাঝি হাড়ামদের (মোড়ল) নিয়ে বৈঠক করে। তা বলে কি ধরে নিতে হবে জিতলে শুধু আদিবাসীদের জন্যই কাজ করবেন ওদের প্রার্থীরা? অন্য কারও জন্য কিছু করবেন না?”
রাজনৈতিক ফারাকটুকু বাদে মালতী এবং মানিদু’জনেই সওয়াল করেছেন এলাকায় শিক্ষার প্রসারে। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। মালতী চান, তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়ে দিদিমণি হোক। মানির ইচ্ছে, কলেজ-পড়ুয়া ছেলে হোক শিক্ষক। দুই মায়েরই কথায়, “লোকের কাজে লাগবে।”
এমন দুই প্রার্থীর সঙ্গে লড়াইতে ফরওয়ার্ড ব্লকের সনকা মুর্মুও আছেন। ২০০৮-এ সাগরবাঁধি ফব-রই জেতা আসন। সনকার বাড়ির দেওয়ালে ফব-র প্রতীক সিংহ ঢাকা পড়েছে কালির পোঁচে। কে মাখাল? প্রৌঢ়ার জবাব, “মেয়েমানুষ। রাতে বাড়ির বাইরে বেরোই না। কে করেছে কী ভাবে বলব?”

ছবি: অনির্বাণ সেন



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.