রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩...
একটা ভয় কষ্ট লজ্জা[ঘেন্না]
মি ক্লাস ওয়ান আর দিদি থ্রি। সামনেই বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীর জোরদার ফাংশন। তারই মহড়া স্কুলের ক্লাসরুমে, মাঠে, হলঘরে। টিফিনের পর শেষ দুটো পিরিয়ড মানেই হইহই রিহার্সাল, পড়াশোনা সটান শিকেয়। এই অবধি রূপকথা মসৃণ চলেছে, ৪০ কিমি/ঘণ্টা। এ দিকে আমি আর দিদি রিহার্সালটাকে জোরসে টেনে বাড়ি অবধি নিয়ে এসেছি। স্কুল থেকে ফিরে কখনও ওর নাচটা দু’জন মিলে নাচছি, কখনও আমার নাচের মুদ্রা ঠিক করে দিচ্ছে দিদি। নির্দিষ্ট জমকালো রাতটা আরও ঝলমলে হবে বলে সেজে উঠছে পাঁইপাঁই। মাঠে বাঁশ পড়ছে, তেরপল টাঙানো হচ্ছে। কলেজ স্ট্রিট থেকে আসছে প্রাইজের বই। ক্লাসরুমে কোথাও ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’ তো কোথাও ‘একটু জল পাই কোথায়’— ডায়লগ, গান নাচের সাঁইসাঁই রিহার্সালে দুপুর-বিকেলগুলো থরহরিকম্প।
ফাংশনের দিনকয়েক আগে মাঠের ওপর পাকা স্টেজে শুরু হল রিহার্সাল। যে স্টেজে সত্যিকারের ফাংশন হবে। এখন থেকে সেখানে মহড়া না দিলে শিল্পীরা যে যার পার্টে দড় হয়ে উঠবে কী করে? স্টেজে শুরু হল এক একটা গান-নাচ-নাটকের রিহার্সাল, আর আমরা, উদীয়মান শিল্পীরা, বারান্দায় অপেক্ষা করছি যার যার টার্নের। দু-তিনটে নাচ-গানের পর দেখি দিদিও স্টেজে। দু’বার নাচ হতে না হতেই হঠাৎ দিদিমণি থামিয়ে দিলেন রিহার্সাল। আস্তে আস্তে একটা নিষ্ঠুর আঙুল উঠে এল দিদির দিকে। আর খুব কর্কশ গলায় বললেন, ‘অ্যাই, তুমি বাদ!’ দিদি ভারী শান্ত, মুখচোরা। ফর্সা টকটকে মুখটা লাল হয়ে গেল। কিন্তু কিচ্ছুটি বলতে পারল না। অত মেয়ে, সবাই নাচছে, ও বাদ। কেন? সেডিস্ট দিদিমণি ঝাঁইঝাঁই করে উঠলেন— তোমার মাথা ন্যাড়া কেন? কেউ ন্যাড়া মাথায় নাচে? অথচ দিদি যে এত দিন ধরে রিহার্সাল দিচ্ছিল, তখনও তো উনি দেখেছিলেন। তখন কেন বলেননি? দিদি মুখ নিচু করে নেমে এল এত্ত লজ্জা, এত্ত অপমান, সহপাঠীদের ঠাট্টা— ন্যাড়া মাথায় করে। রূপকথা তখন হাঁপ টানছে। আমি তখন দোতলার বারান্দায়। পরবর্তী আইটেম আমার।
আমি সিঁড়ি দিয়ে নামছি আর দিদি উঠছে— চোখাচোখি হল। ওর মুখে ঝড় এসে থেমে গেছে, আমি ঠিক জানি। দুদ্দাড় সিঁড়ি দিয়ে নামলাম, নাচলাম, আর বাদও গেলাম না। ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত, ফটরফটর কথা, ঝটপট অভিযানের মেয়ে আমি। তাই টিচারদের বেশ গুড বুক-এ। স্কুলে সবাই চেনে-জানে। আর আমার শান্ত দিদি— মিষ্টি-স্বভাব, মৃদুভাষী, মলমল-নরম— একটা মিঠে রোদ্দুর। আর তাই তেমন করে নিজের দাবি নিয়ে রইরই করতে পারে না। এ হেন মেয়েরা কিছু দিদিমণির কাছে যে হ্যাটা হবেই, এ আর নতুন কী। একটা ঘরানা ছিল তখন (খুব সম্ভব এখনও আছে)— এই মেয়েটা টিচারের ফেভারিট, অতএব তার সব ভাল। সে অঙ্ক খাতা না আনলেও মাফি মঞ্জুর। তার মায়ের সঙ্গে ছুটির পর হেসে হেসে কথা। আর ওই মেয়েটাকে দেখতে পারি না। কেন পারি না, তার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ফলটা বিলক্ষণ আছে। সেই মেয়েটা বিচ্ছিরি, খারাপ, সে বকুনি খায়, সে হাঁদা-গঙ্গারাম, বার বার সে হাত তুললেও তাকে দেখতেই পাওয়া যায় না, সে অকারণে নাটক থেকে বাদ, তার মায়ের সঙ্গে ছুটির পর দায়সারা কথা। আমার দিদি দ্বিতীয় দলের লাইফ মেম্বার। ফাংশনের দিন বাবা-মা দেখতে এল। সবার মেজাজ ফুরফুরে। আমার নাচের সময় দিদি উইংস-এর পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। বোন নেচে এলে তাকে বাবা-মা’র সিটের কাছে নিয়ে যাবে তো। বোনের যেন কোনও কষ্ট না হয়। আমার নাচ সাঙ্গ হল। খুব হাততালি। ছুট্টে দিদির কাছে এলাম। এক হাতে আমার হাত আর অন্য হাতে আমার রাতপরির পোশাকের ওড়না হাতে নিয়ে পরম যত্নে একমুখ হাসি নিয়ে দিদি আমাকে নিয়ে চলল। সবাই ভুলেই গেল দিদির সঙ্গে কী ঘটেছিল। কেবল আমি জানতাম, যে মোলায়েম স্নিগ্ধতা দিয়ে ঢেকে রেখেছে ওর কষ্ট, তার তলায় রয়েছে একটা গরম নোনতা জলের স্রোত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.