প্রবন্ধ ২...
মুখ্যমন্ত্রী নিজের ক্ষতি করে চলেছেন
মাত্র তিনটি উপন্যাস লিখে পৃথিবী চমকে দিয়ে নোবেল প্রাইজ পেলেও, মৃত্যুর আগে অ্যালবেয়ার কামু খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন। গোলকিপার, নির্জনতা ভালবাসতেন। শেষ দিকে তিনি একা হয়ে যান রাজনৈতিক কারণে। বহুস্বর আলজিরিয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। চেয়েছিলেন সমানাধিকার পাক ইউরোপ ও আরব আফ্রিকা। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও মেনে নিতে পারেননি স্তালিন ও তাঁর গুলাগ। আর ফিরতে পারেননি বাঁ দিকে। যেতে পারেননি ডান দিকে। এবং যা হবার তা-ই হয়েছিল— দু’দিক থেকেই তাঁর ওপর আক্রমণ নেমে আসে। এই দ্বিমুখী কষ্টের কথা জানা যায় তাঁর মেয়ে ক্যাথরিনের লেখা থেকে।
সে দিন, ২১ জুন, ২০১৩ কলকাতায় মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে কামুর কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল তাঁর সেই প্রবন্ধের কথা: দ্য মিথ অব সিসিফাস। মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি মানে আছে মিছিলের? পাথর নিজে থেকেই নেমে আসবে। এই মিছিল কি তাকে আটকাতে পারবে? পারবে কি কামদুনির সেকেন্ড ইয়ারের মেয়েটিকে ছুঁতে? তাপসী মালিককে ফিরিয়ে দিতে? ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, পারবে তাঁদের একটু মানবিক করে তুলতে?
হয়তো পারবে না। কিন্তু তাই বলে সিসিফাস হাল ছেড়ে দেবে? প্রতিবাদ হবে না? রাস্তায় নামা যাবে না? রাস্তাটা কার? শুধু ক্ষমতার? লাল লাগালেই যেমন লাল হয় না, নীল সাদা লাগালেও নীল হয়ে যায় না। তা হলে রাস্তা কি আমাদের মতো ক্ষমতাহীনদেরও? সে দিন কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত দু’মাইল রাস্তাটুকু হয়ে উঠেছিল আসলে কয়েক হাজার মাইলের প্রতিবাদ। আমরা মিছিলের শুরু আর শেষ দেখি। অদৃশ্যকে দেখতে চাই না। জীবনে প্রথম মিছিলে হাঁটলেন, জীবনে দ্বিতীয় বার হাঁটলেন, আর কখনও হাঁটবেন না, আবার হাঁটবেন যদি আবার কামদুনি হয়, বানতলা হয়, পার্ক স্ট্রিট হয়! এঁরাই মিছিলের কোরক।

জবাবি মিছিল। কলকাতা, ১৫ নভেম্বর, ২০০৭। ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ
নন্দীগ্রামে গুলি চলার পর আমি সে দিন হাঁটিনি। অন্যায় করেছিলাম না হেঁটে। আমাকে কেউ বলেনি হেঁটো না, আমি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম না-হাঁটার। দায় আমার। আমি কোনও দিন কোনও দলের ছিলাম না, হয়ে গেলাম একটা দলের। যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে হাঁটা যায় না। কমা নয়, দাঁড়ি নয়, একটা ভুল সেমিকোলন কাজ করেছিল আমার সংকটে। সেই সেমিকোলনটা আজ একটা টিউমার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার আগুন লাগা অবচেতনায়। ‘সে দিন হাঁটেননি, আজ হাঁটতে এলেন কেন? আপনার হাঁটার অধিকার চলে গেছে, বাড়ি ফিরে যান।’ আত্মধমক নিয়ে হাঁটতে শুরু করি। আত্মধমক হয়ে ওঠে আত্মধিক্কার, আত্মধিক্কার হয়ে ওঠে চারটে লাইন:
কী ভুল আমি করেছিলাম
কেন সে দিন হাঁটিনি মহামিছিলে?
চোখের জল মুছে সে দিন তুমি
হাঁটতে বলেছিলে।

কিন্তু সে দিন যাঁরা হেঁটেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ কেন আজ বাড়িতে বসে আছেন? তাঁরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কৃতী, তাঁরা আমার মতো ভুল করতে পারেন না। তা হলে কী দাঁড়াল? বিভাজন থাকবেই? আমরা-ওরা ঘুচবে না? সে দিন ওঁরা হেঁটেছিলেন, আমি হাঁটিনি; আজ আমি হাঁটছি, ওঁরা হাঁটতে আসেননি। এই কি তবে ঠিক হল যে, এমন করেই হাঁটতে হবে আর সবাইকে গাইতে হবে হুকুম মতো গান? হুকুমটা সব সময় বাইরে থেকে আসে না, ভিতর থেকেও উঠে আসে। এক বস্তাপচা আলুর মতো আমাদের পিঠে চাপানো রয়েছে ইডিয়োলজি। সেটা ফেলে উঠে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। যে ইডিয়োলজি মানুষের কাজে আসে না, তার লজিক যত বড়ই হোক, সেটা লেজে-গোবরে হতে বাধ্য। যে কমিউনিজম নন্দীগ্রাম করেছে, নেতাই করেছে, ছোটআঙারিয়া করেছে, ২১ জুলাই করেছে, সেই কমিউনিজমকে আমি প্রত্যাখ্যান করি। এক জন প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট হিসেবে মনে করি, কামদুনি হলে আমি ছুটে যাব, রাস্তায় যাব। তার মানে এই নয়, আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করছি। তাঁর প্রাক্-মুসোলিনি ভাষা-সন্ত্রাসের মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে জেনেও আমি এখনও বলছি, মানুষ এখনও তাঁকে ভালবাসে। কিন্তু যে বিপুল জনাদেশ নিয়ে তিনি এসেছেন, তার লক্ষ্মী বড় চঞ্চলা। তিনি নিজে নিজের ক্ষতি করে চলেছেন যে-ভাবে, যে ভাবে ‘চোপ’ বলছেন, গ্রামের ভালবাসাও অচিরেই হয়ে উঠবে প্যাসিভ। যাঁরা তাঁকে ভালবাসেন, তাঁরা বলুন এই এই জিনিসগুলো খারাপ হচ্ছে। তাঁরা যদি না বলেন, তা হলে বুঝব আসলে তাঁরা মমতাকে ভালবাসেন না, ভালবাসেন পদ-পুরস্কার, ভালবাসেন বিভূষণ। সরে এসে, দূরে দাঁড়িয়েও এক জন মুখ্যমন্ত্রীকে সমর্থন করা যায়। তুমি আমার পাঁচটা কবিতাকে খারাপ বলেছ, মানে তুমি আমার সমস্ত কবিতাকে খারাপ বলছ, সেটা কেন ধরে নেব? এটা তো একটা অসুখ। এটাকে বলে প্যারানয়া।
জ্ঞান দিয়ে ফেললাম বোধহয়। ম্যাডোনার গান মনে পড়ে গেল, পাপা ডোন্ট প্রিচ। কিন্তু একটা নতুন পশ্চিমবঙ্গ উঠে আসছে। কোনও পাপা-মাম্মির হাত ধরে উঠে আসছে না। সে এক নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ, সবেমাত্র সে মাথা তুলেছে মাটির ওপর। সেই প্রজাতির নাম টুম্পা কয়াল, মৌসুমি কয়াল, সুজেট। টুম্পা-মৌসুমি গরিব ‘গাঁয়ের বধূ’, সাহসী। চোস্ত ইংরেজি বলা আত্মমর্যাদাময়ী নারী সুজেট, যিনি পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষিতা না হলে জানতে পারতাম না তার ভিতরে একজন মায়া অ্যানজেলু লুকিয়ে আছে? কে মায়া অ্যানজেলু? সেই কৃষ্ণকলি কবি, যিনি ক্লিন্টনের শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে এসে সারা পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন যে দশ বছর বয়েসে তিনি ধর্ষিতা হন।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাঁটার কী দরকার ছিল? বিদেশেই যাঁর লেখালিখি ছাপা হয়, সেই অমিত চৌধুরীর হাঁটার কী মানে? ম্যাসিডোনিয়ায় কবিতা পড়তে চলেছেন ইংরেজি ভাষার কবি শর্মিলা রায়, তাঁর ছ’বছর আগে হাঁটা ও ছ’বছর পরে হাঁটা দুটোরই বা কী দরকার ছিল? কামদুনির মেয়েটিকে চিরে ফেলার পর তাঁরাও পারলেন না ঘরে বসে থাকতে। প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, খুদে পড়ুয়াদের নিয়ে মিছিল করেন কোন সাহসে? ধরানো হল শো-কজ। কিন্তু এক জন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের জন্য ‘মাওয়িস্ট-ইনফেসটেড’ কামদুনিতে গিয়ে ভূতপূর্ব ভাইস-চ্যান্সেলররা হেঁটে এলেন, তাঁদের কোন শোকজ ধরাবেন? এমন প্রতিবাদ গত পঞ্চাশ বছরে কেউ দেখেছে? এগুলোই গণতন্ত্রের নতুন গহনা, অপহরণের সময়কালে এক জন যা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চলেছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.