বন-পাহাড়ের দেশ ঢেকেছে মন-খারাপের কুয়াশায়
“মেঘ পিওনের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা,
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা...”


‘তিতলি’ ছবির জন্য এই গান লিখেছিলেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ নিজেই। তাঁর চলে যাওয়ার খবরে উত্তরবঙ্গ যেন ঢেকে গিয়েছে মন খারাপের কুয়াশাতেই। মাস দু’য়েক আগে গত মার্চেই তিনি এসেছিলেন উত্তরবঙ্গে। ‘সত্যান্বেষী’-র শ্যুটিংয়ে। শিলিগুড়ি শহর, সেবক, চাপড়ামারিতে দিন চারেক কাটিয়ে ছবির কাজ করেন। স্মৃতির অ্যালবাম উল্টে দেখতে খুঁজতে বেরিয়ে ছিলেন চাপড়ামারির সেই সব ‘স্পট’, যেখানে আগে ‘খেলা’-র সময় শ্যুটিং করেছিলেন। সে বার সেবক কালী বাড়িতে পুজো দিতেও গিয়েছিলেন তিনি। সেই স্মৃতিই এখন খুঁজে ফিরছে তরাই, ডুয়ার্স।
গত মার্চেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের। তিনি জানান, ছবির কাজে ঘোড়ার দরকার ছিল ঋতুপর্ণের। তিনি উত্তরবঙ্গে এসে ফোনে গৌতমবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি কোথায় আছেন জেনে গৌতমবাবু নিজেই যান ঋতুপর্ণের সঙ্গে দেখা করতে। কফি খেতে খেতে কথা হয়। গৌতমবাবু আশ্বাস দেন সমস্ত রকম সাহায্যের। কিছুক্ষণ পরেই মুখ্যমন্ত্রীর ফোন। তিনিও ঋতুপণর্র্কে সাহায্যের কথা বলে। গৌতমবাবুও জানিয়ে দেন, ঋতুপর্ণের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ফের ঋতুপর্ণ ফোন করে গৌতমবাবুকে জানান, মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে স্নেহ করেন বলেই তিনি গৌতমবাবুকে ফোন করে সাহায্যের বিষয়টি আবার বলেছেন।
চাপড়ামারিতে ‘সত্যান্বেষী’, শ্যুটিংয়ে ঋতুপর্ণ।
গৌতমবাবু বলেন, “দু’টি ঘোড়ার দরকার ছিল। তিনি কাজের প্রতি খুবই নিষ্ঠাবান। বুঝতে পারলাম ঘোড়া ঠিক মতো না পাওয়া গেলে হয়তো শ্যুটিংটাই এখানে হবে না। তাই সব রকম ভাবে চেষ্টা করে ঘোড়ার ব্যবস্থা করি।”
পাহাড়ের পাকদণ্ডির ধারে ঝাউ, ওকের সারি। কোথাও কুয়াশার চাদর ভেদ বেরিয়ে আসছে টয়ট্রেন। ডুয়ার্সের বনাঞ্চলের কোথাও শাল, শিশুর অরণ্য। বন-পাহাড়ের এই পটভূমিতেই ঋতুপর্ণ তার একাধিক ছবির শ্যুটিংয়ে ব্যবহার করেছেন। ‘তিতলি’, ‘খেলা’, থেকে ‘আবহমান’। জীবন পথের মতোই পাহাড়ের অচেনা অজানা বাঁক, পাহাড়ের ঢালে গাছের সারি আর মেঘ রোদের খেলা দেখতে দেখতে মজে যেতেন তিনি।
টুকরো স্মৃতি ভেসে উঠছিল শিলিগুড়ির দেশবন্ধুপাড়ার বাসিন্দা দীপজ্যোতি চক্রবর্তী, প্রধাননগরের সন্তোষ সাহাদের মনে। উত্তরবঙ্গে এলেই ডাক পড়ত আইনজীবী দীপজ্যোতির। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল ঋতুপর্ণের। তাঁকে শেষ এসএমএস পাঠিয়েছিলেন নববর্ষে। তার আগের এসএমএস-টা ছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের নিজের বাড়ির ঠিকানা পাঠিয়ে। দীপজ্যোতি বলেন, “আমার কাছে দুটি জিনিস ছেয়েছিলেন ঋতুদা। বুদ্ধমূর্তি আর আমাদের এদিককার হালকা হাওয়াই চটি। তা আর দেওয়া হল না।” তাঁর ছেলে রিমিক ‘খেলা’ ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। এ বার উত্তরবঙ্গে এসেও রিমিকের খোঁজ করেছিলেন তিনি।
দীপজ্যোতিবাবুর ল্যাপটপে, অ্যালবামে রয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে ফেলে আসা দিনের সেই সব ছবি। বলছিলেন, “বছর সাতেক আগের কথা। লাভাতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়লেন ঋতুদা। রাস্তার ধারে কিছুটা নেমে একটা গাছকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তিতলিতে এই গাছটার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন অপর্ণা সেন। পরে সিনেমায় সেই গাছটাও দেখিয়েছিলেন। এ বারও চাপড়ামারিতে শ্যুটিং করতে এসে খুঁজছিলেন ‘খেলা’ ছবির শ্যুটিংয়ের জায়গাটা। সেখানে গিয়ে দেখালাম।”
দীপজ্যোতি জানান, এ বার গরুমারাতে একটি বনবাংলোতে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথা বলছিলেন ঋতুপর্ণ। তাঁর কথায়, “বেশিরভাগ সময়ই দেখতাম রবীন্দ্রনাথ, মহাভারতে ডুবে থাকতে। ঘুমনোর সময় মাথার কাছেও একটা মোটা মহাভারত দেখতাম। এ বার সেবকের কালীবাড়িতে পুজো দিতে গেলেন।” উপরে মন্দিরে উঠে যান ঋতুপর্ণ। দীপজ্যোতি নীচেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফিরে এসে ঋতুপর্ণ বললেন, “আমি মন্দিরে ঢোকার সময় অনেকেই চিনতে পারেন। তাঁরা ঠাকুরের দিক থেকে ফিরে জোড় হাতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন আমিই দেবতা। কী অদ্ভুত লাগছিল!”
দীপজ্যোতিবাবুর বাড়িতেও থেকেছেন ঋতুপর্ণ। সখ্যতা গড়ে উঠেছিল পরিবারে সঙ্গেও। এ দিন সকালে খবর পেয়ে দীপজ্যোতি ফোন করছিলেন গৌতমবাবুকে। গৌতমবাবু বলেন, “ফোনে দীপজ্যোতি কাঁদছিলেন। খবরটা যখন বললেন তখন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সম্প্রতি দীপজ্যোতিকে বলেছিলেন শরীরটা খারাপ। ছবির কাজে নয়, দিন কয়েক পরেই তাঁর বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসবেন বলে ঠিক ছিল।” তা আর হল না।
বন-পাহাড়ের দেশের তাই মন খারাপ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.