বিলিতি ময়দান
তিরাশির পর ইংল্যান্ডে প্রথম দু’দেশের যুদ্ধ ঐতিহাসিক ওভালে
ক্ষুব্ধ ধোনি হিন্দি সাংবাদিক
সম্মেলন করলেন না
হেন্দ্র সিংহ ধোনিকে একেবারেই লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো দেখাচ্ছে না!
এই যে ভারতীয় ক্রিকেটের শিরায় উপশিরায় বার্তা রটি গেল ক্রমে, শ্রীনিবাসনের ক্ষমতা হ্রাসের সঙ্গেই অথর্ব হয়ে পড়বেন ভারত অধিনায়ক। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে তাঁর অ্যাদ্দিনকার নিশ্চিত মনোনয়ন চূড়ান্ত সন্দেহজনক হয়ে পড়বে। বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদী যুগের মতোই ভারতীয় ক্রিকেটে বিরাট কোহলি যুগ শুরু হয়ে যাবে। তাতে মনে হল না ধোনির বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ আছে বলে।
আর পাঁচ জন হলে এই সময়টা মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখার চেষ্টা করত। অন্তত মিডিয়ার প্রভাবশালী অংশের সঙ্গে। দিনকাল খারাপ বলা তো যায় না কখন কাকে লাগে! ক্রিকেটজীবনের সবচেয়ে ঔদ্বত্যপূর্ণ মেজাজেও মহম্মদ আজহারউদ্দিন মিডিয়ার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে গিয়েছেন। ধোনি হলেন ধোনি! বাহ্যিক ভাবে তাঁর মেজাজটা উগ্র নয়। কিন্তু ঔদ্ধত্যটা আজহারের চেয়ে অনেক বেশি। যা চাপা থাকায় বাহ্যিক প্রয়োগ হয় না। ওভালে সোমবার দুপুরে ভারত অধিনায়কের যা মনোভাব দেখলাম, দেশজ মিডিয়াকে মোটেও তিনি ছয় হাঁকাতে চান না।
বারো হাঁকাতে চান বলে!
সোমবার সাংবাদিক সম্মেলনে। —নিজস্ব চিত্র
প্রেস কনফারেন্সে সাধারণ ভাবে সাংবাদিকেরা দুটো ভাষায় প্রশ্নের সুযোগ পান। একটা ইংরেজি। একটা নিজের মাতৃভাষা। পাকিস্তানি সাংবাদিক হলে উর্দুতে আলাদা প্রশ্নোত্তর। বাংলাদেশি হলে বাংলায়। শ্রীলঙ্কান হলে সিংহলিজ ভাষায়। ভারতীয় হলে হিন্দি। আইসিসি টুর্নামেন্টে সবচেয়ে কঠোর ভাবে এই নিয়ম মেনে চলা হয়।
অথচ এ দিন ধোনি হিন্দিতে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন না। আইসিসি-র মহিলা মুখপাত্র প্রথমে বলে গিয়েছিলেন দুই ভাষাতেই হবে। প্রথমে ইংরেজি, পরে হিন্দি। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া ম্যানেজার এসে প্রায় রেলগাড়ি ছোটানোর ভঙ্গিতে প্রেস কনফারেন্স শেষ করে দিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে সাংবাদিক সম্মেলন স্থায়ী হল মাত্র দশ মিনিট। ধোনিরা দ্রুত উঠে যাওয়ার পর হতচকিত সংবাদমাধ্যম জানার চেষ্টা করল, চলে গেল যে? হিন্দি?
মহিলা মাথা নাড়েন, প্রথমে তা-ই কথা ছিল। একটু আগে ওরা জানাল, হিন্দিটা করবে না। ওরা পৃথিবীর সমস্ত ক্রিকেটমাঠকে বাজি রেখে বলা সম্ভব মহেন্দ্র সিংহ ধোনি!
এমন বিতর্কদগ্ধ সময়ে ইংল্যান্ডের কঠিন আবহাওয়ায় টিম এত ভাল খেলার রহস্য কী? সাংবাদিক সম্মেলনের উদ্বোধনী প্রশ্নটা আনন্দবাজার থেকে পেয়ে ধোনি শ্লেষাত্মক জবাব দিলেন, “এখানে চ্যানেল দেখতে পাই না। কাগজ পড়তে পারি না দেশের। তাই শান্ত মনে খেলায় ডুব দিতে সুবিধে হচ্ছে।”
উত্তর হিসেবে সত্যিই। কিন্তু একই উত্তর তো নানান ভঙ্গিতে দেওয়া যায়। নানান শরীরী ভাষা নিয়ে বলা যায়। এমএসডি খুব পরিষ্কার করে দিচ্ছেন যে মুকুট যার, রাজত্ব তার। যদি এ রকমই টানা ভাল খেলতে পারি, কে মিডিয়া আমি দেখব!
মঙ্গলবার উইকডে-র অফিসের সময় ম্যাচ হয়েও যে ওভাল কাউন্টারে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা ম্যাচ সংক্রান্ত চুম্বকের একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। অর্জুন তেন্ডুলকর যে মাঠে এ দিন দুপুরবেলা বোলিং মেশিনের সামনে প্র্যাক্টিস করছিল, সেই মাঠে শেষ সাক্ষাতের পর প্রথম ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ দেশে দেখা হচ্ছে। তিরাশির লর্ডসের সেই দিনে ধোনির বয়স ছিল দু’বছর। গেইলের চার। ভাবতে আশ্চর্যই লাগছে। মধ্যিখানে এতগুলো বিশ্বপর্যায়ের টুর্নামেন্ট এ দেশে হয়েছে। বিশ্বকাপ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। কখনও লয়েডের দেশ আর কপিলের দেশ একে অন্যের মুখোমুখি পড়েনি।
ওভাল মাঠের যেন একটা ঐশ্বরিক ক্ষমতাই রয়েছে ঐতিহাসিক সব পরিস্থিতি আহ্বান করে আনার। টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ডেলিভারি মানে যেটা অ্যালফ্রেড শ করেছিলেন চার্লস ব্যানারম্যানকে, এখানে নয়। ঘটেছিল এমসিজিতে। কিন্তু পরবর্তী কালের নাটকীয়, তাৎপর্যপূর্ণ, রোম্যান্টিক তাবৎ ঘটনাই ওভাল মাঠে!
১৮৮০: ইংল্যান্ডের মাঠে প্রথম টেস্ট ম্যাচ। গ্রেসের সেঞ্চুরি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের জয়।
১৮৮২: ইংল্যান্ডের হারে অ্যাসেজের জন্ম।
১৮৮৪: টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।
১৯৩৭: নতুন এলবিডব্লিউ আইনে প্রথম টেস্ট। তার আগে নিয়ম ছিল লেগস্টাম্পের বাইরে পিচ পড়া বলেও ব্যাটসম্যান এলবিডব্লিউ হতে পারে।
১৯৩৮: টেলিভিশনে প্রথম একটা টেস্ট লাইভ প্রচারিত। হাটনের ৩৬৪। ইংল্যান্ডের ৯০৩।
১৯৪৮: ব্র্যাডম্যানের শেষ টেস্ট ইনিংস।
অঞ্চল হিসেবে ওভাল লন্ডনের নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকা হিসেবেই স্বীকৃত। টেমসের ও পার। উত্তর লন্ডনের গরিমা নেই। মা-মাটি-মানুষের মাঠ। ওভাল টিউব স্টেশনের সঙ্গেই লাগোয়া একটা জুতো সারাইয়ের দোকান। যা লর্ডসের কাছাকাছি কোনও টিউব স্টেশনের সঙ্গে কল্পনাই করা যায় না। এলাকায় ব্রিটিশরা যত না সংখ্যায়, তার চেয়ে বেশি শুনলাম অ্যাফ্রো-ক্যারিবিয়ানরা। স্থানীয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা যখন বাধ্যতামূলক সতর্ক করবেন এই মাঠের কাছাকাছি রাতবিরেত না করাই মঙ্গল, তখন ক্রিকেট অনুভবীর মনে হবে এ কী রে বাবা। ও-ভা-ল নিয়ে এ সব বলছে!
এ মাঠের বরাবরের ভাড়াটে সারে কাউন্টি তার যে বীর সন্তানদের ফলকে-স্থাপত্যে-ছবিতে সম্মানিত করে রেখেছে, তাঁরা হলেন স্যর জ্যাক হবস (১৯০৫-১৯৩৪), পার্সি ফেন্ডার (১৯১০-১৯৩৫), স্যর অ্যালেক বেডসার (১৯৩৯-১৯৬০), পিটার মে (১৯৫০-১৯৬৩), কেন ব্যারিংটন (১৯৫৩-১৯৬৮)।
ভারতীয় টিম বাস যাঁর নামাঙ্কিত গেটটা দিয়ে বার হচ্ছিল, তিনিই ওভালের সর্বকালের সেরা নক্ষত্র স্যর জ্যাক হবস। সবচেয়ে বেশি প্রথম শ্রেণির সেঞ্চুরির রেকর্ড আজ একশো বছর পরেও যাঁর দখলে। এটা প্রায় আট সেকেন্ডে একশো মিটার ছোটার মতো দৈবিক ব্যাপার। আর হবে বলে কেউ মনে করে না। কিন্তু আধুনিক ক্রিকেট-বিশ্লেষকেরা বেশি কৃতিত্ব দিতে চান বেডসারকে। বোলার হয়েও যিনি বছরের পর বছর ক্লান্তিহীন ভাবে ওভালের ফৈজলাবাদসদৃশ ব্যাটিং কার্পেটে উইকেট তুলে গিয়েছেন। প্রশ্ন হল, দীনেশ কার্তিক আর শিখর ধবনদের জন্যও আগামিকাল কি সারে উইকেটের আদিম ঐতিহ্যই বজায় থাকবে? নাকি এমন মেঘলা, ঘাস থাকা, কনকনে ঠান্ডায় চার পেস বোলার খেলানোর লোভনীয় সময় অন্য কিছু বয়ে আনবে?
নামী ইংরেজ লিখিয়ে বলছিলেন, ওভালের কাছাকাছি লন্ডনের নামকরা লোকেদের আস্তানাও বিশেষ নেই। এখানকার শিল্পীরা, ইন্টেলেকচুয়ালরা সব থাকেন উত্তর লন্ডনে। কেবল চার্লি চ্যাপলিন শৈশবে একটা বড় সময় টেমস নদীর এই মধ্যবিত্ত দক্ষিণ পারে কাটিয়েছেন। আর উইলিয়াম চেস্টার মাইনর যাঁর অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি তৈরিতে খুব প্রভাবশালী ভূমিকা। ব্রিটিশ ক্রিকেট লিখিয়েদের এই মানসিক ক্রিকেট বর্ণাশ্রম শুনলে মনে হবে সোমবার বুঝি তৃতীয় বিশ্বের দুটো দেশ তৃতীয় বিশ্বের মাঠেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে!
আর যদি সেটাও করে, অন্তত ভারতের দিক দিয়ে অনেক কিছু যে এই ম্যাচের ওপর ঝুলে রয়েছে তা তো আর মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না! ধোনি সম্মেলন শেষ করার আগে স্বগতোক্তির ঢঙে একটা উত্তর দিলেন যা খুব তাৎপর্যপূর্ণ: মনটাকে বর্তমানে রাখছি যথাসম্ভব। আমরা এখানে যা করতে পারি তা থেকে সরাচ্ছি না। কারণ এর বাইরে যা সব ঘটছে, তার ওপর তো আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
মনে হল পরোক্ষে এ দিনের রাজ কুন্দ্রা অধ্যায়টাই উল্লেখ করলেন। সত্যিই তো এই পরিমাণ মাঠের বাইরের চাপ নিয়ে জীবজগতে ভারতীয় ক্রিকেট টিমকে কখনও নামতে হয়নি।
সৌরভের টিম কিনিয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এসেছিল ম্যাচ ফিক্সিং দগ্ধ হয়ে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেখানে রক্ষকেরা অপরাধী সাব্যস্ত হয়নি। সেখানে এই পর্যায়ের অসহায়তা ছিল না। এমন মাত্রায় বিপণ্ণতা হাজির হয়নি।
শিল্ড বেরি এক জনের নাম করতে ভুলে গেলেন। তিনি ওভাল মাঠের খুব কাছেই থাকতেন জীবনের শেষ কয়েকটা বছর। সিএলআর জেমস। বিখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান লেখক ও সমাজ সংস্কারক। তাঁর বিখ্যাত লাইনটার ছায়া যেন আপাত গুরুত্বহীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ গ্রুপ লিগ ম্যাচের আগে হবস গেটের ওপর গিয়ে পড়েছে!
‘What do they know of cricket who only cricket know.’ তাহারা ক্রিকেটের কী বোঝে যাহারা শুধুই ক্রিকেট বোঝে!

তিরাশির লর্ডস-ইতিহাসের পর আজ
শততম ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওয়ান ডে
গত ৩০ বছরে ম্যাচ ৯৯
ভারতের জয় ৪৩
ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় ৫৩
টাই ১, ফলাফলহীন ২

আইসিসি বিশ্বকাপে
১০ মার্চ ১৯৯২ (ওয়েলিংটন) ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৫ উইকেটে জয়ী। ম্যাচের সেরা কামিন্স (৪-৩৩)
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ (গ্বালিয়র) ভারত ৫ উইকেটে জয়ী। ম্যাচের সেরা তেন্ডুলকর (৭০)
২০ মার্চ ২০১১ (চেন্নাই) ভারত ৮০ রানে জয়ী। ম্যাচের সেরা যুবরাজ সিংহ (১১৩ ও ২-১৮)

আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে
৩১ অক্টোবর ১৯৯৮ (ঢাকা) ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৬ উইকেটে জয়ী। ম্যাচের সেরা মার্ভান ডিলন (৩-৩৮)
২৬ অক্টোবর ২০০৬ (আমদাবাদ) ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩ উইকেটে জয়ী। ম্যাচের সেরা চন্দ্রপল (৫১)
৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (জোহানেসবার্গ) ভারত ৭ উইকেটে জয়ী। ম্যাচের সেরা বিরাট কোহলি (৭৯ ন.আ.)

আজ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত : ওয়েস্ট ইন্ডিজ (ওভাল)




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.