প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী
প্রয়াত হলেন সঙ্গীতশিল্পী এবং প্রাক্তন বিধায়ক অজিত পাণ্ডে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার সকালে বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয় বলে তাঁর পরিবারের তরফে জানা গিয়েছে। জীবনের বেশির ভাগ সময়েই তিনি গণসঙ্গীত গেয়েছেন। ‘ওই চাষনালার খনিতে মরদ আমার ডুইবা গেল রে’ তাঁর জনপ্রিয় গানগুলির একটি। ছাত্রজীবন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত তিনি। বৌবাজার থেকে সিপিএমের হয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেন তিনি। পরে অবশ্য প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে আসেন। গান গাওয়াকে তিনি কখনও অর্থমূল্যে বিচার করেননি। তাঁর গান নিয়ে বলা হত,
‘টাকা নেই ফান্ডে
আছেন অজিত পান্ডে’

অর্থাৎ যে সব ক্লাবগুলির টাকা নেই, সেখানেও গান গাইতে রাজি তিনি। তিনি দেহদান করেছেন। আজ, শুক্রবার তাঁর মরদেহ প্রথমে বিধানসভায়, তার পর সিপিআইএম রাজ্য দফতরে, তাঁর বাড়ি ঘুরে এনআরএসে নিয়ে যাওয়া হবে বলে তাঁর পরিবার সূত্রে খবর।

অজিত নেই, বিষাদ ডিসেরগড়ে
ডিসেরগড়ের সঙ্গে তাঁর প্রায় ত্রিশ বছরের সম্পর্ক। বৃহস্পতিবার সকালে গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত পাণ্ডের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই এলাকার মানুষের চোখে ভাসছে পুরনো স্মৃতি। মন খারাপ তাঁর এক সময়ের আড্ডার বন্ধুদেরও। সেই সব সুখ দুঃখের কথাই তাঁরা জানালেন, টুকরো কথায়।
সত্তরের দশক থেকে এই শহরে তাঁর যাতায়াত শুরু। ২০০০ সালের গোড়ায় পাকাপাকি ভাবে চলে গিয়েছিলেন এই শহর ছেড়ে। তাঁর স্ত্রী গায়ত্রী পাণ্ডে ছিলেন সাঁকতোড়িয়া ডিসেরগড় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। সেই সুবাদেই প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার কলকাতা থেকে ডিসেরগড়ে আসতেন অজিতবাবু। ফিরে যেতেন সোমবার সকালে। নিজে একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হওয়ায় খুব অল্পদিনের মধ্যে এলাকার কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তা অটুট ছিল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। কলকাতার প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকদের মাঝে মধ্যেই এখানে নিয়ে আসতেন তিনি। কলকাতা ও ডিসেরগড়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের কাজটাই নিয়মিত করেছেন তিনি। সাংস্কৃতিক বিনিময় চালিয়েছেন নিঃশব্দে।
এলাকার কবি নন্দদুলাল আচাযের্র সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল অজিতবাবুর। তিনি জানালেন, ১৯৭৪ সালে তাঁর সঙ্গে ডিসেরগড়েই প্রথম আলাপ হয় এই শিল্পীর। অজিতবাবুই তাঁকে প্রথম কলকাতায় নিয়ে যান। তিনি বলেন, “আমি নিয়মিত অজিতবাবুর মেসেই উঠতাম। তাঁর সঙ্গেই প্রথম গিয়েছিলাম কবি সুভাষ মুখোপাধ্যয়ের কাছে। এরপর একে একে গিয়েছি অমিতাভ দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ-সহ আরও অনেকের কাছে।” অজিতবাবুর সাহচর্যেই লেখালিখি করেছেন নন্দদুলালবাবু। ইস্কোর চাষনালা কয়লা খনিতে জল ঢুকে কয়েকশো শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা অনেকেই জানেন। নন্দদুলালবাবু জানান, ওইসময়ে তাঁদের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে চাষনালা যান অজিতবাবু। জলে তলিয়ে যাওয়া এক শ্রমিকের স্ত্রী-র কান্না শুনে তিনি লেখেন, ‘চাষনালার খনিতে মরদ আমার হারায় গেল গো’ গানটি। খনিশ্রমিকদের মুখে মুখে ফিরেছে এই গান। এলাকার বহু কবির কবিতায় সুর দিয়ে তিনি গেয়েছেন।
অজিত পাণ্ডে। —ফাইল চিত্র।
নবীন সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর অন্যতম বন্ধু আসানসোলের বাংলার অধ্যাপক দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, অজিতবাবুর ডিসেরগড়ে থাকার তিনটে দিন অন্য কোথাও কোনও কাজ রাখতেন না তাঁর মতো নবীনরা। শনিবার সকাল থেকে শুরু হত আড্ডার পর্ব। কখনও তাঁর স্ত্রীর স্কুল আবাসনে, কখনও ক্লাব চত্বরে, কখনও বা পলাশের জঙ্গলে। মাঝে মধ্যে ছিন্নমস্তা মন্দির সংলগ্ন দামোদর নদের পাড়েও চলত তাঁদের আড্ডা। তিনি বলেন, “আমরা তখন কলেজে পড়ি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম অজিতদার কথা ও গান।”
প্রায় কুড়ি বছর আগে কলকাতায় ডাক্তারি পড়ার সময়ে অজিতবাবুর সঙ্গে আলাপ হয় ইসিএলের চিকিৎসক সৌমেন ভঞ্জের। বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে মুষড়ে পড়েছেন তিনি। বলছিলেন পুরনো দিনের কথা“তখন আমি হাওড়ার শিবপুরের বাসিন্দা। কলেজের সোশ্যালে গান গাইতে এসেছিলেন অজিতদা। সেই প্রথম পরিচয়। ডাক্তারি পড়তে পড়তে এরপর বেশ কয়েকবার দেখা ও কথা হয়েছে। পাশ করার পর চাকরি খুঁজতে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ইসিএলে চাকরি পেয়ে ডিসেরগড়ে এসে উঠি। এক দিন অজিতবাবুর স্ত্রীর চিকিৎসা করতে গিয়েছিলাম। তখনই জানতে পারি, ওঁর স্বামীর নাম অজিত পাণ্ডে। আবার ফিরে এল পুরনো সম্পর্কটা। আসানসোল শিল্পাঞ্চলের শিল্প সাহিত্যের উৎকর্ষ বাড়াতে আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি। তাঁর কথা মনে রাখবে ডিসেরগড়।”
দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে কোলফিল্ড ট্রেন ধরে কলকাতা থেকে আসানসোলে আসতেন অজিতবাবু। ট্রেনের নিত্যযাত্রী ধর্মদাস চৌধুরী বলেন, “শুক্রবার বিকেলে আমাদের কামরার জানলার ধারের একটি আসন তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল। সোমবার ফেরার সময়েও সেখানেই বসতেন তিনি। তাঁর আসা যাওয়ার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আমরা এইটুকু ব্যবস্থা করে রাখতাম।”
ইসিএলের সদর কার্যালয়ের জনসংযোগ দফতররে আধিকারিকদের সঙ্গেও যথেষ্ট হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল তাঁর। শহরে থাকলে নিয়মিত ওই দফতরে যেতেন, গল্পগুজব করতেন। বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যু সংবাদে শোকাচ্ছন্ন এই দফতরের অনেকেই। অস্ফুটে কেউ কেউ বললেন, “এমন খারাপ সকাল কখনও আসবে, ভাবিনি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.