নরকপথে নিত্যদিন নিরুপায় আতঙ্কযাত্রা
হিলাদের নিত্য আতঙ্কযাত্রার আর এক নাম কামদুনি-বিডিও অফিস-মধ্যমগ্রাম সড়ক! দু’পাশে যত্রতত্র চোলাইয়ের ঠেক। সেগুলিকে ঘিরে মাছি ভনভন যত মদ্যপ, লম্পট, সমাজবিরোধীর। রোজই এই নরক পথ দিয়েই কলেজে পড়তে যেতে হত কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীটিকে। অন্য দিন যেতেন সাইকেলে। পরীক্ষার তাড়া থাকায় সে দিন গিয়েছিলেন এক পরিচিতের মোটরবাইকে। বাস স্ট্যান্ডে নামার পরে দুঃসাহসে ভর করে তাই হেঁটেই ফিরছিলেন শুক্রবার। সেটাই শেষ ফেরা দুষ্কতীদের অভয়ারণ্য দিয়ে!
অভয়ারণ্য কেন? কারণ, চার পাশের গ্রামগুলির সকলেই যা দীর্ঘদিন ধরে জানেন, শুক্রবারের ঘটনার আগে পর্যন্ত পুলিশ-প্রশাসনের তা জানা ছিল না। কারণ, তাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেননি। অন্তত এমনটাই জানিয়েছেন, জেলার পুলিশ সুপার। শনিবার ঘটনার তদন্তে গিয়েছিলেন সিআইডি-র গোয়েন্দেরা। পুলিশের না-জানার বহর হজম হয়নি তাঁদেরও। গ্রামবাসীরা অবশ্য সরাসরিই তুলছেন, মাসোহারার কথা।
ফুট বিশেক চওড়া রাস্তার দু’পাশে মাছের ভেড়ি, ধানখেত আর মাঝেমধ্যে কারখানা তৈরির জন্য নেওয়া পাঁচিল-ঘেরা জমি। সন্ধে নামলে তো কথাই নেই, দিনেদুপুরেও সমাজবিরোধীদের আড্ডা। কিশোরী হোক বা প্রৌঢ়া, ওই রাস্তা দিয়ে গেলে টিটকিরি, কটূক্তি ও অশ্লীল ইঙ্গিত জুটবেই।
রাস্তায় মৃতদেহ রেখে বিক্ষোভ স্থানীয় বাসিন্দাদের। শনিবার কামদুনি মোড়ে।
নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পথচারী মহিলাদের উপরে চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বহু বার। শুক্রবার যে পাঁচিল-ঘেরা জমির ভিতর কলেজ ছাত্রীটিকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেখানেই বছর পাঁচেক আগে এক প্রৌঢ়াকে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
কামদুনি থেকে বিডিও অফিস পর্যন্ত ওই সাড় চার কিলোমিটারের কিছু বেশি রাস্তা অসামাজিক কার্যকলাপের আখড়া দীর্ঘদিন ধরেই। পরিস্থিতি এখন এমনই যে, কামদুনি মোড়ে শাসক দল তৃণমূলের বারাসত-২ নম্বর ব্লক পার্টি অফিসের পাশেই রমরমিয়ে চলেছে চোলাইয়ের ঠেক। রাজারহাট চৌমাথা থেকে পূর্বে খড়িবাড়ির দিকে পাঁচ কিলোমিটার গেলে কামদুনি বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে উত্তর দিকে ওই কামদুনি-বিডিও অফিস-মধ্যমগ্রাম সড়ক। বাসস্ট্যান্ড থেকে ওই তরুণীর বাড়ি ২ কিলোমিটার। কিন্তু মৃত্যুফাঁদ পাতা ছিল তার অনেক আগেই। বাসস্ট্যান্ড থেকে ৩৬০ মিটার দুরে সেই পাঁচিল-ঘেরা কারখানার জমি। সেখানেই জবরদস্তি ওই কলেজ ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে।
চরিত্রে কামদুনি-মধ্যমগ্রাম সড়ক থেকে মোটেই আলাদা নয় রাজারহাট-খড়িবাড়ি রোডও। দু’পাশে সেই মাছের ভেড়ি, ধানের খেত, পাঁচিলের ঘেরাটোপে শিল্প-কারখানার জমি। এবং অবশ্যই চোলাইয়ের ঠেক, দেহব্যবসা ও অন্যান্য অসামাজিক কার্যকলাপ। মহিলার বয়স মানে না চোলাইয়ের নেশা। মাসোহারার ঠুলি চেনে না দুষ্কৃতীদের ঠেক। যার দরুণ নিত্য আতঙ্কে থাকেন এলাকার মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা।
বসিরহাটের সাংসদ হাজি নুরুল ইসলামের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ।
এতটাই যে, সঙ্গতি ও ইচ্ছে থাকলেও নিজের পাঁচ বছরের মেয়েকে ওই রাস্তার উপরে হওয়া ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করার ঝুঁকি নেননি কামদুনির বর্ণালী ঘোষ। স্বামী কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। শুক্রবার ধর্ষিতা এবং খুন হওয়া তরুণীটিই তাকে পড়াতেন। বর্ণালীদেবীর কথায়, “ওই স্কুলে ভর্তি করলে আমাকে একাই মেয়েকে নিয়ে যাতায়াত করতে হত। শুধু ওই ভয়েই মেয়েকে ওখানে ভর্তি করিনি।”
অসীমা ঘোষ নামে আর এক মহিলা বলেন, “দিনের বেলাতেই প্রকাশ্যে বসে চোলাই খাওয়া চলে। মহিলারা সামনে দিয়ে গেলেই শুরু হয়ে যায় টিটকিরি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি। আমরা কী করব, পুরুষরা পর্যন্ত ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। কিছু বলতে পারে না, এমন সব সমাজবিরোধীদের আড্ডা ওই রাস্তার দু’ধারে।” অসীমাদেবীর কথায় সায় দিয়ে জাহানারা বেগম বলেন, “রুটি-রুজির জন্য আমাদের বাইরে কাজ করতে যেতে হয়। বয়স হয়ে গিয়েছে, তার পরেও ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময়ে আমাদের উদ্দেশে ভেসে আসে নোংরা ইঙ্গিত।”
নিরাপত্তার অভাব সব চেয়ে বেশি অবশ্য ছাত্রীদের। খুন হওয়া তরুণী এক সময়ে যে-স্কুলে পড়তেন, সেই কীর্তিপুর নবীনচন্দ্র হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর বক্তব্য, “ওই রাস্তা দিয়ে আমাদের সব সময়ে দল বেঁধে যাতায়াত করতে হয়। চোলাইয়ের ঠেক সামনে পড়লে আমরা বরাবর মাথা নিচু করে চলে যাই। কিন্তু তাতেও কি নিস্তার আছে! নেশা করে আমাদের গায়ে ঢলে পড়ার ঘটনাও ঘটে।”
ডিরোজিও কলেজেরই প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী ছিলেন ওই তরুণীর সাইকেল-সহযাত্রী। গ্রাম থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত দু’জনেই এক সঙ্গে সাইকেলে যাতায়াত করতেন। কিন্তু শুক্রবার কলেজ যাননি প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রী। গেলে কী হতে পারত, ভেবেই আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন তিনি। বললেন, “ঘটনাচক্রে শুক্রবার আমি যাইনি। আমরা দু’জনে তো একসঙ্গেই যাতায়াত করতাম। শুক্রবার কলেজে গেলে হয়তো আমারও একই পরিণতি হত!” ওই ছাত্রীর বক্তব্য, “বিকেল পাঁচটায় কলেজ ছুটি হওয়ার পরে অন্ধকারে ওই রাস্তা দিয়ে ফিরতে এমনিতেই ভয় করে। ওই রাস্তায় আলো নেই। গোটা পরিবেশটাই ভয়ঙ্কর।” আগামী দিনগুলিতে একা যাতায়াতের কথা ভাবতেও এখন শিউরে উঠছেন ওই তরুণী। দীর্ঘদিন ধরে ওই রাস্তায় একটা পুলিশ চৌকি বা ফাঁড়ির দাবি জানিয়ে আসছেন এলাকার মানুষ। কিন্তু সে সব দূরের কথা পুলিশি টহলদারিও হয় না। শুক্রবারের ঘটনাস্থল ও তার আশপাশের এলাকা বারাসত থানার অন্তর্গত, অথচ নিকটবর্তী থানা রাজারহাট। ওই জায়গা থেকে বারাসত ১০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। কোন থানায় অভিযোগ জানাতে যাবেন, এই নিয়েও সাধারণ মানুষ অনেক সময়েই বিভ্রান্ত হন। যেমন হয়েছিলেন শুক্রবারও। কিন্তু এর পাশাপাশি পুলিশের বিরুদ্ধে দায়িত্ব এড়ানোরও অভিযোগ উঠেছে।
সিআইডি-র যে তদন্তকারীরা শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছিলেন, তাঁরাও স্থানীয় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। তাঁদের বক্তব্য, শুক্রবার তো একটা ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এত বছর ধরে রমরমিয়ে চোলাইয়ের ঠেক ও অসামাজিক কাজকর্ম চললেও থানার পুলিশ সে সব ঠেকাতে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কেন? উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার সুগত সেন অবশ্য বলেন, “আমাদের কাছে কেউ কখনও ওই এলাকা নিয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ জানাননি। তবে আমাদের টহলদারি তো রয়েছেই।” পুলিশের একাংশ যখন ওই এলাকায় চোলাইয়ের ঠেক-সহ অসামাজিক কাযর্কলাপ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বলে দাবি করছেন, তখন স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চোলাইয়ের ঠেক দাপটে চলে পুলিশকে মাসোহারা দিয়েই।
শুক্রবারের ওই নারকীয় ঘটনার পরে আর পুলিশের অপেক্ষায় না থেকে শুক্রবার রাতে ক্ষিপ্ত জনতা চোলাইয়ের ঠেকগুলি ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেয়।

পুরনো খবর:
ছবি: সুদীপ ঘোষ



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.