পদ্মা জাগছে, ফ্লাড শেল্টারই লক্ষ্য ভোটের নির্মলচরের
দ্মা পাড়ে ঘর বেঁধেছে বাবুই।
বুনো কুল আর তেঁতুল গাছগুলো তাদের নিপুণ ঠাসবুনোট বাসায় একেবারে অন্য চেহারা নিয়েছে।
বাবুই পাখির বাসা দ্যাখতেছেন বাবু? বৎসর বৎসর অমন যত্ন করি ঘর তো চরের মাইন্ষেও বানায়। কিন্তু পদ্মা যে গিলে খায়। ভুটের (ভোট) পরেই সেই দিন আসত্যাছে!
বিএসএফ ক্যাম্পে ভোটার কার্ড জমা রেখে রোশন আলি তাঁর খেটো লুঙ্গিটা দু-ভাঁজ করে পদ্মায় মাছ ধরতে ভেসে পড়েন। নদীতে এখন খোকা ইলিশ আর গলদা চিংড়ির উচ্ছল হুটোপুটি। রোশন জানেন, প্রলম্বিত ভোট পর্ব মেটার আগেই ফের ঘর বাঁধতে হবে। তার আগে চিংড়ি-ইলিশে চাট্টি বাড়তি আয় তুলে রাখতে দিনভর পদ্মার রুপোলি জলে ডিঙি নিয়ে ভেসে আছেন রোশন। রাতেও কি ঘুম আছে?
মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা ব্লকে বিস্তীর্ণ পদ্মার বুকে ‘চরজাগানিয়া’ গান গেয়ে এখন রাত জাগছে নির্মলচর। চরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা মহিষমারি, আলেখপাড়া, শয়তানপাড়ার মানুষ লণ্ঠন হাতে নদীর কিনারে ঘুরে বেড়ান। বর্ষায় ভরা নদী ‘ডাক’ দিচ্ছে বুঝলেই হাঁক পাড়েন, ‘নদী জাগছে গো-ও-ও!’ নদীর হাওয়া ডাকহরকরা হয়ে সেই বার্তা ছড়িয়ে দেয় গ্রাম থেকে পড়শি গ্রামে।
বিএসএফের অনুশাসন। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
প্রচারে বেরিয়ে চরমনসুরপুরের সিপিএম প্রার্থী সখিয়া বিবিও তাই বলছেন, “ভোটটা দিবা, আর সেই সঙ্গে মনে রেখো, হেইডা আমাগো সতর্ক থাকনের সময়। নদী জাগত্যাছে!”
নির্মলচরের এগারোটা গ্রামের সাড়ে ছ’হাজার ভোটারের জন্য সাতটা বুথ। পাঁচটা গ্রাম সংসদে প্রার্থী, ১৬ জন। নদীর ওপারে, আখরিগঞ্জের বিভিন্ন দলীয় কার্যালয় থেকে পতাকা আর ফ্লেক্স এসেছে দিন কয়েক হল। তা নিয়ে আটপৌরে মিছিল চরের কাদা মাটি ভেঙে ঘুরছে। আর প্রার্থীরা চেনা পড়শির সঙ্গে দেখা হলে ভোট-ভিক্ষার আগে শুনিয়ে রাখছেন ‘পদ্মা হইতে সাবধান’ বাণী। গ্রাম সংসদে কংগ্রেসের প্রার্থী সাগির ইসলাম বলেন, “এটাই তো সজাগ থাকনের সময় কর্তা, নদী যে ডাকত্যাছে! সে ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক না করলি আর চরের বাসিন্দা হলাম কেম্নে!” নদী ডাকলেও নির্মলচরের ভরসা ফ্লাড শেল্টারটা মাস কয়েক আগে বেহাত হয়ে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে তার ঠিকানা, ‘মহিষমারি বিওপি’। পদ্মার কোলে সেই তিনতলা বাড়িটা দখল নিয়েছে বিএসএফের ০৪ ব্যাটেলিয়ান। সাঁঝ নামতেই দপ করে সেখানে জ্বলে ওঠে আলো। জেনারেটরের ঘর ঘর শব্দ হারিয়ে যায় পদ্মার গর্জনে। শেষ বিকেলে বিদ্যুতের আলো দেখতে ক্যাম্পের কিনারে ভিড় করে চরের কিশোর-কুল। বিস্ময়ে হাঁ-মুখ, ওরা পরস্পরকে শুধোয়, ‘‘আমাগো গাঁয়ে অমন ডুমো আলো কবে জ্বলবা রে!’’ ক্যাম্পের বেড়ার ধারে তাদের সোল্লাশ শুনে চেঁচিয়ে ওঠেন টহলদারি জওয়ান, ‘‘উধার কৌন?’’
আমাগো বানভাসি ঘরটা ছিনায়ে এখন ‘উধার কৌন’!
পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বেলে মাটি ঝরিয়ে বছর বারোর জালাল শেখ রাগে গর গর করে। জালালের মতোই বিএসএফ নিয়ে বীতশ্রদ্ধ চরের বাসিন্দারা। রমজান মাসের দাওয়া দাওয়ায় গুন গুন করছে চাপা ক্ষোভ, বিএসএফের ‘অত্যাচার’ যে দল রুখতে পারবে, ভোট তারই।
ঢের বয়স হয়েছে মনসুর আলির। বলছেন, “পদ্মার রাঙা চোখ অনেক দ্যাখছি। আবার সোনা জমিতে সে ফলনও দিয়েছে ঢের। কিন্তু বিএসএফের কাছে তো শুধুই বেয়ন্যাটের খোঁচা!” মনসুর জানান, এ বার ভোট পাবে সেই, যে বিএসএফ-কে ওই ফ্লাড শেল্টার থেকে হটাতে পারবে। নমাজ সেরে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসগর আলি বলেন, “দ্যাখেন এ চরে কংগ্রেস-সিপিএম বিরোধ তেমন নেই। সব দলের প্রার্থীরা একই মসজিদে পাশাপাশি নমাজ পড়েন। কিন্তু আমরা সবাই জোট বেঁধেও ওই বিএসএফের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারি না।” টিএমসি প্রার্থী অমিনুল আলির কথাতেও সেই বিএসএফ-বিদ্বেষ, “আবাদের জন্য ভগবানগোলা হাট থেকে এক জোড়া মোষ কিনলে তা গ্রামে আনতে তিন তিনটে থানার কাছে ‘দাসখত’ লিখে দিতে হয়, চোরা চালান নয়, এ মোষ আবাদের জন্য। পুলিশের ছাড়পত্র নিয়ে নাও ভাসিয়ে গবাদি পশু চরে আনার পরে শুরু হয় বিএসএফের ‘অত্যাচার’। কোথাকার মোষ, চরে কেন এলজেরায় সন্তুষ্ট না হলে মোষই কেড়ে নেবে।”
চর প্রান্তে পদ্মা। তারপর ফের অনন্ত নদী। সেখানেই নতুন চরে তিসি কলাইয়ের ফলন লক লক করছে। গ্রামবাসীরা সেখানেও পা রাখতে পারেন না। বিএসএফের ফতোয়া নদী উজিয়ে ওই চরে কক্ষনো নয়। কেন? প্রশ্ন করে স্থানীয় শয়তানপাড়ার গোলাম মুর্শেদকে উর্দিধারীর থাপ্পর খেয়ে ফিরতে হয়েছে। বিএসএফের ০৪ ব্যাটালিয়ানের কমান্ড্যান্ট পিবি পাঠক পাল্টা প্রশ্ন রাখছেন, “দেশের নিরাপত্তা আগে না চরের মানুষের নিত্য নতুন চাহিদা, কোনটাকে প্রাধান্য দেব বলুন তো?”
ভাঙনের ভ্রূকুটির মাঝে ভোটের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে নির্মলচর এখন সে প্রশ্নই হাতড়াচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে এই বিএসএফ-কে ‘রুখবে’ কে!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.