নন্দীগ্রাম কাণ্ডে বুদ্ধদেবকে ছাড় দিল সিবিআই
ন্দীগ্রামে গুলি চালানোর ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভূমিকা কী ছিল, সিবিআই-কে তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। রাজ্যকে সিবিআই জানিয়ে দিয়েছে, ওই ঘটনায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তেমন কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। নন্দীগ্রাম কাণ্ডে চার্জশিট পেশ করার আগে বুদ্ধবাবুকে কার্যত ‘ক্লিনচিট’ দিয়েই মহাকরণে রিপোর্ট পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটি।
নন্দীগ্রাম কাণ্ডের তদন্তে নেমে রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশের ১২ জন কর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে সিবিআই। এঁদের মধ্যে তিন জনের বিরুদ্ধে বিনা প্ররোচনায় গুলি চালানোর অভিযোগে চার্জ গঠনের জন্য সরকারের কাছে অনুমতি চায় তারা। বাকি ৯ জনের বিরুদ্ধে অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের অভিযোগ ছিল, বেশ কয়েক জন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে লঘু শাস্তির সুপারিশ করেছে সিবিআই। তাঁদের ভূমিকা নতুন করে খতিয়ে দেখা হোক। গত মাসে রাজ্যকে দেওয়া চূড়ান্ত রিপোর্টে সিবিআই জানিয়েছে, ওই পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধেও বিনা প্ররোচনায় গুলি চালানোর সাক্ষ্য-প্রমাণ মেলেনি।
সিবিআইয়ের যুগ্ম-অধিকর্তা অরুণ বোথরার পাঠানো ওই রিপোর্ট এখন খতিয়ে দেখছে স্বরাষ্ট্র দফতর। সরকারের এক মুখপাত্র জানান, এর পর আইনি পরামর্শের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হবে। তবে সিবিআইয়ের সুপারিশ অনুযায়ী রাজ্যের কোনও অফিসারের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশের অনুমতি তড়িঘড়ি দেওয়া হবে না।
২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। ১৭ মার্চ কলকাতা হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। ঘটনার দিন নন্দীগ্রামের তিন দিক দিয়ে পুলিশ ঢুকেছিল। ভাঙাবেড়ায় ১১ জন এবং অধিকারীপাড়ায় ৩ জন মারা যান। তৃতীয় স্থান মহেশপুরে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়নি।
সে দিন ভাঙাবেড়ায় ছিলেন পশ্চিমাঞ্চলের তৎকালীন আইজি অরুণ গুপ্ত, জেলার পুলিশ সুপার গঞ্জি শ্রীনিবাসন এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী-সহ আরও অনেকে। সিবিআই প্রথম দু’জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করেছে। অধিকারীপাড়ায় ছিলেন দুই আইপিএস অফিসার সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস বড়াল এবং নন্দীগ্রাম থানার তৎকালীন ওসি শেখর রায়। সিবিআই তাঁদের বিনা প্ররোচনায় গুলিচালনার জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে অভিযুক্ত করে চার্জ গঠনের অনুমতি চেয়েছে।
মেদিনীপুর রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি রমেশবাবু সে দিন তেখালি ফাঁড়িতে বসে দু’জায়গার অপারেশন নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও বিভাগীয় তদন্তের কথা বলেছে সিবিআই। তৎকালীন জেলাশাসক অনুপ অগ্রবাল-সহ আরও ৫ জন প্রশাসনিক কর্তার বিরুদ্ধেও ‘মেজর পেনাল্টি’-র সুপারিশ করে তারা।
সরকারি সূত্রের খবর, ২০১২ সালের মে মাসে সিবিআই প্রথম রাজ্য সরকারের কাছে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করে তিন পুলিশ কর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশের অনুমতি চায়। সরকার প্রাথমিক ভাবে তা মানেনি। সিবিআই রিপোর্টের ব্যাপারে সিআইডি-র তৎকালীন ডিজি বি ভি থাম্বির পরামর্শ চাওয়া হয়। তিনি জানান, ষড়যন্ত্রকারী অনেকের নাম বাদ পড়ে গিয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করা দরকার।
ইতিমধ্যে গত বছর নভেম্বরে ফের রাজ্যকে চিঠি লিখে তিন পুলিশকর্তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের অনুমোদন চায় সিবিআই। এই অবস্থায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিবিআই-কে চিঠি দিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং কয়েক জন পুলিশ অফিসারের ভূমিকা ফের খতিয়ে দেখার প্রস্তাব দেয় রাজ্য। সরকারের বক্তব্য ছিল, যেখানে ১১ জন নিহত হলেন, সেখানে কারও উপযুক্ত শাস্তি হল না। আর যেখানে কম লোক মারা গেলেন, সেখানকার তিন অফিসারের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হবে কেন? তা ছাড়া, নন্দীগ্রামে গুলি চালনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল মহাকরণে বসে। ৩ হাজার পুলিশ দিয়ে অপারেশন চালানো হয়েছিল। ফলে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারীরা ছাড় পাবেন কেন?
এ বছর মে মাসে তারই জবাব দিয়ে সিবিআই চূড়ান্ত ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, রাজ্যের প্রস্তাব মতো বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখেছে। কিন্তু তার পরেও অভিযুক্তদের সম্পর্কে নতুন করে কোনও তথ্য মেলেনি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। ফলে আগে পেশ করা তদন্ত রিপোর্ট তারা এক চুলও এ দিক-ও দিক করতে রাজি নয় জানিয়ে ওই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়েছে সিবিআই।
রাজ্য অবশ্য এখনই এ পথে হাঁটতে নারাজ। মহাকরণের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম নন্দীগ্রামে গণহত্যার জন্য গব্বরদের শাস্তি হোক। কিন্তু সিবিআই তো সাম্বা, কালিয়াদের বিরুদ্ধে মামলা সাজিয়েছে! যদি গব্বররাই ছাড় পেয়ে যান, তা হলে সাম্বা-কালিয়াদের শূলে চড়িয়ে কী লাভ?” তাঁর প্রশ্ন, “এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন? তিন জন অফিসার শাস্তি পাবেন, আর তিন জন ছাড় পাবেন, তা হয় নাকি!”
এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে সিবিআই সূত্র বলছে, তদন্তে কোথায় কত জন মারা গিয়েছে, সেই মতো শাস্তির সুপারিশ করা হয়নি। কোন পরিস্থিতিতে গুলি চালাতে হয়েছিল, সেটাই বিচার করা হয়েছে। ভাঙাবেড়ায় গ্রামবাসীরা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল, তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে তাঁর অনুমতি নিয়েই গুলি চলে। যদিও পুলিশ আরও ধৈর্য ধরে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারত। অন্য দিকে, অধিকারীপাড়ায় দায়িত্বরত পুলিশকর্তারা গুলি চালানোর ঘটনা এড়িয়ে যেতেই পারতেন। সেখানে বিনা প্ররোচনায় গুলি চলেছিল বলে মনে করে সিবিআই। কোনও ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে ছিলেন না। জেলাশাসক এত বড় পুলিশি অভিযান নিয়ে সরকারকে আগে থেকে সতর্ক করেননি। এমন কী ঘটনার পরও এলাকায় যাননি। সিবিআই রিপোর্টে নাম থাকায় প্রাক্তন জেলাশাসকের পদোন্নতি আটকে যায়। যদিও সিবিআইয়ের রিপোর্ট আসার আগেই ঘটনাস্থলে থাকা অফিসারদের পদোন্নতি করেন বুদ্ধবাবু।
কিন্তু সিবিআইয়ের এই রিপোর্টের পরে এখন কী হবে? স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, সরকার চাইলে সিবিআই-কে চার্জ গঠনের অনুমতি না-ও দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ১৯৯৪ সালে উত্তরাখণ্ড রাজ্য গঠনের আন্দোলনে পুলিশ মুজফ্ফরনগর জেলার রামপুরে গুলি চালিয়েছিল। তাতে ৭ জন মারা যান ও কিছু মহিলাকে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট ঘটনার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। সিবিআই ২৮ জন অফিসারের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে ৪ বার সরকার পরিবর্তন হয়ে গেলেও সিনিয়র অফিসারদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের অনুমতি মেলেনি।
ওই কর্তা এও জানান, সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আইনি দিকটা খতিয়ে দেখতে চায় সরকার। তাতে দোষী অফিসারদের শাস্তি বিলম্বিত হলেও আপত্তি নেই।

পুরনো খবর



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.