পুস্তক পরিচয় ২...
বই কি শুধুই অক্ষরের সমাহার
দ্য চাইল্ডহুড অব জেসাস, জে এম কুতসি। হারভিল সেকার (লন্ডন), ৭৯৯.০০
কোনও কোনও উপন্যাস পড়ে মনটা খুশিতে ভরে ওঠে, কোনও কোনও উপন্যাস ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। আবার কোনও কোনও উপন্যাস রুদ্ধবাক করে দেয়। এ কি উপন্যাস, না চেনা সাহিত্যপ্রকরণের আড়ালে অন্য ইশারা? ঠিকঠাক ধরা গেল তার সঙ্কেত? নাকি, যত বার চেষ্টা করেছি, তত বারই আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়েছে সে? রয়ে গিয়েছে বোঝা, না-বোঝার মাঝে অন্য এক উপলব্ধিস্তর?
দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক, অধুনা অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা জন ম্যাক্সওয়েল কুতসি-র (J. M. Coetzee) সাম্প্রতিক উপন্যাস দ্য চাইল্ডহুড অব জেসাস ওই বিরল তৃতীয় ধারার কাহিনি। নোভিলা শহরে পৌঁছেছে ছিন্নমূল প্রৌঢ় সাইমন, সঙ্গে পাঁচ বছরের ডেভিড। দু’জনের কোনও সম্পর্ক নেই, আসার পথে নৌকোয় আলাপ। ডেভিডের কাছে এক চিরকুটে মায়ের নাম, ছবি ছিল। চিরকুটটি সমুদ্রে পড়ে যায়। সাইমন বালকটির দায়িত্ব নেয়, তার মাকে খুঁজে দেবে সে। কিন্তু মায়ের নাম? কেমন দেখতে তাঁকে? দু’জনেই ভাবিত নয়। সাইমন জানে, মাকে খুঁজে পেলে ডেভিড ঠিক বুঝতে পারবে, ‘ইনটুইশন’ই সঙ্কেত পাঠাবে।
নতুন শহরে দু’জনে রিসেপশন সেন্টারে যায়। মেলে থাকার ঘর। পর দিন ডকইয়ার্ডে জাহাজ থেকে ঘাড়ে করে মাল খালাস করার ‘স্টিভেডর’-এর কাজও পায় সাইমন। উপন্যাস জানায়, নোভিলা শহরে বাসভাড়া লাগে না, সকলেরই মাথার ওপরে এক টুকরো ছাদ জুটে যায়। খাবারের বাহুল্য নেই, কিন্তু অনাহারেও থাকতে হয় না। সকলেরই রুটি মিলে যায়।
নোভিলা তা হলে আদিম সাম্যবাদ? যে শহরে এসে সবাই নাম, ঠিকানা এবং খাবার পায়? সাইমন, ডেভিডরা যুদ্ধ না প্রাকৃতিক দুর্যোগ কী ভাবে ছিন্নমূল হল, কোথায় তাদের দেশ এক বারও জানা যায় না। বরং সাইমন বালক ডেভিডকে বলে, ‘বাকি সবাই যে কারণে এই শহরে, আমরাও সেই কারণেই। বেঁচে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, আমরা সেটি গ্রহণ করেছি।’ নোভিলা কি তা হলে এই মানুষী দুনিয়ার প্রতীক? সকলের রুটি পাওয়ার মধ্যে আদিম সাম্যবাদের পাশে রয়ে গেল খ্রিস্টীয় ইশারা?
২০০৩-এ নোবেলজয়ী লেখক কুতসি এ ভাবেই আমাদের নিয়ে যান নতুন জগতে। নোবেল-বক্তৃতাতেও সাহিত্যদর্শন, জীবনবোধ ইত্যাদি বড় বড় কথা বলেননি তিনি। বরং বলেছিলেন রবিনসন ক্রুসোর কথা। নির্জন দ্বীপ থেকে উদ্ধার পেয়ে বৃদ্ধ ক্রুসো তখন ব্রিস্টলে। মাঝে মাঝে হাঁস শিকার করতে যান, লন্ডনে প্লেগ হানা দেয়, দ্বীপের সঙ্গী ‘ফ্রাইডে’র কথা মনে পড়ে। কী ছিলেন তাঁরা? প্রভু-ভৃত্য? যমজ ভাই? সাংবাদিকেরা সে বার কুতসিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ক্রুসো না ফ্রাইডে কে তাঁর প্রতীক? নিজেকে স্পষ্ট করতে চাননি লেখক, তাঁর উত্তর ছিল, ‘আয়্যাম নট শিয়োর।’
তিয়াত্তর বছরের কুতসি-ই দুনিয়ার একমাত্র লেখক, যিনি নোবেলের পাশাপাশি দু’বার বুকার জিতেছেন। এবং এক বারও সেই পুরস্কার-অনুষ্ঠানে যাননি, বলেছিলেন ‘লেখককে হাস্যাস্পদ করে তুলতে এর চেয়ে বড় ছকবাজি আর হয় না।’ গত বছর জয়পুর সাহিত্য উৎসবে এসেছিলেন। শর্ত ছিল, শুধুই নতুন লেখার একটি অংশ পড়বেন। তার পর সন্ধ্যার পার্টি বা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর নয়। এই পাণ্ডুলিপিটিরই অংশবিশেষ পড়ে শুনিয়েছিলেন লেখক, কিন্তু মিডিয়া তাঁর নাগাল পায়নি। ‘তিন মিনিটের খ্যাতি’র যুগে কুতসি এক ব্যতিক্রম।
ব্যতিক্রমী লেখকের উপন্যাসে, সাইমন খুঁজতে থাকে ডেভিডের মাকে। শিশু ডেভিডের আশা, বড় হয়ে সে ‘লাইফসেভার’ হবে, মৃত ঘোড়াকে বাঁচাবে। হবে ‘এসকেপ আর্টিস্ট’, যে কোনও মুহূর্তে এখান-সেখান থেকে পালিয়ে যাবে। আর হবে জাদুকর। উদ্ভট আকাঙ্ক্ষা? কিন্তু এই শিশু কোনও নিয়ম মানতে চায় না। ২ আর ৪ যোগ করতে বললে উত্তর দেয়, ৫। ৯৩-এর পরের সংখ্যা বলে ৮৮৮। সাইমন তাকে বোঝায়, সংখ্যারা ইটের গাঁথনির মতো। পরপর আসে। শিশু বলে, ‘না। সংখ্যা কোনও নিয়ম ছাড়াই, এলোমেলো ভাবে থাকে। ইচ্ছামতো বেছে নিতে হয়। দুই আর তিনের মাঝে তো মস্ত ফাঁক, যদি সেই ফাঁকের মধ্যে পড়ে আমরা হারিয়ে যাই?’ কে ভুলতে পারে, ইংরেজির অধ্যাপক কুতসি অঙ্কেও স্নাতক? সত্তর দশকে আইবিএম সংস্থায় কম্পিউটার প্রোগ্রামারের চাকরি করতেন। তাঁর লেখায় বরাবরই বিশদ বর্ণনার বদলে এই রকম ছোট ছোট সংলাপ। কুতসির বন্ধু, ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক মার্টিন অ্যামিসের অনুযোগ ছিল, স্টাইলটি পাঠকের পক্ষে প্রীতিকর নয়। কুতসির উত্তর, আইবিএমের চাকরিতে তাঁকে সারা দিনে পাঁচ লাইনের ‘কোড’ বানাতে হত। সেই অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে, লেখাই সব নয়। সেটি ছেঁটেকেটে আঁটোসাটো করার অন্তহীন প্রক্রিয়াতেও বিশ্বাস রাখতে হয়।
ভাবী লাইফসেভার ও এসকেপ আর্টিস্ট শিশুটিকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে শহরের এক অভিজাত আবাসনে একদিন তরুণী আইনেসকে টেনিস খেলতে দেখে সাইমন। ইনটুইশন বলে, এই কুমারী তরুণীই ডেভিডের মা। আইনেসকে সেই কথা জানালে তরুণী পরের দিন বাড়ি ছেড়ে এসে শিশু ডেভিডের দায়িত্ব নেয়। স্প্যানিশ ‘আইনেস’ শব্দের অর্থ, পবিত্র। কুমারী মায়ের নামকরণেই রয়ে গেল পবিত্রতার ইঙ্গিত?
আইনেসের শর্ত ছিল, সাইমনের বাড়িতে সে ডেভিডকে নিয়ে থাকবে। কিন্তু সাইমনের থাকা চলবে না। ঘরছাড়া সাইমন তাই ডকইয়ার্ডে কুটির বেঁধে থাকে। বন্ধুরা বোঝায়, অচেনা এক মেয়ের হাতে ডেভিডের দায়িত্ব দিয়ে ভুল করেছে সে।
ভুল মানতে নারাজ সাইমন। সে বলে,“বাবা আসলে ‘আইডিয়া’, মাতৃজঠরেই শিশু পায় প্রকৃত মর্ম।” বন্ধুরা মানে না, ‘‘ভাবী শিশুর মা-বাবা কেন এক হয়? পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব আছে বলে? একেবারেই নয়। বরং দুই নারী-পুরুষের পথ আচমকা মিলে যায়, তারা প্রেমে পড়ে। এর চেয়ে এলোমেলো, বিশৃঙ্খল আর কী হতে পারে?” পিতার দায়িত্ববোধ মাঝে মাঝেই কুতসির উপন্যাসে হানা দেয়। ১৯৮৯-এ এগারো তলার ফ্ল্যাট থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল তাঁর একমাত্র পুত্র। তার বছর কয়েক পরে দস্তয়ভস্কিকে নিয়ে দ্য মাস্টার অব পিটার্সবার্গ উপন্যাস। ছেলে পাভেল যে মিনার থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল, তার নিচে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন দস্তয়ভস্কি, ‘স্টেয়ার্স ডাউন দেয়ার ইনটু দ্য প্লুমেটিং ডার্কনেস।’
জীবন এই রকমই এলোমেলো, বিশৃঙ্খল? নোভিলা শহরে সব ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে হয়। কিন্তু সব স্মৃতি নষ্টের পরেও তো হাড়ে, রক্তে, মাংসে থেকে যায় অতীতের অবশেষ। উপন্যাসের শেষে নোভিলার কর্তৃপক্ষ ঠিক করে, বালক ডেভিডকে পাঠানো হবে স্পেশাল স্কুলে। সংখ্যা গুনতে তার যেন আর ভুল না হয়!
কিন্তু সেই স্কুলে রয়েছে কাঁটাতার আর কড়া শাসন। ডেভিডকে গাড়িতে তুলে সাইমন আর আইনেস এ বার পালাতে থাকে। রাস্তায় সেই গাড়িতে ওঠে এক হিচহাইকার। তিনজনে মিলে পালাতে থাকে নোভিলা থেকে দূরে, আরও দূরে। কর্তৃপক্ষের চোখ-রাঙানি এড়িয়ে, যাযাবর হয়েই বাঁচবে তারা। শেষ অধ্যায়ে তিন জনের মধ্যে কি রয়ে গেল খ্রিস্টের জন্মের পর প্রাচ্যদেশীয় তিন পণ্ডিতের আগমন-ইঙ্গিত?
নাকি, রয়েছে অন্য স্তর? বালক ডেভিড বলে, ‘অক্ষর, শব্দ এই সব বাজে জিনিস আমার পড়তে ভাল লাগে না। আমি বই পড়তে চাই।’ বই কি শুধুই অক্ষরের সমাহার? নাকি, তার বাইরেও রয়ে যায় অন্য সত্তা?
রক্তমাংসের পিতা না হয়েও সাইমন প্রশ্রয় দেয় ডেভিডের চিন্তাকে। পাঁচ বছরের বালককে সে বলে, ‘হ্যাঁ, বড় হলে বুঝবে, মানুষ আর কিছুই নয়। স্রেফ একটা আইডিয়া।’ কুতসি কেন নাড়িয়ে দিয়ে যান, এর পরেও কি খুলে বলতে হবে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.