প্রবন্ধ...
নাম নেই, দাম নেই

There is something liberating about writing a paper without trying to please referees and without having to take into consideration the various protocols and conventions imposed on researchers...It gives one a feeling of real academic freedom!

আরিয়েল রুবিনস্টাইন, অর্থনীতিবিদ, তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়বছরখানেক আগে বিলেতের প্রকাশন সংস্থা ওরিয়ন বুকস-এর অফিসে ‘দ্য কুকু ইজ কলিং’ নামের একটি রহস্য উপন্যাসের খসড়া জমা পড়েছিল। লেখক অজ্ঞাতকুলশীল আগে নাকি মিলিটারিতে ছিলেন, নাম রবার্ট গলব্রেথ; এটাই তাঁর জীবনের প্রথম উপন্যাস। ওরিয়নের অন্যতম সম্পাদক কেট মিলস বইটার দু’চার পাতা পড়ে বাতিল করে দেন। তাঁর মনে হয়েছিল লেখাটা মন্দ নয়, তবে এ রকম হুদো-হুদো লেখক গুচ্ছ-গুচ্ছ লেখা জমা দিয়ে বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, কোনওটাই ওঁরা ছাপার যোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। ওরিয়ন নামজাদা লেখকদের ঘর, সেখানে নতুন লেখকদের জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে।
বাকি ইতিহাস এখন সকলের জানা। বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। গত সপ্তাহে জানা যায় যে, লেখকের আসল নাম জে কে রওলিং, হ্যারি পটারের স্রষ্টা; রবার্ট গলব্রেথ নেহাতই ছদ্মনাম। গলব্রেথ-এর লেখা প্রকাশ না করার জন্য কেট মিলস’কে অবশ্য দোষ দিয়ে লাভ নেই। অন্য বিভিন্ন প্রকাশন সংস্থাও বইটি বাতিল করেছিলেন। সম্পাদককে তো পাঠকের মন বুঝে চলতে হয়। পাঠক বই কিনলে তবেই না প্রকাশকের লাভ। সম্পাদক তো চাকুরে মাত্র, তিনি তো আর নতুন লেখকের মুখ চেয়ে নিজের কেরিয়ারটাকেই জলাঞ্জলি দিতে পারেন না।
আর পাঠক মাত্রেই, তা সে যে দেশেরই হোক না কেন, হুজুগে-হাওয়া বুঝে ঘুরে যায়। এই ‘কোকিলের ডাক’টা আগে কেউই শোনেনি। এখন যেই জানা গেল বইটা আসলে রওলিং-এর লেখা, ব্যস, এক দিনে তার বিক্রি বেড়ে গেল কয়েক হাজার গুণ। প্রথম তিন মাসে মেরেকেটে যে বই হাজার দেড়েক কপি বিক্রি হয়েছিল, এক দিনেই তার তিন লাখ কপির অর্ডার এসেছে!
নামী লেখকের নামে যে-কোনও লেখাই ছাপা হয়ে যায় আর উঠতি লেখকের নাম চাপা পড়ে যায়, এমন উদাহরণ দেশেবিদেশে অজস্র রয়েছে। সাহিত্যের দৃষ্টান্তগুলি বহুচর্চিত। তার পুনরাবৃত্তি না করে বরং উল্টো একটা কথা বলে নিই। আশির দশকের শেষে পুজোসংখ্যায় ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি বা গত দশকের শেষ থেকে নীললোহিতের ভ্রমণ পড়তে পড়তে মনে হত, আর তেমন জমছে না, তবু নামের ওজনে কাটছে। তার বদলে পুজোতে নতুন কোনও লেখক সুযোগ পেলে হয়তো আমরা পাঠকরা বেশি উপভোগ করতাম। সত্যজিৎ বা সুনীলের হয়ে অন্য কেউ কলম ধরলে তো বেশ হত। প্রসঙ্গত, বিলেতে ইয়ান ফ্লেমিং-এর পরে জেমস বন্ডের কাহিনি অন্য লেখকরা লিখেছেন। ২০০৮-এ ফ্লেমিংয়ের জন্মশতবর্ষে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সেবাস্টিয়ান ফকস ‘ডেভিল মে কেয়ার’ নামের নতুন বন্ড উপন্যাস লেখেন, পেঙ্গুইন থেকে তা প্রকাশিত হয়।
কিন্তু নামী লেখক দিয়েই লেখানোর পক্ষে প্রকাশক বা সম্পাদকের যুক্তিও ফেলে দেওয়া যায় না। সুনীল লিখেছেন বলেই পাঠক বই কিনবেন— নীলুর কাহিনি কোনও এক ইন্দ্রজিৎ রায় লিখলে থোড়াই সে-বই কেউ কিনত? যদিও বা কিনত, পছন্দ করত কি? বলত, সুনীলের মতো প্রেমের গল্প কারও কলমে আসে না।
এ তো গেল সাহিত্যের কথা। সত্যি বলতে কী, ভাল-মন্দ ব্যাপারটা সাহিত্যের ক্ষেত্রে পুরোটাই পাঠকের ব্যক্তিগত। ইংরাজিতে যাকে বলে সাবজেক্টিভ। সুনীলের থেকে সুভাষ ঘোষালের কবিতা বা সমরেশ মজুমদারের থেকে সন্দীপনের উপন্যাস আপনার বেশি ভাল লাগতেই পারে— এতে ঠিক বা ভুল বলে কিছু হয় না। পাঠক হিসেবে আমি যে-কোনও প্রকাশকের বই কিনতে, পড়তে পারি; আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে তো আরও সোজা— প্রায় সব কিছুই অনলাইন।
বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে এই একই সমস্যা কিন্তু গুরুতর। একটা সময় ছিল যখন ধর্মগুরুর সামনে বিজ্ঞানীকে মাথা নত করতে হয়; পৃথিবী গতিশীল, এই তত্ত্ব প্রমাণ করে গালিলেয়োকে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞানীদের উপর এখন খবরদারি করেন জার্নালের সম্পাদক ও গবেষণাপত্রের রেফারি বা সমালোচকরা। যে কোনও আবিষ্কৃত বা গবেষণালব্ধ তত্ত্ব গবেষণাপত্র হিসেবে কোনও জার্নালে প্রকাশ না পেলে স্বীকৃতি মেলে না। গবেষণাপত্রটি পড়ে দুই বা তিন জন বিজ্ঞানী রেফারি হিসেবে মূল্যায়ন করেন, আর সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই জার্নালের সম্পাদক প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। বলাই বাহুল্য, বিখ্যাত লেখকদের পেপার অনেক সহজেই প্রকাশিত হয়; উঠতি নতুন গবেষকের ভাগ্যে জোটে একের পর এক ‘রিজেকশন’।
এ যুগে জন্মালে তরুণ গালিলেয়ো হয়তো ‘পৃথিবী ঘুরছে’ এমন পেপার জার্নালে ছাপানোর সুযোগ পেতেন না। ঠিক যেমন হয়েছিল জর্জ অ্যাকেরলফ-এর ভাগ্যে। ১৯৬৬ সালে আমেরিকার অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এম আই টি থেকে অর্থনীতিতে পিএইচ ডি করে ভারতে গবেষণা করতে আসেন। বয়স তখন ছাব্বিশ। ভারতে আসার আগে বাজার অর্থনীতির এক নতুন তত্ত্ব মাথা খাটিয়ে বার করেছিলেন তিনি। তত্ত্বের বিষয়বস্তু: কেনাবেচায় তথ্যের অসাম্য বা এসিমেট্রিক ইনফরমেশন। বাজারে যে সমস্ত পণ্য বা পরিষেবা কেনাবেচা হয়, তাদের সম্বন্ধে নানা তথ্য বিক্রেতাদের কাছে থাকে, ক্রেতারা কেনার আগে যা জানতে পারেন না। উদাহরণ হিসেবে অ্যাকেরলফ পুরনো খারাপ গাড়ি (আমেরিকাতে যাকে ‘লেমন’ বলে) কেনাবেচার বাজার নিয়ে একটি পেপার লেখেন: মার্কেটস ফর লেমনস। পেপারটি পর পর তিন বার তিনটি জার্নালের দরজায় ধাক্কা খায়। রেফারিরা বা সম্পাদকরা এই নতুন তত্ত্বকে মেনে নিতে পারেননি। চতুর্থ বারের প্রচেষ্টায় গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। এবং অর্থনীতির এক নতুন যুগের সূচনা ঘটে। এই পেপারটির জন্যে ২০০১ সালে অ্যাকেরলফ নোবেল পুরস্কার পান।
অ্যাকেরলফের অভিজ্ঞতা এই প্রজন্মেও বহাল— অনেকের জীবনেই ঘটেছে। নতুন গবেষকের পেপার মানেই সম্পাদক বা রেফারি তাকে বাতিলের খাতায় ধরবেন। তবে এটা যে শুধু নবীনের সমস্যা, তা মোটেই নয়। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিও নতুন কোনও তত্ত্বের কথা বললে বা নতুন কোনও পদ্ধতি চালু করলে একই রকম বাধা পান। যেমন ঘটেছে তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ আরিয়েল রুবিনস্টাইনের জীবনে। আরিয়েল খ্যাতনামা গেম থিয়োরিস্ট। গেম থিয়োরির গবেষণার জন্যে হয়তো আগামী দিনে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন। এ হেন তাত্ত্বিক সম্প্রতি এক নতুন পদ্ধতিতে নতুন এক্সপেরিমেন্ট করেন। মুশকিল হল, তাঁর এই গবেষণার গতটাই প্রচলিত ধারা থেকে আলাদা রকম। অতএব, পুরনো ধারার বিজ্ঞানীরা তাঁর পেপার ছাপা হতে বাধা দিচ্ছেন। আরিয়েলও নাছোড়। নতুন ভাবে তিনি লিখবেনই। উপরের উদ্ধৃতিটি সেই পেপার থেকেই।
শেষ করার আগে একটু খেদোক্তি করে নিই। এই পত্রিকার এই উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলোর কথাই ভাবুন। কোনও বিশেষ বিষয়ে বা বিতর্কে কলম ধরার অধিকার যেন বিখ্যাত ব্যক্তিদের কুক্ষিগত। সে সব লেখা পড়ে আমার মতো অনেক উঠতি লেখকেরই মনে হয়, ধুর, আমি এর থেকে ঢের ভাল লিখতে পারি। কিন্তু কী আর করা? কখন শিকে ছিঁড়বে, সেই অপেক্ষায় বসে থাকা ছাড়া?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.