মাইক থামানোর ছুতোয় বিয়েবাড়িতে হানা
কনের ভাইকে মার, এ বার
রক্ষকের ত্রাস কামদুনিতে
বুকে চেপে আছে শোকের পাথর।
আছে ক্ষোভের তুষানল।
আর আছে আতঙ্ক।
তার মধ্যেই বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানকে ঘিরে কামদুনি ফের স্বাভাবিকতার পথে ফিরতে চাইছিল। রবিবার সেই বিয়েবাড়িতে মাইক বাজানোর ‘অপরাধ’-এ কনের ভাইকে রক্ষীদের মারধর নতুন ত্রাসের আবহ ঘনিয়ে এনেছে ওই গ্রামে।
অথচ উচ্চগ্রামের কিছুই করা হয়নি কামদুনির মণ্ডলপাড়ার এক তরুণীর বিয়েতে। দেখলে বোঝার উপায়ই নেই যে, এটা বিয়েবাড়ি। সাধারণত বিয়েবাড়ির সুসজ্জিত তোরণ হয় রাস্তার দিকে। এখানে তেমন কিছু করা হয়নি। শুধু চট দিয়ে দায়সারা ভাবে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। ভিতরে ঢুকে চোখে পড়ল কিছু ফুল আর রঙিন কাপড়। তা-ও যতটুকু না-করলেই নয়। ওই বিয়েবাড়ির কোনও তোরণ তৈরি হয়নি। বিয়েবাড়ির ব্যস্ততা আর হাঁকডাক কমবেশি আছে। কিন্তু এই ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে যে-আনন্দ আর উচ্ছ্বাস থাকার কথা, এখানে তার ঘাটতি পদে পদে।
৭ জুন ওই এলাকার দ্বিতীয় বর্ষের এক কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ করে হত্যা করে দুষ্কৃতীরা। সেই ঘটনার ২৩ দিন পরে এই প্রথম কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান হচ্ছে ওই গ্রামে। কিন্তু বিয়ের আনন্দে পুরোপুরি মেতে ওঠার মতো অবস্থা নেই কনে পক্ষের। মণ্ডলপাড়ার যেখানে ওই বিয়েবাড়ি, সেখান থেকে নিহত ছাত্রীর বাড়ি ৫০০ মিটার দূরে, উত্তর দিকে। আর বিয়েবাড়ি থেকে ১০০ মিটার দক্ষিণে কয়ালপাড়া, যেখানকার বাসিন্দা টুম্পা কয়াল, মৌসুমী কয়াল ও মিতা কয়ালদের সঙ্গে সিপিএম-যোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে আইবি বা রাজ্য গোয়েন্দা শাখার রিপোর্টে। ওই কয়ালপাড়াতেই মোতায়েন রয়েছে বহু পুলিশ।
বিয়েবাড়িতে ঢুকে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই কেউ আর কোনও কথা বলতে চাইলেন না। কনের বাবার কাতর অনুরোধ, “দয়া করে আমাদের কথা কিছু লিখবেন না। বাইরে থেকে পাত্র ও বরযাত্রীরা আসছে। আমাদের ক্ষতি হয়ে যাবে। এমনিতেই আমরা, এই গ্রামের লোকেরা বিস্তর সমস্যায় রয়েছি।” তবে কনের বাবা জানালেন, গণধর্ষণ-খুনের নারকীয় ঘটনার পরে কামদুনির কনেকে নিয়ে পাত্র পক্ষের দিক থেকে কোনও সমস্যা হয়নি।
কিন্তু সমস্যা তৈরি করেছেন কনের বাড়ির কাছেই মোতায়েন পুলিশ এবং অন্য নিরাপত্তারক্ষীরা। কনের ছোট ভাই বাবুলাল মণ্ডল বললেন, “আমাদের বাড়িতে দু’টি সাউন্ড বক্সে খুবই কম শব্দমাত্রায় গান বাজছিল। এটুকু না-করলে তো আর বিয়েবাড়ি হয় না। ১০০ মিটার দূরে কয়ালপাড়ায় মোতায়েন ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ন (আইআরবি)-এর কয়েক জন জওয়ান এসে শব্দ কমাতে বলেন। আমরা শব্দ কমিয়েও দিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরে এসে ওঁরা আমাকে মারলেন। আমাকে মাটিতে ফেলে লাথিও মারা হয়েছে।”
কনের বাড়ির লোকজন ও প্রতিবেশীদের প্রশ্ন, যেখানে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে আর গোটা গ্রাম যখন অস্বস্তি আর আতঙ্কে কাঁটা হয়ে আছে, সেই জায়গায় কী ভাবে কনের ভাইকে মারধর করা হল? মারলেন কারা? নিরাপত্তারক্ষীরা। যাঁদের উপরে গ্রামের ভয় কাটানোর দায়িত্ব ন্যস্ত!
কনের ভাইকে মারা হল কেন?
উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “কামদুনির ওই বিয়েবাড়িতে সাউন্ড বক্সে গান বাজছিল বলে গ্রামেরই কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাই ওই বাড়ির লোকজনকে গান বন্ধ করতে বলা হয়। তবে কাউকে মারধরের কোনও ঘটনা ঘটেনি।”
পুলিশকর্তা অস্বীকার করলে কী হবে, মারধরের ঘটনায় নতুন এক ত্রাস চেপে ধরেছে কামদুনির গলা। এমনিতেই দুষ্কৃতী-হানার আতঙ্ক চেপে বসে আছে গ্রামের বুকে। আছে শাসক দলের শাসানি। আছে প্রতিবাদী কণ্ঠ চেপে ধরার জন্য সিপিএম বা মাওবাদী বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা। কামদুনির প্রশ্ন, নিরাপত্তা দিতে যাদের এই গ্রামে পাঠানো হয়েছে, তারা কি ত্রাস সৃষ্টি করেই নিরাপত্তা দেবে?
জবাব দেওয়ার কেউ নেই। এ দিনও কামদুনি মোড় থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তার দু’পাশে মোতায়েন ছিল প্রচুর পুলিশ। যাঁরা বিয়েবাড়িতে যাচ্ছেন, তাঁদেরও নাম-ঠিকানা এবং সঙ্গে গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল থাকলে তার নম্বর লিখে রাখা হচ্ছে। কেন? এক পুলিশকর্তার জবাব, “নিরাপত্তার খাতিরেই এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
তবে শোকের মধ্যে, ত্রাসের মধ্যে ক্ষোভ আর প্রতিবাদ জাগ্রত রেখেছে কামদুনি। ধর্ষণ-খুনের ঘটনার এক মাসের মধ্যে দোষীদের চরম শাস্তির ব্যাপারে যে কিছুই হচ্ছে না, তা নিয়ে ক্ষোভ কমেনি বিন্দুমাত্র। নিহত ছাত্রীর দাদা এ দিন বলেন, “ধৃতদের ফের আদালতে তোলার কথা ২ জুলাই। কিন্তু ওই দিনও যদি আমরা দেখি, দোষীদের শাস্তির কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে না, বৃহত্তর আন্দোলনে নামব।” সুবিচার ও প্রতিকার চেয়ে গ্রামবাসীরা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তুতিও চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা জানান, এই ব্যাপারে রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী তাঁদের সাহায্য করছেন। অধীরবাবু এ দিন বলেন, “এখানে কোনও রাজনীতির ব্যাপার নেই। সাধারণ গ্রামবাসী হিসেবে কামদুনির মানুষ দিল্লিতে পৌঁছবেন। আমি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করছি। শুধু আগেভাগে ওঁদের জানাতে হবে, কবে ওঁরা দেখা করতে চান।”
প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী এবং তার পরে আইবি রিপোর্টে তাঁদের গায়ে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের তকমা সেঁটে দেওয়ায় মিতা কয়ালের মতো গ্রামের মহিলারা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। টুম্পা ও মৌসুমীর সঙ্গে তাঁর নামও এসেছে আইবি রিপোর্টে। মিতার কথায়, “আমি এই গ্রামের বৌ। আমার শ্বশুরমশাইয়ের হাত ধরেই কামদুনিতে তৃণমূল ঢুকেছে। আমাকে কিনা বলা হল সিপিএম!”
শনিবার বাম শিক্ষক সংগঠনের মিছিলে টুম্পা, মৌসুমী এবং গ্রামের আরও কয়েক জন যোগ দেওয়ায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “ওই গ্রামে সিপিএমের লোকও আছে এবং তারা যে রাজনীতি করার জন্যই এ-সব করছে, ওই ঘটনায় (মিছিলে) তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে।”
মুকুলবাবুর এই মন্তব্যে ক্ষোভ বেড়েছে গ্রামবাসীদের। তাঁদের বক্তব্য, “ওটা তো শিক্ষক সংগঠনের মিছিল ছিল। তা ছাড়া গ্রামের তো মাত্র কয়েক জন ওই মিছিলে হেঁটেছিলেন। কিন্তু আমাদের গ্রামশুদ্ধ সকলকে সিপিএম বলে দাগিয়ে দেওয়া হল! এর চেয়ে দুঃখের আর কী আছে?”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.